আজ মহাষষ্ঠী, শারদীয় দুর্গাপূজার শুরু
২০ অক্টোবর ২০২৩ ১৯:২৪
আজ ষষ্ঠী। দেবী দুর্গাকে বোধনের দিন আজ। এই বোধন আবার অকাল বোধন হিসেবে খ্যাত। এ দিনই স্বর্গ থেকে মর্ত্যে পদার্পণ করেন দেবী দুর্গা। সঙ্গে থাকেন তার চার সন্তান লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী। বোধনের পর প্রতিমার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়। অকালবোধন হল শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রারম্ভিক অনুষ্ঠান। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথি অথবা শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে দেবীপার্বতীর দুর্গা রূপের পূজারম্ভের প্রাক্কালে এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। দেবীপক্ষে ষষ্ঠীতে দুর্গাকে বোধন করে পূজা করেন রাম। বোধন এই শব্দটির অর্থ জাগ্রত করা। মর্ত্যে দেবী দুর্গার আবাহনের জন্য বোধনের রীতি প্রচলিত রয়েছে। এ দিন কল্পারম্ভ দিয়ে শুরু হয় দেবী দুর্গার বোধন। ষষ্ঠীর সকালেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। তার পর দশভূজার সামনে প্রার্থনা করা হয় যে, ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত গোটা পূজা পর্বে যেন কোনও বিঘ্ন না ঘটে। এর পর ঘট ও জলে পূর্ণ একটি তামার পাত্র মণ্ডপের কোণে স্থাপন করা হয়। এই স্থানেই দুর্গা ও চণ্ডীর পূজা করা হয়। এর পর হয়, দুর্গার বোধন। তার পর অধিবাস, আমন্ত্রণের পর্ব। বোধনের পর বিল্ব শাখার দেবীকে আহ্বান জানানো হয়। অশুভ শক্তি দূরের জন্য ঘটের চারপাশে তীরকাঠিতে সুতো জড়িয়ে আমন্ত্রণ প্রক্রিয়া শুর হয়। এ ভাবেই শেষ হয় মহাষষ্ঠীর আচার। মহাশক্তির মহাপূজার সূচনা হয় বোধনের মধ্যে দিয়ে৷ দেবীপক্ষের শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে দেবীকে উদবোধিত করা হয়৷ কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এর দুর্গাপূজার বিবরণের থেকে পৌরাণিক দুর্গাপূজার বিবরণ কিছুটা আলাদা। কালিকাপুরাণ অনুসারে, রাবণবধে রামচন্দ্রকে সাহায্য করার জন্য রাত্রিকালে দেবীর বোধন করেছিলেন ব্রহ্মা।
স্কন্দ পুরাণে উল্লেখ রয়েছে, দেবী দুর্গা হলেন শক্তির আধার। দুর্গা ও শক্তি পূজার মধ্যে বিভেদ নেই। কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ মতে, ক্রেতাযুগে অযোধ্যার রাজা দশরথের জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রীরাম রাবণকে বধ করার পর সীতাকে উদ্ধারের পর দেবীদুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তি গড়ে দেবীর অকালবোধন করেছিলেন। সেই থেকেই শরত্কাল দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন। শরত্কালে এই বিশেষ পূজা করা হয় বলে একে শারদীয়া পূজাও বলা হয়ে থাকে। এই দুই পুরাণেই উল্লেখ রয়েছে, শ্রীরামকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মা দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন।কৃত্তিবাসি রামায়ণে উল্লেখ আছে, রাবণ ছিলেন অত্যন্ত শিবভক্ত। যে কোনও বিপদে পার্বতী তাকে রক্ষা করতেন। তাই ব্রহ্মা রামকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, শিবপত্নী পার্বতীকে পূজা করে তুষ্ট করতে। সীতা উদ্ধারের জন্য রাবণ-বধ রামের পক্ষে সহজসাধ্য করতেই সব আয়োজন করেছিলেন। ব্রহ্মার পরামর্শে শ্রীরাম শরৎকালে পার্বতীর দুর্গতিনাশিনী রূপের বোধন, চণ্ডীপাঠ ও মহাপূজার আয়োজন করেছিলেন। আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিন রাম কল্পারম্ভ করেছিলেন। সন্ধ্যেয় বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস করেছিলেন দশরথ পুত্র। মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী ও সন্ধিপূজার পরেও দেবী দুর্গার আবির্ভাব না ঘটায়, রাম মোট ১০৮টি নীল পদ্ম দিয়ে মহানবমী পূজার পরিকল্পনা করেন। ১০৮টি পদ্ম জোগাড় করার জন্য সাহায্য করেছিলেন স্বয়ং হনুমানজি। এদিকে মহামায়া রামকে পরীক্ষা করার জন্য একটি পদ্ম লুকিয়ে রেখেছিলেন। ১০৮টি পদ্মের মধ্যে একটি পদ্ম না পেয়ে পদ্মের বদলে রামচন্দ্র নিজের একটি চোখ উপড়ে মহামায়ার সামনে নিবেদন করার উদ্যোগ নেন। শ্রীরামের এমন প্রচেষ্টায় দেবী পার্বতী আবির্ভূত হয়ে রামকে কাঙ্ক্ষিত বর দেন। পুরাণ মতে, সূর্যের উত্তরায়ন হচ্ছে দেবতাদের দিন। উত্তরায়নের অর্থ বিষুবরেখা থেকে সূর্যের ক্রমশ উত্তরে গমন। সূর্যের এই গমনে সময় লাগে ছয় মাস। এই ছয় মাস দেবতাদের একদিনের সমান। দিনের বেলায় জাগ্রত থাকেন দেবতারা। তাই দিনেই দেবতাদের পূজা করা শাস্ত্রের বিধান। অন্যদিকে সূর্যের দক্ষিণায়ন হল দেবতাদের রাত। দক্ষিণায়ন অর্থ বিষুবরেখা থেকে সূর্যের ক্রমশ দক্ষিণে গমন। সূর্যের এই গমনকালের ব্যপ্তিও ছয় মাস। দক্ষিণায়নের ছয় মাস দেবতাদের একরাতের সমান। স্বাভাবিক ভাবেই এই সময় দেবতারা ঘুমোন। সেই কারণেই রাতে পূজা করার বিধান নেই শাস্ত্রে। শরৎকাল দক্ষিণায়ণের সময়, দেবতাদের রাত্রিকাল। তাই শরৎকাল পূজার্চনার জন্য় উপযুক্ত সময় নয় – ‘অকাল’।
অকালে দেবতার পূজা করতে হলে তাকে জাগরিত করতে হয়। জাগরনের এই প্রক্রিয়াটিই হল ‘বোধন’। সেই কারণে দুর্গাপূজা শুরু হয় দেবীর অকাল বোধন করে।এই অকালে শ্রীরামচন্দ্র অশুভ শক্তির প্রতীক রাবণ রাজাকে পরাজিত করতে শক্তি সঞ্চারে মায়ের পূজা করেছিলেন। তাই এই পূজাকে অকাল বোধন বলা হয়। আবার উক্ত সময়টি শরৎকাল হওয়ায় একে শারদীয়া দুর্গা পূজা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু ঘুমন্ত দেবীকে জাগ্রত করার জন্য স্বয়ং ব্রহ্মাকে দেবীস্তুতি করতে হয়েছিল৷ ‘হে দেবী রাবণবধের জন্য রামকে অনুগ্রহ করুন ও জাগ্রতা হোন’৷ – ব্রহ্মার এই আবেদনে দেবী বেল গাছের একটি পাতায় কুমারী কন্যার রূপে আবির্ভূতা হন৷ দেবীর সেই আবির্ভাবকে স্মরণ করে আজও দেবীপূজার প্রাক্কালে তাকে জাগ্রত করা হয়৷ বিল্ববৃক্ষে তাকে উদবোধিত করার যে অনুষ্ঠান তাই বোধন৷ ষষ্ঠীতিথির সন্ধ্যায় প্রথমে দেবীর বোধন, পরে অধিবাস ও আমন্ত্রণ করা হয়৷ শৈলশিখর কৈলাস থেকে তিনি আসছেন৷ তাই তাকে যথাযথ আমন্ত্রণ করে এই দিনের অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়৷
লেখক: ছড়াকার ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এজেডএস