Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমরা কি পারি না শিশুদের নিরাপদ জীবন দিতে?

উম্মে সুমাইয়া ইয়াসমিন
১৭ অক্টোবর ২০২৩ ১৮:১৭

‘আমার মেয়েটার নয় মাস চলতেছে এখনো। ও দুধের বাচ্চা। ওকে অনেক আঘাত করা হয়েছে। আমি শুধু এর বিচার চাই’। ৯ মাসের রক্তাক্ত শিশু বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিয়ে মায়ের এমনই আহাজারি শোনা গিয়েছিলো ২০১৯ সালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে। আপন চাচার নিকট ধর্ষিত হয়ে মৃতপ্রায় শিশু বাচ্চাটিকে বাঁচানো যাবে কিনা এ আশঙ্কায় মাতৃ হৃদয় জুড়েও যেনো হচ্ছে রক্তক্ষরণ। আজ চার বছর পেরিয়ে ২০২৩-এ এসেও এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে প্রতিনিয়ত। এই করুণ দৃশ্য যে আমাদের বিবেককে কিছুটা জাগ্রত করেনি, এমন কিন্তু না। আমরা পত্রিকার পাতা, কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় প্রতিনিয়ত এরকম নিকৃষ্ট ঘটনা প্রত্যক্ষ করে ব্যথিত হই, তীব্র নিন্দা জানাই, আর তারপর নাকে তেল দিয়ে ঘুমাই। বাস্তবে আমাদের সচেতন চিত্তে এই বিভৎস দৃশ্য কতোটুকু দাগ কাঁটতে পারে এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

বিজ্ঞাপন

ধর্ষণ! শব্দটা কতোটা অকপটে, অবলীলায় মুখ থেকে বের করা যায়। ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা এদেশে এতো নিয়মিত ঘটে যে শব্দটা শুনতে শুনতেই যেনো সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু, এই সহজ শব্দটার সাথে যখন একটা ছোট্ট বিশেষণ ‘শিশু’ যুক্ত হয় তখন এই শব্দ দুটি আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ও বেদনাদায়ক শব্দগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি মনে হয়। বুকের পাঁজর ভেঙে আসে, আর বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। জানি না এই বক্ষব্যধি আমার একার কিনা। আফসোস যদি এই ব্যাথা আমার না হয়ে আমাদের হতো! তাহলে আজ আমরা সমাজের অন্যরূপ দেখতাম হয়তো। ধর্ষনের শিকার ৪, ৫, ৬ বছরের ছোট্ট নিষ্পাপ শিশুটির জায়গায় যখন নিজের ৫ বছরের ছোট্ট বোনটির মুখ কল্পনা করি, মুহূর্তে পৃথিবীটা হয়ে ওঠ বিভীষিকাময়। এই দীর্ঘশ্বাস, এই বেদনা, এই রক্তক্ষরণ কেবল তাদের কাছেই বোধগম্য হয়, যাদের নাড়ি ছেঁড়া ধন ছোট্ট মেয়ে বা বোনটি হয় ধর্ষণের শিকার। আফসোস! এই দীর্ঘশ্বাস শুধু তাদের না হয়ে আমাদের হলে ২০১৯ এর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে ঘটতে ২০২৩ এ এসেও আনন্দের তরে জন্ম নেওয়া ছোট্ট শিশুটি পৃথিবীটাকে এতো নিষ্ঠুর হিসেবে জানতো না। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের ‘স্টেট অব চাইল্ড রাইটস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৭ সালে দেশে ৫৯৩ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, অথচ ২০১৬ সালে যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের শিকার হয়েছিলো ৪৪৬ জন শিশু, অর্থাৎ ১ বছরের ব্যবধানে ধর্ষণের হার বেড়েছে শতকরা ৩৩ ভাগ। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৬৩ জন শিশু, যার মধ্যে ২৬ জন প্রতিবন্ধী শিশু ও ছিলো। ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয় ১৭৯ শিশু এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৫৮ শিশুকে। এই ১১ মাসে ৯৩ জন শিশু সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। এছাড়া গত বছরেও ধর্ষণের শিকার হয় ৮১৮ শিশু এবং খুন হয়েছে ১৮৩ জন। অর্থাৎ, পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই নোংরামির হার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। প্রতি মাসে গড়ে ৬৪ জন শিশু ধর্ষিত হয় বাংলাদেশে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিশুরা পরিবারের সদস্য, নিকট আত্মীয় বা পরিচিতদের দ্বারা ধর্ষিত হয়। শিশু দের নানা রকম আকর্ষণীয় বস্তু বা খাবার দেবার প্রলোভন দেখিয়ে এই জঘন্য কাজ করে অভিযুক্তরা। পত্রিকার পাতায় উঠে আসা কিছু বিভৎস ঘটনা আমাদের দৃষ্টিগোচর হলেও, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিনিয়ত পরিবারের সদস্য কর্তৃক অসংখ্য শিশু ধর্ষিত হয়, যা সম্মানহানির ভয়ে গোপন রাখা হয়। ফলে এই মারাত্মক ব্যধিটা কতোটা ভয়ানক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তা আমরা আন্দাজ ও করতে পারি না।

