গুজব যখন গজব
৮ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:১৮
বর্তমান সময়ে সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেকোন খবর মূহুর্তের মধ্যেই সবার কাছে পোচ্ছে যায়। আর এই সুযোগ ব্যবহার করে অনেকেই খুব সহজে গুজব ছড়িয়ে দেয়। আর সেই গুজবের সত্য মিথ্যা যাচাই না করে, আমরা শেয়ারের পর শেয়ার দিতে থাকি। পরবর্তীতে এই গুজব মানুষের মাঝে এক ধরনের ভীতি সৃষ্টি করে, বিতর্ক সৃষ্টি করে, হতাহতের ঘটনা পর্যন্ত ঘটে যায়। প্রকৃতপক্ষে যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহার করে এসব গুজব ছড়াই তাদের বেশিরভাগেরই এর পিছনে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য করে থাকে। আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা এটা বুঝতে পারিনা।
ভোলার বোরহানউদ্দিনের ঘটনাই যদি দেখি তাহলে গুজব এবং এর পরিণতি নিয়ে কোন অস্পষ্টতা থাকার কথা নয়। একটি কথিত ফেসবুক ম্যাসেজকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়৷ হিন্দুদের বাড়ি ঘরে হামলা হলো। কিন্তু যে ফেসবুক ম্যাসেজ দিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে তার ফেসবুক আইডিটি হ্যাক হয়েছে আগেই। আর ওই হ্যাকড আইডি থেকে অন্যকেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধর্মীয় অবমাননার ম্যাসেজ দিয়ে তার স্ক্রিনশট ছড়িয়েছে। তাহলে এটা পরিস্কার যে এই গুজব ছাড়ানোর পিছনে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ আছে৷ তাদের টার্গেট ছিলো ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে হিন্দুদের আক্রমণ এবং ফায়াদা লোটা।
একটি গুজব কতটা ভয়ংকর রুপ নেয়, তার আরেকটি উদাহরণ হলো কলেজ ছাত্র শিবলী সাদিক হত্যা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ফটোকার্ড ও ভিডিওসহ নানা ধরনের কনটেন্টে দাবি করা হয়- কলেজছাত্র শিবলিকে হত্যার পর অভিযুক্তরা তার ‘মাংস রান্না করে খেয়েছে’। একইসঙ্গে ‘মানুষখেকো’ আখ্যা দিয়ে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানো হয়। এতে করে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় পড়ে যায় পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়া এসব গুজব ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যরা বিব্রতকর পরিস্থিতি ও সমস্যার সম্মুখীন হয়। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা পড়ে যায় তারা। নিজ এলাকার বাইরে ভাষাসহ নানা কারণে বুলিংয়ের শিকার হতে হয় তাদের । পরবর্তীতে মরদেহ উদ্ধার, এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও আসামিদের গ্রেপ্তারের অভিযানিক দলের রাউজান থানার উপ-পরিদর্শক আজিজুল হক গণমাধ্যমকে জানান রান্না করে তার মাংস খাওয়ার খবরটি ভুয়া। এসবের ভিত্তি নেই। এ বিষয়ে তাঁরা কিছু পাইনি। ব্লগাররা ভাইরাল হওয়ার জন্য এটা ছড়াচ্ছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণকালে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের হোতারা বিরোধিতা করে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধে ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি উদ্ভট উপায়ে মানুষের মাথা ও রক্ত পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত হবে মর্মে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মাথা ও রক্তের জোগান দিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থেকে ছেলেধরা হচ্ছে বলে গুজব রটে। এই গুজবটি মুহূর্তের মধ্যেই দেশব্যাপী আলোড়ন ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন।
ছেলেধরা গুজবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আহত ও নিহত হওয়াদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন নারী, মানসিক রোগী, প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধাসহ নিরীহ মানুষ। তবে ছেলেধরা গুজবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় তসলিমা বেগম রেণু হত্যা। বাড্ডায় নিজের মেয়েকে স্কুলে ভর্তির তথ্য জানতে এসে তসলিমা বেগম রেণু ছেলেধরা গুজবের শিকার হয়ে গণপিটুনিতে নিহত হন। এ ধরনের গুজবের পরিণতি মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক ও মর্মবেদনার। রেণুর নির্মম হত্যার বিষয়টি সর্বত্র আলোড়ন সৃষ্টি করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শুরু হয়কে বিভ্রান্ত করতে প্রতিনিয়ত ছড়ানো হচ্ছে এসব গুজব।
এখন আপনি কিভাবে বুঝবেন এটি গুজব?
গুজব সনাক্ত করা গভীর চিন্তাভাবনা এবং সত্য-পরীক্ষার দক্ষতার সাথে জড়িত। একটি বিষয় গুজব কিনা তা প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন। তবে কিছু বিষয় খেয়াল করলে সহজে বুঝা যায়। প্রথমে তথ্যের উৎস পরীক্ষা করুন। এটি কোন নির্ভরযোগ্য সংবাদ মাধ্যমে থেকে পাওয়া। এটি কোন বিশ্বাসযোগ্য সংস্থা কিনা, অজানা বা পক্ষপাতমূলক উৎস থেকে তথ্য পওয়া হলে সতর্ক থাকুন। ক্রস-চেক করুন অর্থাৎ একাধিক নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে একই তথ্য দেখুন। যদি শুধুমাত্র একটি সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য থেকে এটি রিপোর্ট করে, এটি একটি গুজব হতে পারে। প্রকাশনার তারিখ যাচাই করুন। গুজব পুরানো খবর হিসাবে পুনরুত্থিত হতে পারে, মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য।
বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করুন। আবেগপূর্ণ বা প্রমাণের অভাব বলে মনে হয়? গুজবকারীরা প্রায়ই এই কৌশল ব্যবহার করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা তথ্যের ব্যাপারে বিশেষভাবে সন্দিহান হোন, যেখানে গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। শেয়ার করার আগে যাচাই করুন।গুজবটি প্রতিষ্ঠিত তথ্য এবং সাধারণ জ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা বিবেচনা করুন। অসঙ্গতি মিথ্যা নির্দেশ করতে পারে। অযাচাইকৃত তথ্য ছড়ানো এড়িয়ে চলুন। কখনও কখনও, আরও তথ্য বা অফিসিয়াল বিবৃতির জন্য অপেক্ষা করা সর্বোত্তম পদক্ষেপ। মনে রাখবেন যে গুজবগুলি অনিশ্চয়তা এবং ভয়ের উপর ভর করে তাই সন্দেহজনক মনে হয় এমন তথ্যের মুখোমুখি হওয়ার সময় সতর্ক থাকতে হবে।
গুজব নয় সত্যকে জানতে হবে। কোন বিষয় শেয়ার দেওয়ার পূর্বে নিজের চিন্তাশক্তি ব্যবহার করুন। গুজব একটি অপরাধও বটে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানহানিকর, বিভ্রান্তিমূলক, অশ্লীল, আক্রমণাত্মক, জাতি, ধর্ম, জাতীয়তা বা যৌনতা নিয়ে করা যে কোনো অমূলক পোস্টই সাইবার অপরাধ হিসেবে হয়। তাই কেউ গুজব বা এ ধরনের পোস্ট ছড়ালে যে-কেউ আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে অপরাধীকে জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেফতার করতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আর আদালতের রায়ে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে ভুয়া তথ্য ও গুজব ছড়ানোর অপরাধীদের।
তাই একজন দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে কোন বিষয়ে শেয়ার দেওয়ার পূর্বে অবশ্যই ভালোভাবে সে সম্পর্কে জেনে নিতে হবে, যাচাই-বাছাই করতে হবে। সবসময় মনে রাখতে হবে একজন ব্যক্তি কখনো একটি বিষয় মূহুর্তে ছড়িয়ে দিতে পারবেনা। গুজব আপনার, আমার, আমাদের মাধ্যমেই ছড়াই। আমাদের সচেতন হতে হবে।
প্রত্যেক নাগরিক তার নিজ জায়গা থেকে সচেতন হলেই গুজব প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই গুজব সম্পর্কে নিজে সচেতন থাকুন, অন্যকে সচেতন করুন।
লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই