নিরাপদ সড়ক দিবস ও কিছু কথা
২০ অক্টোবর ২০২৩ ২০:০৭
২০২০ সালে গোটা বিশ্বের মত বাংলাদেশেও আঘাত আনে এই শতকের সবচেয়ে ভয়ানক মহামারী করোনা ভাইরাস। যার প্রভাবে পুরো বিশ্ব ব্যবস্থা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। নানান জল্পনা কল্পনা অবসান ঘটিয়ে অসংখ্য মানুষের প্রাণ নিয়ে করোনো প্রায় বিদায় নিলো। আমরা মুক্তি পেলাম এই ভয়ানক মহামারী থেকে। কিন্তু দেশের যে সড়ক দুর্ঘটনার মহামারী চলছে সেটি থামবে কবে? আমরা একটু লক্ষ্য করলে দেখবো করোনা আসার পর থেকে মৃত্যুর ভয়কে রুখতে প্রতিনিয়ত মাস্ক পরছে সবাই, হ্যান্ড স্যানিটাইজ করছে তাছাড়া সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে কতইনা অভিযান। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার মহামারি রোধে আমার কতটুকু সচেতন কিংবা সরকারি উদ্যোগ কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে?
২০২১ সালে মাঝামাঝিতে একটি প্রতিবেদন দেখতে পেলাম, সেই সময় করোনায় মৃত্যু সংখ্যা ছিলো প্রায় ৬ হাজারের মত। আর ঠিক তখনি আরেকটি প্রতিবেদনে লক্ষ্য করলাম ওই বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৬ হাজারের চেয়ে বেশি ছাড়িয়েছে। আমরা যদি গড় হিসাব করি তাহলে দেখা যায় প্রতিনিয়ত করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর চেয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার অনেক অনেক বেশী ছিলো তখন। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? তাহলে কি আমরা করোনাকে যেমন ভয় পেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পেরেছি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পারিনি?
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত আট বছরের মধ্যে বিদায়ী ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা এবং হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। বছরটিতে ৬ হাজার ৭৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জন নিহত ও ১২ হাজার ৩৫৬ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া একই সময়ে রেলপথে ৬০৬ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫৫০ জন। আহত হয়েছেন ২০১ জন। নৌপথে ২৬২ দুর্ঘটনায় ৩৫৭ জন নিহত, ৩৫৭ জন আহত এবং ৭৪৩ জন নিখোঁজ হয়েছেন। সব মিলিয়ে সড়ক, রেল ও নৌপথে বিদায়ি বছরে ৭৬১৭টি দুর্ঘটনায় ১০ হাজার ৮৫৮ জন নিহত এবং ১২ হাজার ৮৭৫ জন আহত হয়েছেন। দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ২৮.৫৯ শতাংশ আক্রান্ত হয় মোটরসাইকেল। ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও লরিতে দুর্ঘটনার হার ২৪.৫ শতাংশ। সংগঠনটি জানিয়েছে, ২০২২ সালের ১৫ জুলাই সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। ওইদিন সড়কে ৩৭টি দুর্ঘটনায় ৪৩ জন নিহত হন। আহত হন ৯৭ জন। একদিনেই সড়কে সর্বোচ্চ ৪৪ জন মারা গেছেন ২৯ জুলাই। তবে সবচেয়ে কম ৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬ সেপ্টেম্বর। ওইদিন ১২ জন নিহত ও ১৩ জন আহত হন।
এছাড়া নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব বলছে ২০২১ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৩৭১টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬৮ জন। ২০২১ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৩৭১টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬৮ জন। তাদের হিসাবে প্রতিদিন সড়কে ১৭ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৮৫ দিন গণপরিবহন বন্ধ থাকার বিষয়টি হিসাবে নেওয়া হলে গড়ে দৈনিক ২২ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে দেশে চার হাজার ৭৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৪৩১ জন নিহত এবং ৭ হাজার ৩৭৯ জন আহত হয়েছে। নিহত ৫ হাজার ৪৩১ জনের মধ্যে ৮৭১ জন নারী ও ৬৪৯ জন শিশু। এই বছর ১ হাজার ৩৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৪৬৩ জন নিহত হয়েছেন। যা মোট নিহতের ২৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ২৯ দশমিক ১০ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৫১২ জন পথচারী নিহত হয়েছে। যা মোট নিহতের ২৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৬৮৩ জন। অর্থাৎ মোট নিহতের ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ। তাছাড়া নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সংগঠনের করা পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনাই ঘটেছে ৪ হাজার ৭০২টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫ হাজার ২২৭ জন ও আহত ৬ হাজার ৯৫৩ জন। ২০১৮ সালে ৩ হাজার ১০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৩৯ জন নিহত ও ৭ হাজার ৪২৫ জন আহত হয়েছিল। আর ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৩৪৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৬৪৫ জন নিহত ও ৭ হাজার ৯০৮ জন আহত হয়েছিল।দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারি পরিসংখ্যান বলছে গত বছরে মোট দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর ২৫ শতাংশই ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। ১৮ শতাংশ দুর্ঘটনা চট্টগ্রামে।
সংস্থাটির তথ্য মতে, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ২৭ দশমিক ১৪ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ২২ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে সাড়ে ১৩ শতাংশ আর মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়েছে। প্রাণহানি বেড়েছে ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। আগের বছরে তুলনায় ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের অধিকাংশের বয়স ১৪ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩৫ লাখের বেশি। পাঁচ বছর আগে দেশে মোটরসাইকেল ছিল ৮ লাখের কাছাকাছি।
শহরে মোটরসাইকেলের চালকদের হেলমেট পরার সুঅভ্যাস গড়ে ওঠা এবং সচেতনতা বাড়লেও গ্রামে জেলা পর্যায়ে হেলমেট না পরার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এছাড়া কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রশাসনের সামনে দিয়ে লাইসেন্সবিহীন মোটরসাইকেল ও অপ্রাপ্তবয়স্করা মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। করোনার সংক্রমণের কারণে ২০২০ সালে দুই মাস সড়কে পরিবহন চলাচল বন্ধ থাকার পরেও দুর্ঘটনা ২০১৯ সালের তুলনায় বেড়েছে।
সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো এইসব মৃত্যুর বেশীরভাগ হলো শিক্ষার্থী। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে নিহতদের মধ্যে ৮০৩ জন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী। ওই বছরের মে মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ৮৪ জন শিক্ষার্থী নিহত হন। ফেব্রুয়ারি মাসে নিহত হন ৮৩ শিক্ষার্থী। সড়ক দুর্ঘটনায় সবচেয়ে কম ৫৩ জন শিক্ষার্থী নিহত হন জুন মাসে। শিক্ষার্থীদের বড় অংশ নিহত হয়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো ও ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘সাধারণ সময়ের চেয়ে ঈদের ছুটিতে সড়ক দুর্ঘটনা ২ থেকে ২.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।’ সড়ক দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে বর্ষা মৌসুমে। বিশেষ করে জুলাই ও আগস্টে। তাই তারা এ দুটি মাসকে ‘ডেডলিয়েস্ট মান্থ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলের চেয়ে উক্ত দুই মাসে শতকরা ৩০ ভাগ দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হিসিবে গবেষকরা বলেছেন, বর্ষা মৌসুমে রাস্তা-ঘাট ভেজা ও পিচ্ছিল থাকে। গাড়ির ব্রেক কম ধরে এবং বৃষ্টিতে গাড়ির উইন্ডশিল্ড ঘোলা হয়ে যাওয়ায় চালকদের দেখতে অসুবিধা হয়। এ সময়ে চালকদের উচিত গাড়ির স্বাভাবিক গতি অর্ধেকে নামিয়ে গাড়ি চালানো। গাড়ি চালকদের এ ব্যাপারে সতর্ক করে গাইড লাইন দেয়া বা তারা নিজেরা কতটা সচেতন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
সাড়ে চার বছর আগে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছিল। তারা রাজপথে থাকা অবস্থায় দেখিয়ে দিয়েছিলো আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা কেমন হতে পারে। সরকারের নানা প্রতিশ্রুতির পর তারা রাজপথ ছেড়ে যায়। কিন্তু সড়কে বিশৃঙ্খলা বন্ধ হয়নি। দুই বছর আগে ১৮ নভেম্বর বাসে অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থীরা। এই বিক্ষোভের মধ্যেই ২৪ নভেম্বর গাড়িচাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যুর পর তা রূপ নেয় নিরাপদ সড়কের ৯ দফা দাবির আন্দোলনে। এবার টানা ২০ দিনের বেশি আন্দোলন করে ঘরে ফিরেছে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু দিন শেষে মৃত্যুপুরি সড়কের কি ফিরেছে তার পরিবর্তিত রূপে!
