শারদীয় দুর্গাপূজা প্রচলন যেভাবে
২৪ অক্টোবর ২০২৩ ১৮:১৪
সমগ্র উপমহাদেশে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীর প্রধান ধর্মীয় উৎসব শ্রী শ্রী শারদীয় দুর্গাপূজা। বাঙালি জাতির এক আনন্দঘন দিন। শারদীয় দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির মহামিলন মেলার সৃষ্টি হয়। দেবী দুর্গাকে বলা হয় দুর্গতিনাশিনী। শ্রী শ্রী চণ্ডী ধর্মীয় গ্রন্থে দেবী দুর্গাকে ‘নারায়ণী” নামে অভিভূত করা হয়। শাস্ত্রে পাওয়া যায় শ্রী বিষ্ণুর অঙ্গীভূত সবাই বৈষ্ণবী শক্তির অধীন। শ্রী বিষ্ণু অর্থ সর্বব্যাপীরূপে যিনি আছেন তিনি ঈশ্বর, ব্রহ্মা। শ্রীবিষ্ণুকে তারই এক নাম নারায়ণ বলে আখ্যায়িত করা হয়। দেবী দুর্গা সেই শ্রী বিষ্ণুরই অংশীভূত তাই তিনি নারায়ণী, বৈষ্ণবী শক্তির প্রতীক। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব তিন গুণান্বিত ঈশ্বরেরই প্রতীক। স্বত্ত্ব, রজ ও তমোগুণ সম্পন্ন ঈশ্বরের স্ত্রী শক্তির রূপ দেবী দুর্গা।
দেবী দুর্গা সৃষ্টি হয়েছে দেবগণের বিপদ থেকে উদ্ধারকল্পে। সমবেত দেবগণের শক্তির প্রতীক দেবী দুর্গা। পুরাকালে যখন সমস্ত দেবগণ স্বর্গরাজ্যে অসুরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলেন, তখন দেবী দুর্গার নিকট শরণাপন্ন হলেন। দেবী দুর্গা দেবতাদের রক্ষার জন্য অসুরদের সাথে যুদ্ধ করে অসুরদের নিধন করেন ও স্বর্গরাজ্য উদ্ধার করে দেবতাদের ফিরিয়ে দেন।
শ্রী শ্রী দুর্গাদেবীর দশ হাতে যে ১০টি অস্ত্র রয়েছে তা মা দুর্গাকে দেবগণ দিয়েছিলেন যেমন, বিষ্ণু দিলেন চক্র, ইন্দ্র দিলেন বজ্র ও ঘণ্টা, ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা, কমণ্ডলু, বিশ্বকর্মা দিলেন কুঠার ও বর্ম , হিমালয় দিলেন বাহন সিংহ, কাল দিলেন খড়গ ও ঢাল, সমুদ্র দিলেন পদ্ম, যম দিলেন দন্ড, অগ্নি দিলেন ধনুর্ব্বান ও শিব দিলেন ত্রিশূল। সেই রপেই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেবী মা দুর্গাকে আরাধনা ও পূজা করে থাকেন। কৃত্তিবাস রচিত রামায়ণে স্বয়ং রামচন্দ্র লঙ্কেশ্বর রাজা রাবনকে বধ করার উদ্যোগে শরৎকালীন সময়ে দেবীর অকাল বোধন ও ষষ্ঠী কল্পারম্ভ করেছিলেন এবং দেবী রামচন্দ্রের পূজায় সন্তুষ্ট হয়ে রামচন্দ্রকে রাবন বধের জন্য আদেশ দিলেন। রাম রাবনকে বধ করে সীতা দেবীকে উদ্ধার করলেন।
সেই প্রাচীন রীতি অনুযায়ী শরৎকালে সনাতন ধর্মের অনুসারীগণ শ্রী শ্রী শারদীয় দুর্গাপূজা উৎসব পালন করেন। মা দুর্গাদেবীকে পূজা করার সাথে অন্যান্য দেব—দেবীগণের আরাধনা ও প্রার্থিত বস্তু কামনা করা হয়। দেবী দুর্গার পাশে গনেশ হলো জনগণের দেবতা সিদ্ধিদাতা ও বিঘ্ননাশকারী। সকল পূজার শুরুর আগে গনেশ পূজার বিধি। আমরা যে দেব-দেবীর পূজা করে থাকি তা সকলের মঙ্গলের জন্য এবং সকলের দেবতা গনেশ। তাই গনেশ পূজা প্রথম করার বিধি দেওয়া হয়েছে।
গনেশের চারি হাত বেদ হস্ত, যেমন— ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব। এ বেদ হস্ত দিয়েই গনেশ বিশ্বব্রহ্মান্ড ধারণ করে আছেন। বেদই হলো গনেশের অঙ্গভূষণ। এ জ্ঞান-ভূষণ অঙ্গে পরলে তার ভব যন্ত্রণা থাকে না। স্বতই তার গতি রহিত হয়ে স্থিতপ্রাজ্ঞ হন। আর স্থিতপ্রাজ্ঞ হলে গনেশ হয়ে আনন্দময় হন। তাই স্থিতিপ্রাজ্ঞ হওয়ার জন্যই গনেশ পূজা সবার আগে করতে হয়। ইহাই হলো হিন্দু ধর্মের মূর্তিপূজার বৈশিষ্ট্য, মৃম্ময়ী মূর্তিকে চিন্ময়ী করে তোলাই হলো আসল উদ্দেশ্য। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন—
‘‘মূর্তিপূজা করে না হিন্দু
কাঠ মাটি দিয়ে গড়া
মৃন্ময় মাঝে চিন্ময় হেরে
হয়ে যায় আত্মহারা।”
দুর্গাপুজার আর একটি অপরিহার্য অঙ্গ হলো— নব পত্রিকা বা কলা বউ এর অর্চ্চনা করা। নব পত্রিকার অর্চ্চনা দুর্গাপূজায় যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। অনেক জায়গায় শুধু নব পত্রিকাতেই দুর্গাপুজা অনুষ্ঠিত হয়। নয়টি উদ্ভিদের পত্রযু্ক্ত শাখার সমষ্টি এই নবপত্রিকা। ভবিষ্য পুরাণ ধর্মগ্রন্থে যে ৯টি উদ্ভিদের নাম উল্লেখ রয়েছে তা হলোঃ কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, রম্ভা, বিল্ব, দাড়িম্ব, মানকচু, ধান্য ও অশোক।
এই কলা বৃক্ষটি স্বেত অপরাজিতা লতা দিতে বাঁধা হয়। হলুদ রঙের বস্ত্র দিয়ে যখন আবৃত করা হয় তখন রমনীর মতই মনে হয়। এজন্য বলা হয় কলা বউ। নব পত্রিকার জন্মদাতা দুর্গারই অভিন্ন রূপ কল্পনা করা হয়। শাস্ত্রীয় বিধি অনুযায়ী বিশেষ সময়ে নব পত্রিকার নয়টি পত্রিকারই ভিন্ন ভিন্ন পূজা করতে হয়। যেমন— রম্ভায় ব্রাহ্মণীকে, কচুতে কালীকাকে, হরিদ্রায় হরিপ্রিয়া উমাকে, জয়ন্তীকে কার্তিকীকে, বিল্বশাখে শিবাকে, দাড়িম্বে রক্তদন্ডিকাকে, অশোক শাখে শোকহারিণীকে, মানকচুতে চাুমন্ডাকে এবং ধান্যে মহালক্ষ্মীকে আহ্বান ও অর্চনা করে বরাভয়, আয়ু, আরোগ্য. ধন—ধান্যাদি প্রার্থনা করা হয়। অর্থাৎ নব পত্রিকা জগজ্জননী মা দুর্গার প্রতীক রূপেই অর্চনা করা হয়। দুর্গাপূজার সঙ্গে প্রকৃতির পূর্জা জড়িত হয়ে আছে। সনাতন ধর্মে—‘‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্মা” হিসাবে ঈশ্বরের সৃষ্টি সকল বস্তুই পূজনীয় ও বরণীয়।
বাংলাদেশে বাঙালী রাজা কংস নারায়ণ প্রথম দুর্গাপূজা শুরু করেন। সেই সময় হতে আজ পর্যন্ত এ দেশে দুর্গোৎসব চলে আসছে।
লেখক: শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
সারাবাংলা/এজেডএস