৩১ বছরেও নিরসন হয়নি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বৈষম্য
১৮ অক্টোবর ২০২৩ ১২:৩৫
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ইংরেজিতে National University বলা হয়। যদিও এটিকে অনেকেই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে মানতে নারাজ। এমনকি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীই জানেন না এটি একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। আমি যে কারণে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বলছি সেটি হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় এটির আচার্যও হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। তাছাড়া রাষ্ট্রপতি নিজেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে থাকেন। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে পার্থক্য হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট ক্যাম্পাস নেই কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে। ১৯৯২ সালে ২১ই অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এই বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকায় গাজীপুর জেলার বোর্ড বাজারে ১১.৩৯ একর জমির উপর এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। আমরা যদি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিবেচনা করে বলি তাহলে এটি বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। একই ভাবে বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে শিক্ষার্থী সংখ্যা তুলনা করলেও এটি প্রথম। একটি সমীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৮ লক্ষ।সারা বাংলাদেশে এটির ক্যাম্পাস সংখ্যা প্রায় ২২’শ এর অধিক।
প্রতিষ্ঠিত হওয়া থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে ত্রিশ বছর শেষ করে একত্রিশ বছরে পদার্পণ করবে আগামী ২১ ই অক্টোবর। যা আমাদের জন্য খুবই আনন্দের বিষয়। তাই এই বিশেষ দিনটিকে সামনে রেখে আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সকল ক্ষেত্রে অবহেলিত হওয়া নিয়ে কিছু কথা বলবো। প্রতিষ্ঠিত হওয়া থেকে ত্রিশ বছর অতিক্রম করার পরেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক গুলো প্রতিবন্ধকতা এখনো থেকেই গিয়েছে । যে প্রতিবন্ধকতা গুলোর বলি হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। নীতি নির্ধারকরা না এই সমস্যা গুলোর দীর্ঘমেয়াদী সমাধান দিচ্ছেন না চোখে পড়ার মতো সমাধানের চেষ্টা করেছেন। এই প্রতিবন্ধকতা গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সেশনজট, অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাব,সময় উপযোগী শিক্ষার অভাব এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত না করা ইত্যাদি। তাছাড়াও মানসম্মত শিক্ষক এবং কারিগরি শিক্ষার অভাব তো আছেই। ছোট্ট একটি অভিজ্ঞতা বলি। আমি ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী হলেও আমাদের পুরো অনার্সে নেই কোন ইংরেজি ব্যাকরণ বিষয়ক কোর্স। এতে করে আমাদের ব্যাকরণ সমস্যা থেকেই যায়। এরকম আরো অনেক সমস্যা আছে যেগুলো আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সমাধান দেওয়ার চেষ্টা নাই বললেই চলে।
প্রায় ক্যাম্পাসে নেই কোন ক্যারিয়ার ডেভলপ করার মতো ক্লাব। নেই কোনো প্রেজেন্টেশন প্রোগ্ৰাম কিংবা কমিউনিকেশন ডেভলপ করার ব্যাবস্থা। নেই কোনো এক্সট্রা কারিকুলাম শেখার ব্যবস্থা । একটি প্রবাদ মনে পড়ছে খুব,গ্ৰহন্থগত বিদ্যা পরহস্তে ধন,নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন। অর্থাৎ আমরা এখানে বইয়ের সীমাবদ্ধ পড়া ছাড়া আর কিছুই শিখতে পারছি না।যেখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চার বছরে ১৬ টি প্রেজেন্টেশন প্রোগ্ৰাম করে থাকে। সেখানে আমাদের অনেক শিক্ষার্থী জানেই না প্রেজেন্টেশন নামের কোন প্রোগ্ৰাম আছে। এতে করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভালো বিষয়ে পড়াশোনা করলেও পড়ালেখার বাহিরে আর কিছুই শিখতে পারছেনা। যেখানে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলো ইতিমধ্যেই উপরে উল্লেখিত সমস্যা গুলোর সমাধান করে শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে শিক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এখনো আমাদের একটু সুন্দর শিক্ষা পদ্ধতি দিতেই ব্যর্থ। এই ব্যার্থতার জন্য যে শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তারাই দায়ী এমনটা নয় সমানভাবে দায়ী আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থীই দরিদ্র পরিবার থেকে আসা। তাদের পারিবারিক মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার কম। আর ১০ থেকে ৪০ হাজার টাকা মাসিক আয় এমন পরিবারের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪৯ শতাংশ। সে হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থীর পরিবারিক মাসিক আয়ের পরিমাণ ৪০ হাজার টাকার কম। ৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর পরিবারের আয় ৪১ থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর ৬০ হাজার টাকার বেশি আয় রয়েছে এমন পরিবারের শিক্ষার্থী রয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজের গতিতে চলছে । শিক্ষার্থীদের যত সমস্যাই হোক না কেন এগুলো তাদের দেখার বিষয় নয়। কেননা এসকল হর্তাকর্তার ছেলেমেয়েরা তো আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে না। ইউজিসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর পেছনে বছরে মাথাপিছু ব্যয় ২ লাখ ১২ হাজার টাকা ,জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী প্রতি ব্যয় ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী প্রতি ব্যয় করেছে ৭৮ হাজার ৯৬২ টাকা। সেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রতি ব্যায় করা হয় মাত্র ১ হাজার ১৫১ টাকা শুধু। বাজেটেই নয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অবহেলিত চাকরির বাজারেও। কারণ সকলেই ভাবেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মানেই হলো মেধাবী নয়। পরীক্ষকরা সিভিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেখে শুরুতেই ধারণা করেন, এই প্রার্থী ততটা অভিজ্ঞ নয়। অথচ সর্বশেষ ৪১ তম বিসিএসে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাডার সংখ্যা বিবেচনায় চতুর্থ স্থান অর্জন করেছে।
প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী অনার্স শেষ করে বের হলেও যোগ্যতা এবং গুণগত দক্ষতার অভাবে ভালো কোন চাকরি পাচ্ছেন না।এতে বাড়ছে দেশের বেকার সংখ্যা, বাড়ছে দেশে শিক্ষাথীদের আত্মহত্যার প্রবণতা। তবে ইতিমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অনেক কিছুই পরিবর্তনের পদেক্ষপ নিচ্ছে যেটি আমাদের জন্য ইতিবাচক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এগিয়ে আসতে হবে।তবেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো কিছু করা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করছি।
লেখক: শিক্ষার্থী; সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম
সারাবাংলা/এসবিডিই
একত্রিশ বছরে এসেও নিরসন হয়নি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বৈষম্য মুক্তমত মো. রাকিব