বিজ্ঞাপন

শিশু ধর্ষণের বৃদ্ধি পাওয়ার নানাবিধ কারণ রয়েছ। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দায়বদ্ধতা তো আছেই। এর সাথে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে পর্নোগ্রাফি। পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা যুব সমাজের চরম নৈতিক অবক্ষয়ের কারণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, পর্নোগ্রাফি দেখার ফলে একপ্রকার হরমোন নিঃসৃত হয়, যা তাদের ধর্ষণে প্রলুব্ধ করে। কিছু সংখ্যক মাদক ও রয়েছে যা ধর্ষণে প্রভাব ফেলে। এছাড়া ও শিশুদের সুস্থ বিনোদন চর্চার অভাব, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা থেকে দূরে সের আসা, তথ্যপ্রযুক্তিকে নেতিবাচক কাজে ব্যবহার এবং সবশেষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়া প্রভৃতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধর্ষণের জন্য দায়ী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষণের ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা হয় না। এক্ষেত্রে বিচারকার্যের দীর্ঘ সূত্রিতাই মূল কারণ। ফলে বিচার বিভাগের কঠোর অবস্থান এবং তাৎক্ষণিক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় অপরাধীরা এই জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হতে পিছপা হয় না৷ আর এর নির্মম বলি হয় কোমলমতি শিশুরা। কতোশতো মায়ের কোল খালি হয়, কতো নিষ্পাপ শিশু এই শারীরিক নিপীড়নের শিকার হয়ে ফুলের কুঁড়িটির মতো প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে তার হিসাব আমরা রাখি না। কারণ, আমরা অতি সভ্য জাতি। আমাদের ধারণা ওখানেই আবদ্ধ হয়ে আছে ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম।’ অথচ, এই কোমলমতি ছোট্ট শিশুগুলিকে পরিপূর্ণ ভাবে প্রস্ফুটিত হতে দিলে, তারাও ফুলের মতো শোভা ছড়াতে পারতো পৃথিবী নামক বাগানটিতে। তাই শিশুদের বসবাসের উপযুক্ত, সুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশ ও সমাজ সৃষ্টি করে দেওয়ার দায়িত্ব পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের।

শিশু ধর্ষণ রোধে সমাজের সচেতন নাগরিকদের উপস্থিতি একান্ত কাম্য। নতুবা আমরা সমাজ বিচ্ছিন্ন জীবে পরিণত হবো, যার ভয়াবহ পরিণতি হবে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং বিকৃত সমাজব্যবস্থা। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের ‘শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ শাবনাজ জাহিরিন মনে করেন ‘বাংলাদেশে ধর্ষণের হাত থেকে শিশু দের রক্ষার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই।’ তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘যে ধরনের অবকাঠামো, লোকবল বা সেবা দরকার সেগুলো এখনো অনেক কম। সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ করে কমিউনিটি লেভেলে যে ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন আছে সেগুলো এখনো কার্যকর নয়।’ তার কথায় বাস্তব চিত্রই যেনো ফুটে ওঠে।

প্রকৃতপক্ষে, আমাদের গুটিকয়েক সমাজ সেবামূলক সংস্থা আছে বটে তবে শিশু সুরক্ষায় তাদের অংশগ্রহণ যথেষ্ট এবং প্রশংসনীয় নয়। এছাড়া আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত নয়। ফলে শিশু ধর্ষণ মামলার বিষয়টিকে অনেক সময় তারা যথার্থভাবে মূল্যায়ন এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়।এক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি কঠোর নির্দেশনা প্রদান এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি যাতে ভুক্তভোগীরা মামলা করতে এসে কোনো রকম হয়রানির শিকার হওয়া বা উপযুক্ত বিচার পেতে ব্যর্থ না হয়। পাশাপাশি প্রয়োজন বিচার বিভাগের কঠোর অবস্থান এবং তাৎক্ষণিক কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা।

সামাজিক যোগাযোগ সাইট, ইউটিউব প্রভৃতিতে অসুস্থ সংস্কৃতি চর্চা, নারীদের ভোগ্যপণ্য হিসেবে উপস্থাপন কিংবা পর্নোগ্রাফির সাইটে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার বন্ধ করা। এছাড়া পারিবারিক ভাবে কিছু সচেতনতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে শিশুকে ধর্ষণ থেকে রক্ষা করা যেতে পারে। যেমন: শিশুকে ব্যাড টাচ এবং গুড টাচ এর পার্থক্য বোঝানো, যাতে তারা আচরণ শনাক্ত করে বাবা মাকে জানাতে পারে, অপরিচিত কোনো ব্যক্তির নিকট থেকে খাবার গ্রহণে নিষেধ ও সাবধান করা, পরিচিত বা নিকট আত্মীয় যার কোলে যেতে শিশু ভয় পায় তার কাছে জোর করে না দেওয়া, নির্যাতনের শিকার হলে ভুলেও এর জন্য শিশুকে দায়ী না করা, বরং তাকে মানসিকভাবে সমর্থন প্রদান এবং তার সাথে সচেতনতামূলক আলোচনা করা, শিশুকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া, একা একা বাইরে যেতে না দেওয়া বা বাসায় একা রেখে না যাওয়া প্রভৃতি। সর্বোপরি, সুস্থ সংস্কৃতি ও বিনোদনের চর্চা, নৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অনুশীলন, বিশ্ব সংস্কৃতির নেতিবাচক উপাদান নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রের কঠোর অবস্থান এবং রাষ্ট্রের এরূপ কাজে সকলের সম্মিলিত সহযোগিতা ও অবস্থানের মাধ্যমে আমরা শিশু ধর্ষণ রোধ করতে পারি। ফলে বাঁচবে শিশু, গড়বে দেশ।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

আমরা কি পারি না শিশুদের নিরাপদ জীবন দিতে? উম্মে সুমাইয়া ইয়াসমিন মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর