মৃত্যুপুরী ফিলিস্তিন-কার দায় কতটুকু?
২২ অক্টোবর ২০২৩ ১৫:৪৮
মধ্যপ্রাচ্য পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত স্থানগুলোর একটি। বিশ শতকের শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এ অঞ্চলটির আবির্ভাব। তারপর থেকে এ অঞ্চলটি পশ্চিমা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে কিংবা তাদের বিপরীতে নিজেদের শক্ত অবস্থানের জানান দিতে থাকে। কিন্তু আবির্ভাবের পর থেকেই এ অঞ্চলটিকে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় যা রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘মধ্যপ্রাচ্য সংকট’ হিসেবে পরিচিত এবং এ সংকট আজও চলমান। মধ্যপ্রাচ্য সংকট বলতে মূলত ফিলিস্তিন বা মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে ইহুদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের দ্বন্দ্বকেই বুঝানো হয়; যে দ্বন্দের অন্তিম পর্ব ঠিক কবে নাগাদ বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করবে তা আজও অনিশ্চিত।
মধ্যপ্রাচ্য মূলত একটি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। এ এলাকায় হুট করে একটি ইহুদী রাষ্ট্রের উত্থানই মধ্যপ্রাচ্য সংকটের জন্ম দিয়েছে যে সংকটের সবচেয়ে বড় শিকার ফিলিস্তিন। ১৫১৭-১৯১৭ সাল অবদি ফিলিস্তিন অটোমান সাম্রাজ্যের আওতাধীন একটি রাষ্ট্র হিসেবে শাসিত হয়ে আসছিল। পরবর্তীতে ১৯১৮ সালে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয় তখন সমগ্র বিশ্বের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এক ভিন্ন আকার ধারণ করে। অটোমান সাম্রাজ্য এ যুদ্ধের প্রভাবে দুর্বল হয়ে পড়লে, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ঐক্যও হুমকির মুখে পড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তের পর ব্রিটিশরা ফিলিস্তিনকে শাসন করতে শুরু করে। ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনের শাসনভার গ্রহণের পরপরই সে অঞ্চলটিতে ইহুদীদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধানের পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে ১৯১৭ সালে তত্কালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ.জে. বেলফো জায়ানিস্ট বা ইহুদী আন্দোলনের নেতা লর্ড রথসচাইল্ডকে একটি চিঠি দেন। ‘৬৭ শব্দের সেই চিঠিটিই ছিল ইহুদী রাষ্ট্র গঠনের প্রথম পদক্ষেপ। যদিও ফিলিস্তিন সে সময় অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ এবং সংখ্যালঘু ইহুদি জনগোষ্ঠীর আবাস। ওই এলাকার জনসংখ্যার দিক থেকে যা শতকরা ৯ শতাংশ। ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল ইহুদিদের জন্য একটি ‘জাতীয় আবাস’ তৈরি করা। বেলফোর ঘোষনার পরপরই ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদি সম্প্রদায় ফিলিস্তিনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। যদিও অনেক আগে থেকেই ইহুদিরা ফিলিস্তিনে নিজেদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের কথা ভেবে আসছিল। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় বেলফোর চুক্তির অনেক থেকেই অর্থাৎ ১৮৮২-১৯০৩ সালের মধ্যে প্রায় ৩৫ হাজার ইহুদি ফিলিস্থিনে স্থানান্তরিত হয়ে বসবাস করা শুরু করে।
১৯০৪-১৯১৪ সালের মধ্যে আরো ৪০ হাজার ইহুদী ম্যপ্রাচ্যের এ অঞ্চলটিতে বসতি স্থাপন করে। পরবর্তীতে ইহুদীদের সিয়োনবাদ বা জায়নবাদী আন্দোলন গড়ে উঠলে তাদের চোখ পড়ে মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব ভূখন্ডে। ১৯৩৩ সালে জার্মানির এডলফ হিটলার ইহুদী নিধন অভিযান শুরু করলে, প্রাণ ভয়ে আরো বহুসংখ্যক ইহুদি এ অঞ্চলটিতে পালিয়ে আসে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯২২-১৯৩৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এ অঞ্চলটিতে যেখানে ইহুদি ছিল শতকরা মাত্র ৯ শতাংশ, সেখানে এ অল্প কয়েকবছরে ইহুদি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ২৭ শতাংশে উন্নিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইহুদিদের এ অবৈধ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আরব রাষ্ট্রগুলো আওয়াজ তুললে সংগঠিত হয় ‘আরব-বিদ্রোহ’। এ বিদ্রোহে প্রায় ৫ হাজার আরব প্রাণ হারিয়েছিল। এ বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার নিজেদের সুর পাল্টাতে থাকে। সরকার বুঝতে পারে যে, এতকিছুর পরও যদি ইসরায়েলের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাবটি গৃহীত হয় এবং সে অঞ্চলটিতে আরো ইহুদি স্থানান্তরিত হয় তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে তাদের আরো বেশ কিছু দ্বন্দের সৃষ্টি হতে পারে, যা নিজেদের শাসনকেও হুমকির মুখে ফেলবে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের এমন আচরণে ইহুদিগণ তাদের শত্রু ভাবতে শুরু করে এবং আরব ও ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে এসব চাপ সামাল দিতে না পেরে ব্রিটিশ সরকারকে ১৯২২ সালে লীগ অব ন্যাশনস এর সভায় ফিলিস্তিনকে শাসন করার জন্য যে বৈধ ম্যান্ডেট প্রদান করা হয়েছিল, ব্রিটেন তা হতে নিজেদের সড়িয়ে আনে।
পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ এ রাষ্ট্রটির ভাগ্য নির্ধারনের দায়িত্ব নিলেও তেমন সুফল বয়ে আনতে পারেনি। জাতিসংঘ তার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ফিলিস্তিন রাষ্ট্রটিকে দুভাগে ভাগ করে। একভাগ ইহুদিদের এবং আরেক ভাগ আরবদের। নিয়ম অনুযায়ী ইহুদিরা ফিলিস্তিনের মোট ভূখন্ডের ১০ শতাংশ জমির মালিক হওয়ার দাবি রাখে, কিন্তু তাদের দেয়া হয়েছিল মোট জমির প্রায় অর্ধেক। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো সেদিন জাতিসংঘকে ব্যবহার করে ফিলিস্তিন এলাকায় অবশেষে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন করতে সক্ষম হয়। এর ঠিক এক বছর পর অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর পরই ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের মিসর, জর্ডান, লেবানন ও ইরানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এটিই ছিল আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রথম যুদ্ধ। সে সময় প্রায় সাত লক্ষ ফিলিস্তিনি শরনার্থীতে রূপান্তরিত হয়। পরবর্তীতে আরো দু-বার এ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। একটি ১৯৬৭ সালে এবং আরেকটি ১৯৭৩। দুটি যুদ্ধেই ইসরায়েল খুব সফলতার সাথে লাভবান হয়। ৬৭’র যুদ্ধে মিসরের সিনাই এবং সিরিয়ার গোলান উপত্যকা ইসরায়েলের দখলে আসে। পরবর্তীতে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে সিনাই উপত্যকা মিসর ফিরে পেলেও সিরিয়া কখনও তার গোলান উপত্যকা ফিরে পায়নি।
১৯৬৭ সালের সে যুদ্ধের মাধ্যমেই ইসরায়েল ফিলিস্তিন এলাকার গাজা ও পশ্চিম তীর দখল করে নিয়েছিল। মূলত এর পর থেকেই ফিলিস্তিন হয়ে যায় নিজ ভূখন্ডে পরবাসী। দখলদারিত্বের পর থেকেই ইসরায়েল নানানভাবে ফিলিস্তিনিদের উপর নিপীড়ন চালিয়ে আসছে। ফিলিস্তিনের জমি দখল,পবিত্র শহর জেরুজালাম এ প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা,হত্যা,বসতি উচ্ছেদ সহ নানান অপকর্ম চালিয়ে আসছে রাষ্ট্রটি। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে ফিলিস্তিন কখনই ইসরায়েলিদের আবাসভূমি ছিল না,ইসরায়েল মূলত অবৈধভাবেই এখানে নিজেদের আবাস গড়ে তুলেছে যা বর্তমান আধুনিক বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।
এখন স্বাভাবিভাকে এ প্রশ্ন উঠতেই পারে যে কেন এতগুলো বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট এর কোন নিরসন হচ্ছে না? এ প্রশ্নের উত্তর হিসেবে হয়তো অনেকগুলো বিষয়কেই উপস্থাপন করা যায়,তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ফিলিস্তিনের প্রধান দুই ক্ষমতাসীন দল হামাস ও ফাতাহ প্রসঙ্গ বর্তমান প্রেক্ষাপট ও সংঘাত বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
অনেকেই মনে করেন, জাতিসংঘের মোট অর্থের প্রায় ২২ শতাংশ অর্থের জোগানদাতা যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলপন্থী। এর প্রমাণ স্বরূপ অতীতের দুটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। ১৯৯৬ সালে ২০ জানুয়ারি ফিলিস্তিনের স্বায়ত্বশাসিত এলাকায় প্রথমবারের মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দশ লাখ ভোটারের মধ্যে প্রায় ৮৮ শতাংশ ভোট পেয়ে সে অঞ্চলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন ইয়াসির আরাফাত। পরবর্তীতে ক্যারিশম্যাটিক এ নেতার হাত ধরে অতীতের সংঘাত ভুলে ইসরায়েলের সাথে শান্তিচুক্তি ও কিছু কৌশল অবলম্বন করে ধীরে ধীরে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রটি গড়ে উঠছিল, যা ছিল একটি আশার আলো। কিন্তু হুট করেই ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রাবিনের মৃত্যু এ প্রক্রিয়াকে অনেকটা গতি দান করে। যদিও ফিলিস্তিনিরা অনেক আগে থেকেই রাবিনকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। কিন্তু রাবিন মূলত নিহত হয়েছিলেন নিজের জাতি ভাইয়ের দ্বারাই। অর্থাৎ একজন ইহুদিই তাকে হত্যা করেছিল। মধ্যপ্রাচ্যও এ ঘটনায় মর্মাহত হয়। কারণ এটি সকলের কাছেই একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা। সব কিছুই ঠিক ছিল, কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন যখন এ হত্যাকাণ্ডে ব্যাথিত হয়ে জেরুজালেমে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় শোকানুষ্ঠানে নিজে উপস্থিত হয়ে শোক প্রকাশ করেন তখন ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নতুন করে নানান প্রশ্নের জন্ম দেয়। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন সে ঘটনাটির মাধ্যমে ক্লিনটন প্রমাণ করে দিয়েছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইসরায়েল রাষ্ট্র কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস থেকে আরো জানা যায় ক্লিনটন ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের আরো অনেক প্রভাবশালী নেতা তিনটি প্লেনে করে জেরুজালেমে এসে সে রাষ্ট্রীয় শোকসভায় অংশ নিয়েছিল।
আরেকটি ঘটনা ২০১৭ সালের। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পক্ষে ছিলেন তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো অবস্থান নিলে ‘দেখে নেওয়া হবে’, এই হুঁশিয়ারি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তা সত্ত্বেও জাতিসংঘের বেশির ভাগ সদস্যরাষ্ট্র ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এর পরপরই জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি ঘোষণা দেন যে পরবর্তী অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১৮-১৯ এ জাতিসংঘে অর্থায়ন ২৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার কমাবে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘের বাজেট বরাদ্দে আরও কাটছাঁট করা হবে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।
এ দুটি ঘটনার মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কিছুটা আন্দাজ করা যায়। আন্দাজ করা যায় জাতিসংঘের প্রকৃত অবস্থানও। তাছাড়া বর্তমান ইসরায়েল রাষ্ট্রটির ক্ষমতা এতটাই বেশি যে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির একটা বিশাল অংশ এ রাষ্ট্রটিই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আগে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলটিতে দাপটের সাথে বিচরণ করলেও এখন এ রাষ্ট্রটি এ অঞ্চলটির অনেক জায়গা থেকেই নিজেদের সামরিক ঘাঁটি সরিয়ে নিয়েছে এবং ইসরায়েলের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করছে। মূলত ১৯৬৭ সালে আরব রাষ্ট্রগুলোকে হারিয়ে ইসরায়েলের নিজেদের সামরিক শক্তির সবচেয়ে বড় প্রমাণ দেয়া, তেল সমৃদ্ধতা, সুয়েজ খালের মতো গুরুত্বপূর্ণ জলপথ এসব কিছুই যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরায়েল তথা মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি দূর্বল করে তুলেছে। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি বিশ্ব শক্তিগুলোর অনেক আগে থেকেই নজর, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় শক্তিগুলোকে খুবই কৌশলে নিজের পক্ষে আনতে পারায় ইসরায়েলের সাথে সুসম্পর্ক যেমন আরো জোড়ালো হয় ঠিক একইভাবে ফিলিস্তিন কিংবা আরব রাষ্ট্রগুলোকে একতরফা সমর্থন দিলে লাভের চেয়ে ক্ষতির দিকটাই বেশি বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তাছাড়া পারমানবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইসরায়েলও বেশ শক্তিশালী।
অন্যদিকে ফিলিস্তিনে চলমান বর্তমান সংঘাতের মাধ্যমে নতুন করে আলোচনায় আসে হামাস এবং ফিলিস্তিনের ভেতরকার রাজনৈতিক কোন্দল। হামাস মূলত মিশরের মুসলিম ব্রাদার হুডের ফিলিস্তিনি শাখা। অতীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে প্রক্রিয়ায় আফগান মুজাহিদীদের সহায়তা করেছিল,ইসরায়েলও ঠিক একই প্রক্রিয়ায় ফিলিস্তিনের আরেকটি বৃহত্তর ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল ফাতাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হামাসকে সহযোগীতা করেছিল। বলতে গেলে ইসরায়েলই হামাসের ভিতকে শক্ত করেছে। এখন নিজেরাই হামাসের আচরণে হতবাক হচ্ছে। সাবেক মার্কিন রিপাবলিকান দলের কংগ্রেসম্যান রন পল পার্লামেন্টের এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘হামাস গড়ে উঠেছে ইসরায়েলের সহায়তায়। ইসরায়েল চায় হামাস ইয়াসির আরাফাতকে বাধা দিক। ’রোনাল্ড রিগান প্রশাসনের সময় আমেরিকার স্বরাষ্ট্র বিভাগে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করা ‘ডেভিড লং’ বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম ইসরায়েলিরা আগুন নিয়ে খেলছে। আমি বুঝিনি তারা একটি দানব তৈরি করেছে।’
১৯৮৭ সালে হামাস আত্মপ্রকাশ করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথম ইন্দিফাদার বিদ্রোহের মাধ্যমে। ২০০৭ সালে এ দলটি ফিলিস্তিনের গাজা অঞ্চল শাসন করে আসছে। ২০১৭ সালে হামাস নতুন একটি ধারা প্রকাশ করে যা ফাতাহর সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসরাইলের রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি জানিয়ে বলা হয়, ‘হামাস বিশ্বাস করে যে ‘ইসরাইল’ প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ ‘অবৈধ’। হামাস মূলত ইসরায়েল রাষ্ট্রটির ধ্বংস চায়।
অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল ফাহাত ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর শাসন করে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২নং ও ৩০৮নং ধারা অনুযায়ী ইসরায়েলের অধিকৃত আরব এলাকার প্রকৃত উত্তরসূরিদের ফিরিয়ে দেয়ার কথা। যদিও ইসরায়েল তা আজও করেনি। ফাতাহ ২৪২নং ধারাটিকে সমর্থন করে। কোন রকম সংঘাতে না জড়িয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্রের পাশাপাশি ফাতাহ চায় ফিলিস্তিনও একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করুক। যেটা