আমার বাবা: যেমন দেখেছি, যেমন জেনেছি
১৬ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:১০
ধ্যান, জ্ঞান, মননে যার সংস্কৃতি, সেটাকে উপজীব্য করে জীবন ধারণ মধ্যবিত্ত বাস্তবতায় কঠিন ও সংগ্রামের। এতে শুধু প্রফুল্ল চিত্ত ছাড়া, থাকে না বিত্ত বৈভব বা অনন্য অর্থনৈতিক মুক্তি । তেমনটাই আমার বাবা। সংগ্রাম যেমন সংস্কৃতি নিয়ে করেছেন, জীবিকার জন্য করেছেন একান্নবর্তী পরিবারের প্রতিটা মানুষের জন্য সমান দৃষ্টিভঙ্গীতে।
পরিবার খুব বেশী সহায়ক না হলেও, বাবা প্রকৃতিগত ভাবে ছোটবেলা থেকেই ছিলেন সংস্কৃতিমনস্ক। আঁকাআকিঁ, নাটক, থিয়েটার যেন উনার রক্তে।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৬২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ছাত্র হিসেবে ঢাকা চারুকলা কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন বাবা ও গৌতম মুনি চাকমা। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম সংগঠক আবুল বারাক আলভী ছিলেন সেসময়কার বাবাদের ঘনিষ্ঠ সহপাঠী।
৭৫ পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত পরম শ্রদ্ধাভাজন ছৈয়দুর রহমান সাহেবদের সাথে পার্বত্য অঞ্চলে আওয়ামী রাজনীতির অন্যতম সংগঠক ছিলেন বাবা। ১৯৬৪ইং সাল হতে ১৯৭১ইং সাল পর্যন্ত পালন করেছিলেন তৎকালীণ রাঙামাটি ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন ডেপুটি কালেক্টর এইচ.টি ইমামের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে সাংগঠক হিসেবে কাজ করেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট পর্যন্ত ছিলেন রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামীলীগের সমাজ কল্যাণ ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক।
ফটোগ্রাফি’তে ছিল অসম্ভব ঝোঁক। ছবি তোলা, ডার্করুম, ডেভেলাপ, রিটার্চ সহ খুটিনাটি শিখেছিলেন বহু জায়গায়। সেটাকেই হাতিয়ার করে সংসারের হাল কাঁধে তুলে ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘চিত্রবিতান’ স্টুডিও। পাহাড়ের প্রায় প্রতিটা এলাকাতেই ছবি তোলার কাজে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রকল্পেও সারা রাঙ্গামাটি জুড়েই ছবি তোলার কাজ করেছেন। ১৯৭১ইং পূর্ববর্তী সময়ে চাকমা রাজবাড়ির বহু সাদাকালো ছবি বাবার হাতে তোলা বলেই জেনেছিলাম উনার নিজের মুখেই।
১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘রাঙামাটি আর্ট স্কুল’। রাঙ্গামাটি আর্ট স্কুল থেকে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী বের হয়ে নিজেদের মেধায় স্ব স্ব ক্ষেত্রে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন। ছেলে মেয়েদের আর্ট শিখতে আনতে আনতে রাঙ্গামাটির একসময়কার জেলা প্রশাসক সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের সহধর্মীণিরাও আবৃত্তি ও কাপড়ের নকশা আঁকা শিখেছিলেন এখানে।
ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রচলনের আগ পর্যন্ত জাতীয়, স্থানীয় নির্বাচন সহ বিভিন্ন সময় সারা বছর ব্যাপী ব্যানার, সাইনবোর্ড, ফেস্টুন, দেওয়াল লিখন নিয়ে ব্যস্ত সময়ই কাটতো বাবার। যা থেকে আয়ের পুরোটাই উজার করে দিতেন বাবাদের ৩ ভাইয়ের ২৯ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারে, কখনো একক ভাবে ভাবেওনি নিজের কথা-ভবিষ্যত-সংকট-স্বার্থ…এসব।
বাবা কিছুদিন দৈনিক মানবজমিনের জেলা প্রতিনিধি, দৈনিক গিরিদর্পণ, ঝিনাইদহ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সীমান্তবাণী, পাক্ষিক পত্রিকায় লেখালেখিও করেছিলেন। ছিলেন বাংলাদেশ প্রেসক্লাব ফেডারেশন রাঙামাটি সদর থানা’র সভাপতি।
রাঙ্গামাটির তৎকালীণ আর্ট কাউন্সিল হল, রাজার মাঠে যখন এক্সিবিশন হতো, দিন রাত ব্যস্ত থাকতো আঁকাআকিঁ ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজন নিয়ে।
আমৃত্যু সংস্কৃতি মনস্ক বাবা নিজের হাতেগড়া ‘বহুরূপী নাট্য সংস্থা’ থেকে সুনামের সাথেই স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বহু নাটক মঞ্চায়ন করেছিলেন। রাঙ্গামাটিতে স্বর্ণশীলা ৮০ইং ও ১৯৮২-তে ঢাকায় জাতীয় নাট্য উৎসবে ভারতীয় বিখ্যাত নাট্যকার শম্ভু মিত্রের “চোর” নাটক মঞ্চায়ন করে প্রশংসা কুড়িয়ে ছিলেন। পরবর্তীতে “কর্ণফূলী থিয়েটার” থেকেও নাটক মঞ্চায়ন করেছিলেন সমমনা নাট্যকর্মীদের সাথে নিয়ে। সেসময় পাহাড়ী এই মফস্বল শহরে পূর্ণাঙ্গ নাটক মঞ্চায়ন করা ছিল দূরহ। যেহেতু এখানে টিকেট কেটে নাটক দেখার সংস্কৃতি নেই, সেহেতু নাট্যকর্মীদের পকেটের টাকা দিয়ে নাট্যচর্চা সব সময় বেশী দূর এগোই না।
