বিশ্ব খাদ্য দিবসে লক্ষ্য হোক নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ
১৬ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:২১
প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় খাদ্য দিবস। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা প্রতিষ্ঠার স্মরণে এই দিনটি পালিত হয়। খাদ্য দিবসে লক্ষ্য হোক নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ। প্রতিদিন খাবার গ্রহণের সময় নানা প্রশ্নে জর্জরিত হচ্ছি আমরা। যা খাচ্ছি তা বিষ নয় তো? ফলমূলে কেমিকেল, মাছে ফরমালিন, মাংসে ক্ষতিকর হরমোন, শাকসবজিতে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ- এ ধরনের অনেক সংশয় ও আতঙ্কের মধ্যেই আমরা বেঁচে আছি। আমরা যে খাদ্য খাচ্ছি তা কতটা নিরাপদ? নিরাপদ খাদ্য বলতে এমন খাদ্যকে বোঝায় যা ক্ষতিকারক পদার্থ, যেমন- প্যাথোজেন, টক্সিন এবং রাসায়নিক থেকে মুক্ত এবং এমনভাবে প্রস্তুত, পরিচালনা এবং সংরক্ষণ করা হয় যাতে খাদ্যজনিত অসুস্থতার ঝুঁকি থাকে না। খাদ্যজনিত অসুস্থতা প্রতিরোধ করতে এবং দূষিত বা নষ্ট খাবার গ্রহণের সাথে সম্পর্কিত যে কোনও সম্ভাব্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে ব্যক্তিদের রক্ষা করতে নিরাপদ খাদ্য করা অপরিহার্য।
অনিরাপদ খাদ্য ব্যক্তির স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার উপর বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। খাদ্যজনিত অসুস্থতা: অনিরাপদ খাবার খাওয়ার ফলে সালমোনেলা, ই. কোলাই, লিস্টেরিয়া এবং নোরোভাইরাস সংক্রমণের মতো খাদ্যজনিত অসুস্থতা হতে পারে। এই অসুস্থতাগুলি ডায়রিয়া, বমি, পেটে ব্যথা, জ্বর এবং গুরুতর ক্ষেত্রে কিডনি ব্যর্থতা বা মৃত্যুর মতো উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে।
গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা: অনিরাপদ খাবার পরিপাকতন্ত্রকে বিরক্ত করতে পারে, যার ফলে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা হয়। এর ফলে বদহজম, ফোলাভাব, পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব এবং কিছু ক্ষেত্রে মারাত্মক ডিহাইড্রেশন হতে পারে।
অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া: অ্যালার্জেন রয়েছে এমন অনিরাপদ খাবার গ্রহণ করা নির্দিষ্ট উপাদানের প্রতি অ্যালার্জিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এই প্রতিক্রিয়াগুলি হালকা উপসর্গ যেমন ফুসকুড়ি, চুলকানি এবং ফোলা থেকে গুরুতর অ্যানাফিল্যাক্সিস পর্যন্ত হতে পারে, যা জীবন-হুমকি হতে পারে।
পুষ্টির ঘাটতি: অনিরাপদ খাবারে শরীরের সঠিক কার্যকারিতার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি, ভিটামিন এবং খনিজগুলির অভাব হতে পারে। এই জাতীয় খাবারের নিয়মিত সেবনের ফলে পুষ্টির ঘাটতি হতে পারে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্য ব্যাধির ঝুঁকি বাড়ায়।
দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা: অনিরাপদ খাবারের ক্রমাগত ব্যবহার স্থূলতা, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং নির্দিষ্ট ধরণের ক্যান্সারের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের বিকাশে অবদান রাখতে পারে। ক্ষতিকারক পদার্থের জমে থাকা বা নির্দিষ্ট খাদ্য উপাদানের অত্যধিক গ্রহণ (যেমন, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, ট্রান্স ফ্যাট) এই স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
উৎপাদনশীলতা এবং জীবনের মান হ্রাস: অনিরাপদ খাবারের ফলে খাদ্যজনিত অসুস্থতা বা হজমের সমস্যাগুলি উত্পাদনশীলতা হ্রাস, কাজ বা স্কুলে অনুপস্থিত, এবং শারীরিক অস্বস্তি এবং অসুস্থতার কারণে জীবনের সামগ্রিকভাবে হ্রাস পেতে পারে।
নিরাপদ খাদ্য গ্রহণে সরকারের সচেষ্ট থাকতে হবে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে, সরকারকে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করতে হবে, কঠোর বিধি বাস্তবায়ন এবং প্রয়োগ করুন, সরকারেরত উচিৎ ব্যাপক খাদ্য নিরাপত্তা বিধান স্থাপন করা যা প্রস্তুত থেকে ভোগ পর্যন্ত। খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলের সমস্ত স্তরকে দেখাশোনা করবে।
সরকারকে খাদ্য সুবিধা, খামার এবং রেস্তোঁরাগুলি খাদ্য সুরক্ষা মানগুলি মেনে চলে তা নিশ্চিত করতে নিয়মিত পরিদর্শন করা উচিত। কোনো দূষণ, রোগজীবাণু, বা অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থ শনাক্ত করার জন্য খাদ্যের নমুনার পর্যায়ক্রমিক পরীক্ষা করা উচিত।
ভোক্তা, খাদ্য ব্যবসা এবং শ্রমিকদের মধ্যে নিরাপদ খাদ্য পরিচালনার অনুশীলন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সরকারের উচিত শিক্ষামূলক প্রচারণায় বিনিয়োগ করা। প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং সংস্থান সরবরাহ করা সঠিক খাদ্য পরিচালনার কৌশল, স্বাস্থ্যবিধি এবং স্যানিটেশন প্রচার করতে হবে। সরকারের উচিত খাদ্যবাহিত অসুস্থতা, প্রাদুর্ভাব এবং দূষণের তথ্য সংগ্রহের জন্য নজরদারি এবং পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করা। এই তথ্যের ভিত্তিতে সম্ভাব্য ঝুঁকি শনাক্ত করে এবং তাদের মোকাবেলা করার জন্য যথাযথ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
সরকারের উচিৎ খাদ্য উৎপাদকদের এমন ট্রেসেবিলিটি সিস্টেম স্থাপন করা যা খামার থেকে কাঁটা পর্যন্ত খাদ্য পণ্যের ট্র্যাকিং এবং সনাক্তকরণের অনুমতি দেয়।
এটি দূষণ বা অন্যান্য নিরাপত্তা উদ্বেগের ক্ষেত্রে অনিরাপদ খাদ্য দ্রুত শনাক্তকরণ এবং প্রত্যাহার করতে সাহায্য করবে। সরকারের উচিৎ অন্যান্য দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে খাদ্য নিরাপত্তা বিধি ও মানকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অনিরাপদ খাদ্য আমদানি ও রপ্তানি রোধে সাহায্য করতে পারে।
এই ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সরকার খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে পারে, জনস্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারে এবং খাদ্য সরবরাহে ভোক্তাদের আস্থা তৈরি করতে পারবে।
পাশাপাশি নিজেদেরও সচেতন থাকতে হবে। নিরাপদ খাদ্য খাওয়ার জন্য কিছু নিয়মকানুন মেনে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। খাবার আগে আপনার হাত ভাল করে ধুয়ে নিন। আপনার রান্নাঘর এবং রান্নার পাত্র পরিষ্কার রাখুন। ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি রোধ করতে উপযুক্ত তাপমাত্রায় খাবার সংরক্ষণ করুন। প্রস্তাবিত অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রায় খাবার রান্না করুন। দূষণ রোধ করতে কাঁচা মাংস এবং অন্যান্য খাবারের জন্য পৃথক কাটিং বোর্ড ব্যবহার করুন।
পচনশীল খাবার ফ্রিজে রাখুন 40°F (4°C) এর নিচে। একটি নিরাপদ সময়সীমার মধ্যে অবশিষ্টাংশ খাদ্য ব্যবহার করুন (সাধারণত তিন থেকে চার দিনের মধ্যে)।
খাবার তৈরি এবং রান্নার জন্য নিরাপদ পানির উৎস ব্যবহার করুন। খাদ্যজনিত অসুস্থতার ঝুঁকি কমাতে পাস্তুরিত দুগ্ধজাত পণ্য ব্যবহার করুন।
কাঁচা বা কম সিদ্ধ করা ডিম, মাংস বা সামুদ্রিক খাবার খাবেন না। কাঁচা বা কম রান্না করা স্প্রাউট খাওয়া এড়িয়ে চলুন, কারণ এতে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে।
রান্না করা খাবার ঘরের তাপমাত্রায় দুই ঘণ্টার বেশি রেখে দেবেন না। কাঁচা মাংস খাওয়ার জন্য প্রস্তুত খাবার থেকে দূরে রেখে দূষণ এড়িয়ে চলুন। পাস্তুরিত দুধ পান করবেন না বা পাস্তুরিত দুগ্ধজাত পণ্য খাবেন না। মেয়াদ উত্তীর্ণ বা নষ্ট খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলুন।
নিরাপদ খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টেকসই জীবন ও সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প নেই। অনিরাপদ খাদ্য শুধু স্বাস্থ্যের ঝুঁকিরই কারণ নয়, বরং দেহে রোগের বাসা বাঁধারও অন্যতম কারণ। বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার সুস্থ ও সমৃদ্ধশালী জাতি গঠনে একান্ত অপরিহার্য।
লেখক: শিক্ষার্থী; কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
ইমরান হোসাইন বিশ্ব খাদ্য দিবসে লক্ষ্য হোক নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ মুক্তমত