হামাস চায় না। ১৯৭৮ সালে মিসর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। ইসরায়েলকে ফাতাহ ভিত্তিক দল পিএলও(প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন) ও স্বীকৃতি দেয়। বিনিময়ে গাজা ও জেরিকো শহর তারা ফেরতও পেয়েছিল, যার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পায়রা উড়বে বলে আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু ইয়াসির আরাফাত তা বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি কারণ উগ্রপন্থী হামাস সে শান্তিচুক্তির বিরোধীতা করে। ফিলিস্তনের নির্বাচনকেও তারা বয়কট করেছিল। এ হামাসকে নিয়ে শুরু থেকেই ফিলিস্তিনবাসী নিজেরাই দুই ভাগে বিভক্ত। একদল পক্ষে তো আরেক দল বিপক্ষে এবং ইসরায়েলের সাথে এই হামাস গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বই সবচেয়ে বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ্যাৎ ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলের দিকে হাজার হাজার রকেট নিক্ষেপ করে, যা আচমকা মনে হলেও ইতিহাস ঘাটলে নতুন কিছু নয়। কিছুদিন আগে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হামাস সম্পর্কে তার জায়গা স্পষ্ট করেন। তিনি বলেন, ”হামাস মানে ফিলিস্তিন নয়। ফিলিস্তিনের মানুষ ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও-কে মর্যাদা দেয়। তারাই ফিলিস্তিনের মানুষের প্রতিনিধি। হামাস নয়।” যদিও এই দুই দলের সম্পর্কটা অনেকটা বিরোধপূর্ণ।
এই যখন পরিস্থিতি তখন কার দায় কতটুকু এ প্রশ্ন উত্থাপিত হলে অবশ্যই ইসরায়েল এর পাশাপাশি হামাসও দায়ী। হাজারো মৃত্যুর দায় হামাসকেও নিতে হবে। ফিলিস্তিন বলে কোন রাষ্ট্র পৃথিবীর বুকে না থাকুক, এ ইচ্ছে ইসরায়েলের বহু আগে থেকেই। হামাস যদি বিদ্বেষী মনোভাব ত্যাগ করে ফাতাহ গ্রুপের সাথে এক হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে তাহলে এ সংকট অনেকটাই নিরসন হবে বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। কেননা যত যাই হোক, অভন্ত্যরীন ঐক্য না থাকলে, বাহিরের যে কেউ চাইলেই খুব সহজে ঐক্য নষ্ট করতে পারে। ফিলিস্তিনের জনগনের জীবন হুমকির মুখে ফেলার দায় হামাসেরও। অন্যদিকে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে যে ‘হামাস-ইসরায়েল’ যুদ্ধটাকে এক দল ‘মুসলিম-ইহুদি’ যুদ্ধ বলে প্রচারণা চালাচ্ছে। যেখানে ফিলিস্তিনের একটা বড় সংখ্যক মুসলিমই হামাসের এসব কাজকে সমর্থন করছে না, সেখানে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে এ দেশের একটা বড় সংখ্যক উগ্র ইসলামপন্থী। সারা বিশ্ব যেখানে বলছে, ”ফিলিস্তিনকে সহযোগীতা করুন, নিজেদের মাতৃভূমির জন্য তারা লড়ছে তাদের পাশে থাকুন”। যদিও তা হামাসের সূচনা কিন্তু মানবিকতার দিক দিয়ে ভাবলে তা সঠিক; সেখানে এ দেশের একটা বড় শ্রেনী ”মুসলিম বাঁচাও, ইহুদি হটাও” স্লোগান দিয়ে আরেক বিদ্বেষের জন্ম দিচ্ছে।
পরিশেষে বলবো,অবশ্যই শান্তিপূর্ণ উপায়ে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট নিরসরণ সম্ভব। ইয়াসির আরাফাত যে কাজটি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি, চাইলে ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই শান্তিপূর্রভাবে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে এ সংকট অবশ্যই নিরসণ করা সম্ভব। একই ভাবে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক কাঠামোকেও সে সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। অস্ত্র বানিজ্যের প্রতি নয় বরং বিশ্ব সংহতিমূলক মতাদর্শের প্রতি আগ্রহ দেখালে এ সংকট থেকে হয়তো উত্তরণ লাভ সম্ভব।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইডেন মহিলা কলেজ
সারাবাংলা/এজেডএস