বেশির ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে বড় শহর ও মহাসড়কগুলোতে। অবৈধ যানবাহন—ভ্যান, রিকশা, নছিমন, অটোরিকশা এ জন্য দায়ী বলে প্রতীয়মান হয়। আইনকে অমান্য করে ধীরগতির বাহন মহাসড়কে এখনো চলাচল করে, যা দূরপাল্লার বড় গাড়িগুলোর চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। স্থানীয় প্রশাসন ও হাইওয়ে পুলিশকে এই ব্যাপারে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা নিতে দেখা যায় না। অনেকটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করে তারা চলাচল করে। পথচারীরা গাড়ি চাপায়, পেছন দিক থেকে ধাক্কাসহ বিভিন্নভাবে দুর্ঘটনায় পড়েছে। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ধারণা না থাকা, রাস্তা চলাচল ও পারাপারে মোবাইল ব্যবহার, জেব্রা ক্রসিং, আন্ডারপাস, পদচারী-সেতু ব্যবহার না করা, যত্রতত্র পারাপারের ফলে পথচারীরা দুর্ঘটনায় পড়ছে।
সম্প্রতি টেলিভিশনে একজন প্রতিবেদক অসংখ্য ড্রাইভারকে প্রশ্ন করে জেব্রা ক্রসিং মানে কি। একজন ড্রাইভারও এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে নি। তাহলে দেখা যায় গাড়ি চালকরা কী রকম প্রশিক্ষণ নিয়ে রাস্তায় নামছে। তাছাড়া রয়েছে অশিক্ষিত ও অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অসচেতনতা, অনিয়ন্ত্রিত গতি, রাস্তা নির্মাণে ত্রুটি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করা এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ।
গত বছর যত দুর্ঘটনা, তার ৬২ শতাংশের কারণ যানবাহনের বেপরোয়া গতি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। এই ক্ষেত্রে সব চেয়ে বড় অব্যবস্থাপনা হলো বেশীরভাগ চালক মালিক পক্ষ থেকে দিন প্রতি নির্ধারিত হয় না। বরং মালিক পক্ষ নির্ধারণ করে দেয় যত টিপ নিতে পারবে তত টাকা। অর্থাৎ টিপ ভিত্তিক মজুরি দেওয়া হয়। ফলস্রুতিতে চালকদের মাঝে অপ্রতিরোধ্য একটি ভাব দেখা যায়। যার কারনে প্রতিনিয়ত বেপরোয়া গতি কারনে ঘটে দুর্ঘটনা। এ ছাড়া চালকদের অদক্ষতা, মহাসড়কে স্বল্প গতির যানবাহনের চলাচল, ফুটপাত হকারের দখলে থাকা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সরকারি সংস্থা বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি, গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসচেতনতার কারণে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। তাছাড়া চালকদের মাঝে প্রতিনিয়ত দেখা যায় ওভারটেকিং প্রতিযোগীতা। যার ফলে দুর্ঘটনার শিকার হতে হয় সাধারণ মানুষকে।
সড়ক দুর্ঘটনা শুধু যে মানুষের মৃত্যু ঘটছে তা নয় বরং প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণ মানব সম্পদ নষ্ট করে। গত বছর ক্ষতি হওয়া মানবসম্পদের আর্থিক মূল্য ৯ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। দেখানো হয়েছে, দুর্ঘটনায় আহত-নিহতদের শতকরা ৭৩ ভাগ উৎপাদনশীল খাতের সাথে জড়িত। সরকারি হিসাবে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ থেকে ২ শতাংশ ক্ষতি হয়।
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন যেভাবে কর্মক্ষম মানুষের মৃত্যু হচ্ছে এবং এটি যে একটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে, এ নিয়ে সরকারের কোন অবস্থান আছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে না। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার দুর্ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখছে। আমরা প্রতিনিয়ত দেখি কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর গাড়ির ফিটনেস নেই কিংবা গাড়ির কাগজপত্র নেই অথবা চালকের লাইসেন্স নেই। আবার অনেক সময় দেখা যায় হেল্পার গাড়ি চালাচ্ছে। দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটি হতে শুনি। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রে এর পরিপূর্ণ রিপোর্ট পেয়ে থাকি। কিন্তু দুর্ঘটনার কারণ কি এবং কিভাবে কমানো যায়, এ ব্যাপারে কর্তপক্ষ নিষ্ক্রিয়। অথচ সর্বক্ষেত্রেই জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। সড়ক দুর্ঘটনার হার যেখানে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, একটি অন্যতম প্রধান সমস্যায় পরিণত হয়েছে এবং উৎপাদনশীল খাতে নিয়োজিত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, বিষয়টি সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। ২০১১ সালে মস্কোতে জাতিসংঘ সদস্য দেশগুলোয় ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় কমিয়ে আনার জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশও এর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ কেবল সংহতি প্রকাশ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। উল্লেখিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা বা কর্মসূচি নেয়নি। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে এ ধরনের কর্মসূচি প্রণয়নে সরকারের উদাসীনতা কোনভাবেই কাম্য নয়।
বর্তমান সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা মহামারি আকার ধারন করছে। সড়ক দুর্ঘটনার সার্বিক চিত্রকে স্মরণ করতে ও মানুষে মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে প্রতিবছর ২২ অক্টোবর নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করা হয়। কিন্তু আমরা কতটাই বা সচেতন হতে পারি। কিংবা মানুষকে সচেতন করতে সরকারের দিবস কেন্দ্রিক প্রচেষ্টাও কতটুকু!শুধু দিবস পালন নয়। এর তাৎপর্য সবার সামনে ব্যাখ্যা করতে হবে। এটি করোনার চেয়েও ভয়াবহ মহামারি সেটি সবার সামনে উপস্থাপন করতে হবে। তা না হলে দিবসের সকল চেষ্টাই বৃথা যাবে।
তাই এখনি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহন না করলে সমস্যা টি আরো গুরুতর হতে পারে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রথমত আমাদের পরিবহণ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে লাইসেন্স বিহীন গাড়ি যাতে কেউ রাস্তা নামাতে না পারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সাথে চালকের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সাথে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত চালদের সরকারি উদ্যোগে ড্রাইভিং লাইসেন্সের ব্যবস্থা করতে। বর্তমান সময় লাইসেন্স পাওয়া নিয়ে একটি জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। অধিকাংশ চালকের মত ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে তাদের অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয় এবং নির্ধারিত অর্থের চেয়েও বেশী অর্থ ব্যায় করতে হয়। তাই অনেকে লাইসেন্স করতে ভয় পায়। তাই তারা যাতে সুষ্ঠ ও সুন্দর পরিবেশ লাইসেন্স পেতে পারে তার সুব্যবস্থা করতে হবে। লাইসেন্স প্রদানের অবশ্যই চালকের ডোপ টেস্ট করতে হবে। যাতে করে কোনো প্রকার মাদকাসক্ত ব্যক্তি লাইসেন্স গ্রহণ না করতে পারে। তাছাড়া পরিবহণ বেঁধে রাস্তা পরিধি বৃদ্ধি করতে হবে। শহরের টাউন সার্ভিস খ্যত বাস গুলো যাত্রী উঠানোর নাম করে যত্রতত্র পার্কিং করে। যা যোগাযোগ ব্যবস্থায় নিঘ্নয়ের সৃষ্টি করে। তাই তাদের পার্কিংয়ের একটি নির্দিষ্ট স্থান করে দিতে হবে। ফুটপাত হকারের দখলে থাকা মুক্ত রাখতে হবে পাশাপাশি ট্রাফিক ব্যবস্থা কে আরো সমৃদ্ধ করতে হবে,সেই সাথে আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থা করতে হবে। মহাসড়কে স্থান বেঁধে যে নিদিষ্ট গতি সীমা দেয়া হয় তা যথাযথ ভাবে মানা হচ্ছে কিনা তার দিকে লক্ষ রাখতে হবে। সর্বোপরি সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে সচেতনতার বিকল্প নেই। তাই এই ব্যাপারে সবাই সর্বাত্মক সচেতন করতে হবে। সে জন্য সকল শ্রেণি পাঠ্য বিষয়গুলো স্কুলের পাঠ্যক্রমে সড়ক দুর্ঘটনার কারন ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা পাশাপাশি মিডিয়ায়কে এই বিষয়টি নিয়ে সর্বোচ্চ সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একদিন বাংলাদেশ হবে সড়ক দুর্ঘটনা মুক্ত বাংলাদেশ।
লেখক: শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ
সারাবাংলা/এজেডএস