শূন্য থেকে স্বাবলম্বী জবি শিক্ষার্থী নিবিড়
১১ অক্টোবর ২০২৩ ১৭:০০
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া বাকি দশজন শিক্ষার্থী যেখানে তথাকথিত আত্মমর্যাদাবোধ আর অহমিকার গোড়ামিতে ডুবে আছে সেখানে কিভাবে ক্ষুদ্র ব্যাবসার মধ্য দিয়ে আত্মকর্মসংস্থান তৈরি করে নিজেকে স্বাবলম্বী করে তুলতে হয় তারই প্রমাণ দেখিয়েছেন গাইবান্ধা জেলার খামারপীরগাছার নিবিড় মুস্তাকিম। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগে তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নিবিড় মুস্তাকিম। লোকলজ্জা আর মানসিক সংকীর্ণতাকে পেছনে ফেলে আত্মনির্ভরশীলতার জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসাকে জীবীকা নির্বাহের পন্থা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তিনি।
প্রতি বছর বাংলাদেশে ষাট হাজারের অধিক শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় পাহাড়সম স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। খুব স্বাভাবিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে তার এই পরিচয় মানসপটে এক তথাকথিত আত্মসম্মানবোধের জন্ম দেয়। এই বোধ থেকেই আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল সিংহভাগ শিক্ষার্থী আত্মনির্ভরশীলতার পথ হিসেবে টিউশনিকে বেছে নেয়। আর এভাবেই সে খুব সস্তা দামে তার মূল্যবান সময়কে বিক্রি করে দেয় টিউশনের কাছে।
নিবিড়ও তার ব্যাতিক্রম ছিলেননা। শূন্য হাতে সুদূর গাইবান্ধা থেকে ঢাকায় আসেন নিবিড়। আর্থিক অস্বচ্ছলতার দরুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর প্রথম দিকে তিনিও টিউশনি করে পড়াশোনা ও অন্যান্য খরচ বহন করতেন। কিন্তু, করোনা মহামারীতে মানুষের অর্থনৈতিক দূরাবস্থার কারণে অনেক পরিবার হোম টিউটর দিয়ে তাদের বাচ্চাদের পড়ানো বন্ধ করে দেয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিবিড়ের টিউশনিও চলে যায়। তাকে এক অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হতে হয়।
তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে নিবিড় দ্বিতীয়। বাবা কৃষি কাজ করেন। এতো বড় সংসার ও ছেলে- মেয়েদের পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। তাই, দু-এক মাস এর ওর থেকে ধার করে চললেও এভাবে খুব বেশিদিন চলতে পারবেননা জেনে অবশেষে নিবিড় তার শুভাকাঙ্ক্ষী বড়ভাইয়ের পরামর্শক্রমে ৫ হাজার টাকা ধার নিয়ে একটি পুরনো ভ্যান কিনে ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যাবসা শুরু করেন।
প্রথম দিকে আলু, পেয়াজ, আদা, রসূনের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যে দিয়ে ব্যাবসা শুরু করেন নিবিড়। এরপর বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের বাহারি ফলমূল বিক্রি করতে শুরু করেন৷ একটা সময় তার ব্যাবসা দাড়িয়ে যায় এবং আজ পর্যন্ত চলছে। এভাবেই নিবিড় প্রতি মাসে আয় করছেন ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। এই ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমেই নিজের পড়াশোনা ও অন্যান্য ব্যয়ের পাশাপাশি তার ছোট দুই ভাইবোনের পড়াশোনার খরচ চালান। সংসারেও মাঝে মাঝে আর্থিক যোগান দেন।
শুভাকাঙ্ক্ষীরা তার এই উদ্যোগে বাহবা জানালেও অনেকেই তার কাজকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন বলে মনে করেন নিবিড়।
নিবিড় তার অনুভূতি ব্যাক্ত করে বলেন, “করোনা মহামারী সময় খুবই দূর্ভোগে কাটাতে হয়েছে। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটিয়েছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম প্রয়োজনে রিকশা চালিয়ে হলেও টিকে থাকতে হবে। পরর্বতীতে হিতৈষীদের পরামর্শক্রমে ব্যাবসা শুরু করি। যদিও প্রথম দিকের সময়টা আমার ভালো কাটেনি। এই কাজটার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়েছে। কারণ, একটি স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে এমন পদক্ষেপে অনেকে বাহবা জানালেও অনেকের কটু কথা শুনতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে এমন কাজে আমাকে দেখতে অনেকেই স্বস্তি বোধ করেনি। অনেকে তাচ্ছিল্যের সুরে ‘হকার’ বলে গালি দিয়েছে। আমি কখনোই তাদের কথায় কান দেইনি।”
তিনি বলেন, “হালাল পথে উপার্জিত যেকোনো আয়ের পন্থাই আমার কাছে সম্মানের। অন্তত এখান থেকে কিছু না কিছু শেখা যায়। পাশাপাশি আমার আয়ও হচ্ছে। আমার ভবিষ্যতে ব্যাবসার করার ইচ্ছে আছে। সে সুবাদে আমার ছোট ব্যাবসা হয়তো আমাকে অনেক বড় জায়গায় নিয়ে যাবে। কারণ, আমি ব্যাবসার খুটিনাটি বিষয়গুলো শিখছি যেটা বাকি ৫ জন শিক্ষার্থী পারছেনা। তাই আমি তাদের অনেকের থেকেই এগিয়ে আছি।
বর্তমানে বাংলাদেশে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ১০০ জন শিক্ষার্থীর ৪৭ জনই বেকার (তথ্যসূত্র: প্রথম আলো)। ‘সোনার হরিণ’ ক্ষ্যত সরকারি চাকুরির পেছনে পিপাসিত কুকুরের ন্যায় ছুটছে তারা এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। কিন্তু তারা সংখ্যায় যত সে তুলনায় চাকুরির পোস্ট এ দেশের চাকুরির বাজারে নেই। দিনশেষে হতাশ হয়ে বাড়ি ফেরা। বিষন্নতায় কাটে প্রতিটি রাত। চোখে ঘুম নেই। বার বার মনে পড়ে বাবা মায়ের মুখ। যারা উন্মুখ হয়ে বসে আছে তাদের সন্তান কোন ভালো সরকারি চাকুরি পাবে তাদের সংসারের দুঃখ ঘুচে যাবে এই আশায়। এদিকে হতভাগা সন্তান চাকরি পাবেনা জেনে পরিবারের থেকে আনা পড়াশোনার খরচ চালাবার বাবার কষ্টে টাকাগুলোর কথা মনে করে অঝোরে চোখের জল ফেলে।
অথচ বাংলাদেশের কৃষি শিল্পে সমৃদ্ধ একটি দেশ। দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে কৃষি খাতে আমাদের অনেক জনশক্তি প্রয়োজন। শুধু কৃষি খাতই নয় বরং এমন আরো অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে এই বেকার যুবসমাজকে কাজে লাগানো যেতে পারে। কিন্তু তাদের এসবে আগ্রহ নেই। শিক্ষিত লোকের শরীরের কাদামাটি লাগলে জাত যায় এই নীতি তাদের রক্তে রন্ধ্রে মিশে আছে।
নিবিড়ের মতো আরো হাজারো নিবিড় আমাদের প্রয়োজন যারা নিজেদেরকে পরিবার, সমাজ এবং দেশের জন্য বোঝা না বানিয়ে আত্মকর্মসংস্থান তৈরি করে নেবে। এবং দেশে অর্থনীতিতে অংশীদারত্ব করবে। যারা সকল পেশাকে সম্মান করবে। কোনো পেশাকে ছোট করে দেখবেনা। যাদের মধ্যে থাকবেনা পুজিবাদের সংকীর্ণ মানসিকতা।
পরিশেষে নিবিড় বেকার যুবসমাজের উদ্দেশে বলেন, আমি উচ্চশিক্ষা অর্জন করে চাকুরির পেছনে ছুটতে ইচ্ছুক নয়। শিক্ষা আমার মানসিক সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাবে চাকুরি এর উদ্দেশ্য নয়। প্রতিটি শিক্ষার্থী যদি এর পেছনে না দৌড়ে নিজ উদ্যোগে আত্মকর্মসংস্থান গড়ে তোলে তাহলে দেশের উন্নতি সাধন হবে। তবে এর জন্য যা প্রয়োজন তা হলো একটি মুক্ত ও প্রশস্ত মানসিকতা।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
জুনায়েদ মাসুদ মুক্তমত শূন্য থেকে স্বাবলম্বী জবি শিক্ষার্থী নিবিড়