২০১৩ইং সালের জুলাই অব্দি দেশের সমস্ত জাতীয় দিবস ও উৎসবে, রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন, জেলা তথ্য অফিসের সচেতনতামূলক কার্যক্রম, সরকারী বিভিন্ন দফতর সহ বিভিন্ন অফিস/প্রতিষ্ঠানের নাটক সহ নানান সাংস্কৃতিক আয়োজনের অপরিহার্য একজন মানুষ ছিলেন বাবা।
বাবার প্রত্যক্ষ তদারকিতে জেলা শিল্পকলা একাডেমীর নাটক বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা ইন্টার এক্টিভ পপুলার থিয়েটার কার্যক্রমের আওতায় ইউনিসেফ ও সরকারী অর্থায়নে “শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ” ও “প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা” বিষয়ে সচেতনতামূলক নাটকের উপর দেশবরণ্য নাট্যকার রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ ও আরণ্যক নাট্যদলের সান্নিধ্যে উচ্চতর প্রশিক্ষণ পরবর্তী রাঙ্গামাটি জেলার প্রতিটা ইউনিয়নে মঞ্চায়ন করেছেন বিষয় ভিত্তিক নাটক।
নাটকপ্রাণ বাবার সাথে নিয়মিত রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম, ঢাকায় সখ্যতা ছিলো কিংবদন্তী নাট্যজন আনোয়ার হোসেন, গোলাম হাবিবুর রহমান মধু, রহমত উল্লাহ, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, প্রখ্যাত বেহালা বাদক নজরুল ইসলাম তিতাস সহ আরো অনেকের সাথে।
তৎকালীন উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট ও রাঙামাটি জেলা শিশু একাডেমীর চিত্রাংকন ও আবৃত্তি প্রশিক্ষক ছিলেন বাবা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন জেলা শিল্পকলা একাডেমীর অংকন, আবৃত্তি ও নাট্য প্রশিক্ষক। উদ্বোধন পরবর্তী ১৯৯৮ সাল থেকেই বাংলাদেশ বেতার রাঙামাটি কেন্দ্রে নিয়মিত নাটক, নাটিকা, জীবন্তিকা, কথিকা রচনা, পরিচালনা ও তালিকা ভুক্ত নাট্যশিল্পী হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি।
১৯৯০ সালে পার্বত্য রাঙ্গামাটিতে নাট্য সপ্তাহ উপলক্ষে মঞ্চায়িত নাটকে ১ম স্থান অধিকার করেন। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী থেকে নাটকের উপর মাসব্যাপী উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। ১৯৯৯ সালে রাঙ্গামাটিতে ‘সার্ক মীনা দিবস’ ও জাতীয় শিশু সপ্তাহে আয়োজিত নাট্যানুষ্ঠানের জন্য প্রশংসিত হন। ২০০১ সালে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমানের কাছ থেকে জেলার শ্রেষ্ঠ নাট্য ব্যক্তিত্বের সম্মাননা গ্রহণ করেন। স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘শিল্পীনিকুঞ্জ’ বিশিষ্ট নাট্যজন সম্মাননা ২০০৪ প্রদান করেন। ২০১১তে প্রথম বার স্ট্রোকের পর ডান হাতের কিছুটা অক্ষমতা নিয়েও করে গেছেন নাট্যচর্চা। তারপর ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় নাট্য উৎসব ২০১২-তেও রাঙ্গামাটি সরকারী কলেজ নাট্যদল নিয়ে সম্মাননা গ্রহণ করেন তিনি। ওয়ার্ল্ড পীস এন্ড হিউম্যান রাইটস্ সোসাইটি, রাঙ্গামাটি ২০২১-এ “নাট্য অভিনেতা সম্মাননা” (মরণোত্তর) পদক তুলে দেন আমার মায়ের হাতে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, রাঙামাটি জেলার সভাপতিও ছিলেন তিনি। পার্বত্য অঞ্চলের সুপ্রাচীন শ্রীশ্রী রক্ষাকালী মন্দির কমিটিতে দীর্ঘদিন কোষাধ্যক্ষ, সাধারণ সম্পাদক,সভাপতির দায়িত্বপালন করেন। মন্দিরের আজকের এই অবস্থানের পেছনে উনাদের ত্যাগ ও নিরলস শ্রম অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই। গৌর নিতাই আশ্রম সহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বাবাদের ভূমিকা ছিল আন্তঃপ্রাণ।
ছাত্রজীবনে স্কাউট আন্দোলনে যুক্ত থেকে ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ ভ্রমণ করেন বাবা।
নাটক নিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে কোলকাতার বিভিন্ন মঞ্চেও অভিনয় করেছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে উদ্ভুদ্ধ করতে “জয় বাংলা” নামে পথনাটক করেছিলেন কোলকাতার পথে পথে। কোলকাতার একাধিক চলচিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড় পরবর্তী নিজের বড় ভাই সুনীল কান্তি মিত্র মৃতঃপ্রায় শয্যাশায়ী থাকার কারণে।
২০১৩ সালের ২ আগস্ট শুক্রবার সকাল ১০.৩০ মিনিটে স্ট্রোকের চিকিৎসাধীন অবস্থায় চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
আমরা হারিয়েছি বাবা, সাথে নিভে গেল পাহাড়ে সংস্কৃতির নিবেদিতপ্রাণ আলোকবর্তিকা।
লেখক: সংস্কৃতি কর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই