জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের দায়
৬ অক্টোবর ২০২৩ ১৯:১৪
আজ ৬ অক্টোবর জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন দিবস। আমাদের কিছু প্রচলিত কাজ রয়েছে তার মধ্যে কিছু কিছু দিবস ঘটা করে পালন করে থাকি। কোন দিবস আসলেই ওই দিবসের আদ্যোপান্ত খুঁজি না বা জানার চেষ্টাও করি না। হুজুগের মতো… অন্যরা করে তাই আমরাও করি। অথচ আমাদের সকল বিষয় কমবেশি জানা উচিত বা জানতে হয়।
আজ এ দিবসটি পালনের চেয়ে আইনের বিষয় জানা জরুরী। তবে দিবস পালনের ক্ষেত্রে আমার কোন দ্বিমত নেই। দিবসের দিন কিছুটা হলেও দিবস সম্পর্কে জানতে পারে। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন আমাদের সকলের জানা দরকার এবং আইনে যাদের কর্তৃপক্ষ সাব্যস্ত করেছে তাদেরও এ বিষয়ে জানা উচিত। আমি দেখেছি বাংলাদেশের ইউনিয়ন পরিষদে এবং পৌরসভা অথবা সিটি কর্পোরেশন জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের কর্তৃপক্ষ । কিন্তু এই সকল দপ্তরে কর্মরত ব্যক্তিরাও আইনের বিষয়ে জানেন না অথচ এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ এর ৮৷ (১) ধারায় বলা হয়েছে ”শিশুর পিতা বা মাতা বা অভিভাবক বা নির্ধারিত ব্যক্তি উক্ত শিশুর জন্মের ৪৫ (পঁয়তাল্লিশ) দিনের মধ্যে জন্ম সংক্রান্ত তথ্য নিবন্ধকের নিকট প্রদানের জন্য বাধ্য থাকিবেন৷” (২) মৃত ব্যক্তির পুত্র বা কন্যা বা অভিভাবক বা নির্ধারিত ব্যক্তি মৃত্যুর ৪৫ (পঁয়তাল্লিশ)] দিনের মধ্যে মৃত্যু সংক্রান্ত তথ্য নিবন্ধকের নিকট প্রদানের জন্য বাধ্য থাকিবেন৷
২১। (১) এই আইন বা তদধীন প্রণীত বিধির কোন বিধান লঙ্ঘনকারী ব্যক্তি অনধিক ৫ (পাঁচ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন। (২) উপ-ধারা (১) এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, যদি কোন ব্যক্তি জন্ম বা মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য মিথ্যা তথ্য প্রদান করেন বা এমন কোন লিখিত বর্ণনা বা ঘোষণা প্রদান করেন, যাহা তিনি মিথ্যা বলিয়া জানেন বা বিশ্বাস করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৫ (পাঁচ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে অথবা অনধিক ১ (এক) বৎসর বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন। (৩) উপ-ধারা (১) এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, যদি কোন নিবন্ধক উপ-ধারা (২) এ উল্লিখিত মিথ্যা তথ্য, লিখিত বর্ণনা বা ঘোষণা সম্পর্কে জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও জন্ম বা মৃত্যু নিবন্ধন করেন তাহা হইলে সংশ্লিষ্ট নিবন্ধক অনধিক ৫ (পাঁচ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে অথবা অনধিক এক বৎসর বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন, যদি না তিনি প্রমাণ করিতে সক্ষম হন যে উক্ত অপরাধ তাহার অজ্ঞাতসারে সংঘটিত হইয়াছে অথবা উক্ত অপরাধ রোধ করিবার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছেন।] আইনে ৯৷ (১) নিম্নবর্ণিত ব্যক্তিগণ কোন ব্যক্তির জন্ম বা মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য নিবন্ধকের দায়িত্বে রয়েছেন -(ক) ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, এবং সচিব;(খ) গ্রাম পুলিশ; (গ) সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার [কাউন্সিলর];(ঘ) ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন অথবা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মী ও পরিবার কল্যাণ কর্মী; (ঙ) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সেক্টরে নিয়োজিত বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের (এনজিও) মাঠকর্মী;(চ) কোন সরকারী বা বেসরকারী হাসপাতাল বা ক্লিনিক বা মাতৃসদন বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে জন্মগ্রহণ ও মৃত্যুবরণের ক্ষেত্রে উহার দায়িত্বপ্রাপ্ত মেডিক্যাল অফিসার অথবা ডাক্তার বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা; (ছ) কোন গোরস্থান বা শ্মশান ঘাটের তত্ত্বাবধায়ক;(জ)নিবন্ধক কর্তৃক নিয়োজিত অন্য কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী; (ঝ) জেলখানায় জন্ম ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে জেল সুপার বা জেলার বা তত্কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি;
(ঞ) পরিত্যক্ত শিশু বা সাধারণ স্থানে (Public Place) পড়িয়া থাকা পরিচয়হীন মৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা; এবং(ট) নির্ধারিত অন্য কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান৷(২) কোন ব্যক্তির জন্ম ও মৃত্যু সংক্রান্ত তথ্য উপ-ধারা (১) এ উল্লেখিত ব্যক্তির নিকট সরবরাহ করিলে তিনি নিজে উহা নিবন্ধনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন অথবা তথ্য প্রদানকারী ব্যক্তিকে নিবন্ধনের পরামর্শসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করিবেন৷”
কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখছি। আমি ২০১৬ সালে সংকল্প ট্রাস্টের সহযোগিতায় নারী পক্ষের একটি প্রজেক্টে সাতটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইনে কাজ করেছিলাম সেই অভিজ্ঞতা থেকে যতটুকু জানতে পারলাম ইউনিয়ন পরিষদে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন নিয়ে তেমন কোন সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়নি ওই সময়ে অনেক ইউনিয়ন পরিষদে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন বইও ছিল না। এখন মনে হয় অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে।
বাংলাদেশে ভুরিভুরি আইন রয়েছে এটি প্রয়োগ এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদাসীন এমনকি জনগণের কল্যাণের জন্য আইন হলেও ওই আইনের বিষয়ে জনগণ কিছুই জানেন না। আইন যদি জনগণের কল্যাণের জন্যই প্রণীত হয়ে থাকে তাহলে আমার সুপারিশ থাকবে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করার আগে তৃণমূলে এর উপকারিতা অপকারিতা সম্পর্কে একটি জনমত তৈরি বা সার্ভে, ষ্টাডি করা, একটি আইন প্রণীত হওয়ার পর গ্রামভিত্তিক, ওয়ার্ড ভিত্তিক, ইউনিয়ন ভিত্তিক, শহর ভিত্তিক উঠান বৈঠক কর্মশালার মাধ্যমে আইনের বিষয়ে অবগত এবং সচেতনতা করা দরকার। তাহলে হবে কি ওই আইনের উপকারিতা অপকারিতা কর্মকাণ্ড, শাস্তি, দন্ডের বিষয়ে জানতে পারবে যার ফলে এ সকল অপরাধ করা থেকে জনগণ বিরত থাকবে। আমরা দেখেছি একটি আইন প্রয়োগ হয় কিন্তু ওই আইনের বিষয়ে জানেই না ওই ব্যক্তি অপরাধী যদি ওই ব্যক্তি যে অপরাধ করেছে সেই অপরাধের শাস্তি বা দন্ড যদি তিনি আগে জানতেন হয়তো ওই অপরাধ সংগঠিত হতো না। আমি বলছি না যে সমাজ থেকে অপরাধ একেবারেই নির্মূল হবে কিন্তু এ সকল কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছুটা অপরাধ কমবে।
আমি সামগ্রিকভাবে বলছি না, যেহেতু আজকের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন দিবস। তাই এই আইনের বিষয়ে আমি বলতে চাই, যদি কোন জনগণকে প্রশ্ন করা হয় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন জানেন কিনা উত্তরে হয়তোবা ১০ ভাগ মানুষও জানবেন না, যদি আইন প্রয়োগকারী কর্তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় অথবা ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করা হয় এই আইনের বিধান বলে কজনকে শাস্তি দন্ড বা আইনের আওতায় আনা হয়েছে উত্তরে একভাগ জবাব আসবে কিনা আমার সন্দেহ রয়েছে। অথচ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের জন্য স্থানীয় সরকারের ভূমিকা রয়েছে। এর দায় থেকে স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। তাহলে স্থানীয় সরকারের কাজ কি এটি এখন প্রশ্নবিদ্ধ। সরকার জন্ম মৃত্যু নিবন্ধনের ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থায় থাকলেও তৃণমূলে এর কার্যকর ও ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না।
তাই বলতে চাই আইন, আমাদের ভুরি ভুরি রয়েছে কিন্তু কার্যকর প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন নেই। আমরা নিজ থেকে সচেতন হই। যে আইন গুলো বিদ্যমান রয়েছে সে আইনের মধ্যে একটা আইন পুরোপুরি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের ব্যক্তি কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নেওয়া উচিত, একটি উদাহরণ থাকা উচিত;
যেহেতু জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন আমাদের প্রতিটি নাগরিকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সকল ক্ষেত্রে সকল কাজে এই নিবন্ধন জরুরী। এ নিবন্ধন ছাড়া কোন কাজ করা সম্ভব নয়। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশন তাদের উদ্যোগ নেওয়া উচিত যে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইনের বিষয়ে জনগণকে সচেতনতা ব্যক্তির জন্য ওয়ার্ড ভিত্তিক উঠান বৈঠক করা।
‘নির্ভুল জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন করবো, শুদ্ধ তথ্য ভান্ডার গরবো’ এ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিলো। সম্মিলিত এবং আন্তরিকতা না থাকলে কখনই শুদ্ধ তথ্য ভান্ডার গড়ার সুযোগ নেই। তাই এখন সময়ের দাবি মাত্র। কথায় বলে জন্ম যদি সঠিকভাবে না হয় সে জন্ম আসলে জন্ম বলা যায় না। আবার এও বলা হয়ে থাকে “জন্ম হােক যথা তথা কর্ম হােক ভালাে” মানুষ পৃথিবীতে স্মরণীয় ও বরণীয় হয় তার কর্মগুণে। সেই সাথে জীবনে গৌরব ও মর্যাদার আসন লাভের পেছনেও থাকে কর্মের ভূমিকা। কর্মের দ্বারা মানুষ প্রতিষ্ঠা লাভ করে । জন্মের বা বংশের তথ্য সেখানে গৌণ। তাই একটি শিশু জন্ম গ্রহণ করলে সে থাকে নিষ্পাপ; আমাদের কর্মের জন্য অনাগত শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার আমাদের নেই।
পরিশেষে বলতে চাই, অনাগত শিশুর ভবিষ্যৎ আমরা সুন্দর করে গড়ে তোলার সহযোগিতা করি, একটি নির্ভুল জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন তথ্য ভান্ডার গড়ে তুলি, তাহলে অনাগত শিশুর ভবিষ্যৎ সুন্দর হবে, টেকসই উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো ঢেলে সাজাতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতায়ন করতে হবে। নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
সারাবাংলা/এজেডএস
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের দায় শফিকুল ইসলাম খোকন