কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মীর আরাধনায় সনাতন ধর্মাবলম্বী
২৮ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:২৬
দুর্গা প্রতিমা নিরঞ্জনেরসঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গিয়েছে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর প্রস্তুতি। দুর্গোৎসবের পর আশ্বিন মাসের শেষ পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষ্মী দেবীর আরাধনা করা হয়। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমাকে বলা হয় লক্ষ্মী পূর্ণিমা বা শারদীয় পূর্ণিমা। জ্যোতিষীদের মতে, এই রাতটি চাঁদের ষোলটি ধাপে পূর্ণ। বিশ্বাস করা হয় যে এই পূর্ণিমায় চাঁদ থেকে নির্গত রশ্মি অমৃতের মতো। লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিনটিকে দেবী লক্ষ্মীকে খুশি করার জন্য একটি বিশেষ দিন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে এই দিনে দেবী লক্ষ্মী রাতে তীর্থযাত্রায় বের হন। ঋক বেদে শ্রী ও ঐশ্বর্যের দেবী অর্থে লক্ষ্মীর নাম পাওয়া যায়। লক্ষ্মী সর্ব সম্পদে সফলা, সকল স্ত্রী ও ঐশ্বর্যের অধিষ্ঠাত্রী। লক্ষ্মী ছয়টি বিশেষ গুণের দেবী। তিনি বিষ্ণুর শক্তিরও উৎস। বিষ্ণু রাম ও কৃষ্ণ রূপে অবতার গ্রহণ করলে, লক্ষ্মী সীতা ও রাধা রূপে তাঁদের সঙ্গিনী হন। কৃষ্ণের দুই স্ত্রী রুক্মিনী ও সত্যভামাও লক্ষ্মীর অবতার রূপে কল্পিত হন। লক্ষ্মীর পূজা অধিকাংশ হিন্দুর গৃহেই অনুষ্ঠিত হয়। দীপাবলি ও কোজাগরী পূর্ণিমার দিন তাঁর বিশেষ পূজা হয়। এটি কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা নামে খ্যাত। প্রতিটি ঘরেই প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপূজা করে থাকেন। শাস্ত্র মতে বলা হয়, মা লক্ষ্মী খুব অল্পেতেই সন্তুষ্ট- কিন্তু উপযুক্ত নিয়মাবলী ও কিছু বিধিনিষেধ মেনে দেবীকে আহ্বান জানাতে হয়। মূলত বাংলা, অসম এবং ওড়িশায় এ দিনের পূর্ণিমায় পুজো করার চল রয়েছে। এই পূর্ণিমাকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ‘শারদ পূর্ণিমা’ও বলা হয়। মা লক্ষ্মী ধনসম্পদের দেবী। সৌভাগ্য এবং শান্তির প্রতীক। সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির জন্য বাঙালির ঘরে ঘরে লক্ষ্মী দেবীর আরাধনা করা হয়। বেশিরভাগ বাঙালির ঘরে বছর ভর প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর পুজো করে থাকেন। তবে আশ্বিন মাসের শেষ পূর্ণিমা তিথিতে যে লক্ষ্মীর পুজো করা হয় তা হল কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো। এ ছাড়াও লক্ষ্মী সম্পদের দেবী হওয়ায় তাঁকে ভাদ্র সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি ও চৈত্র সংক্রান্তিতে এবং আশ্বিন পূর্ণিমা ও দীপাবলীর দিনেও মা লক্ষ্মীর পুজো করা হয়। কোজাগরী পূর্ণিমার দিন ঘরে ঘরে পূজিত হন মা লক্ষ্মী। ধন, যশ, খ্যাতি, সুস্বাস্থ্যের জন্য দেবী লক্ষ্মীর আরাধনায় মেতে ওঠে বাংলার প্রায় প্রতিটা পরিবার। এ বারে অর্থাৎ ২০২৩ সালের কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো পড়েছে দু-দিন। ২৮ এবং ২৯ অক্টোবর । ২৮ অক্টোবর, শনিবার ভোর ৪ টা বেজে ১০ মিনিটে শুরু হবে তিথি এবং ২৯ অক্টোবর, রবিবার ভোররাত্রি ০১ টা বেজে ৩০ মিনিটে শেষ হবে। এই সময়ের মধ্যে বাড়িতে মা লক্ষ্মীর আরাধনা করা যাবে। দশমীতে কৈলাসে ফিরে গিয়েছেন মা দুর্গা। আকাশে বাতাসে বিষাদের সুর। চারিদিকে কিছুটা হলেও মন খারাপের পরিবেশ। তবে কয়েকদিন বাদেই আসছেন মা লক্ষ্মী। ইতিমধ্যে বাঙালির ঘরে ঘরে শুরু হয়ে গিয়েছে কোজাগরী মা লক্ষ্মী আরাধনার তোড়জোড়। বাংলার ঘরে ঘরে গোটা বছর ধরে পূজিত হন মা লক্ষ্মী। কারণ তিনি ধন-দৌলত, অর্থের দেবী। কালীপুজোর দিনেও অনেকে লক্ষ্মী পুজো করে থাকেন। এছাড়াও মা লক্ষ্মী সম্পদদায়িনীর বলে ভাদ্র সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি ও চৈত্র সংক্রান্তিতে এবং আশ্বিন শেষ পূর্ণিমাতেও পূজিত হন। তবে আশ্বিন মাসের শেষ পূর্ণিমায় যে লক্ষ্মী পুজো হয়ে থাকে, তাকেই কোজাগরী বলা হয়। আসলে, কোজাগরী শব্দটির উৎপত্তি ‘কো জাগতী’ থেকে। যার অর্থ ‘কে জেগে আছো?’ পূরাণে কথিত আছে, কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিন মা মর্ত্যে আসেন। সকলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আশীর্বাদ দেন। কিন্তু যে বাড়ির দরজা বন্ধ থাকে, সেই বাড়িতে ধন-দৌলতের দেবী প্রবেশ করেন না। মুখ ফিরিয়ে চলে যান। সেজন্য নাকি রাত জেগে মা লক্ষ্মীর পুজো হয়। আশ্বিন মাসের শেষ পূর্ণিমা তিথিতে সেই পুজো হওয়ায়, কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো বলা হয়। বাংলায় শারদীয়া দুর্গোৎসবের পর আশ্বিন মাসের শেষে পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার আরাধনা করা হয়। বাঙালি হিন্দুর ঘরে ঘরে এক চিরন্তন প্রার্থনা প্রায় প্রতি ঘরে ঘরেই দেবী লক্ষ্মীর পূজা হয়ে থাকে। লক্ষ্মী হলেন ধন সম্পত্তির দেবী। ধন সম্পদের আশায় ঘরে ঘরে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা হয়ে থাকে.নারী পুরুষ উভয়েই এই পূজায় অংশ গ্রহণ করেন। অনেকেই সারা বছর প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর পূজা করে থাকেন। এছাড়া শস্য সম্পদের দেবী বলে ভাদ্র সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি ও চৈত্র সংক্রান্তিতে এবং আশ্বিন পূর্ণিমা ও দীপাবলীতে লক্ষ্মীর পূজা হয়। লক্ষণীয় বিষয় হল-খারিফ শস্য ও রবি শস্য ঠিক যে সময় হয় ঠিক সেই সময় বাঙালি হিন্দু মেতে ওঠে লক্ষ্মীর আরাধনায়। তবে পূজার উপাচারে পরিবর্তন হয় মাস ভেদে। বর্তমানে গৃহস্থের সুবিধের জন্যই হোক বা পুরোহিতের স্বল্পতার জন্য, লক্ষ্মী পূজা (বারোমাসী পূজা বাদে) হয় সকাল থেকেই। কিন্তু কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার প্রকৃষ্ট সময় প্রদোষকাল। অর্থাৎ সূর্যাস্ত থেকে দু ঘণ্টা পর্যন্ত যে সময়। যদিও প্রদোষ থেকে নিশীথ অবধি তিথি থাকলেও সেই প্রদোষেই পূজা বিহিত। কিন্তু আগেরদিন রাত্রি থেকে পরদিন প্রদোষ পর্যন্ত তিথি থাকলে পরদিন প্রদোষেই পূজা করা বিধেয়। আবার আগেরদিন রাতে তিথি থাকলেও যদি পরদিন প্রদোষে তিথি না থাকে তাহলে আগেরদিন প্রদোষেই পূজা করা কর্তব্য। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজাতে দেখা যায় জেলা ভিত্তিক আঞ্চলিক আচার অনুষ্ঠান। এখনও ঘরে ঘরে প্রতি বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ করে তার আরাধনা করা হয়। উপচারে ফল মিষ্টি ছাড়াও থাকে মোয়া, নাড়ু ইত্যাদি। লক্ষ্মীর আচার অনুষ্ঠানেও দেখা যায় নানা ধরনের তাৎপর্য। কোনও কোনও পরিবারে পূজায় মোট ১৪টি পাত্রে উপচার রাখা হয়। কলাপাতায় টাকা, স্বর্ণ মুদ্রা, ধান, পান, কড়ি, হলুদ ও হরিতকী দিয়ে সাজানো হয় পূজা স্থানটিকে। পূজার উপকরণ এবং আচার অনুষ্ঠান দেখে অনুমান করা যায় এর নেপথ্যে থাকা কৃষি সমাজের প্রভাব। কিছু কিছু জায়গায় লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে মেলা বসে। কোথাও বা নৌকাবাইচও অনুষ্ঠিত হয়। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার ভোগে অনেক বাড়িতেই জোড়া ইলিশ রাখা হয়। তবে ভোগ হিসাবে খিচুড়ি, লাবড়া থাকা আবশ্যিক। সঙ্গে প্রসাদে ফলমূল তো থাকেই , থাকে নারকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, ভুশের নাড়ু। এছাড়াও লুচি, পায়েস, মিষ্টির নানা আয়োজন থাকে মা লক্ষ্মীর জন্য। পূর্ববঙ্গীয় রীতিতে এইদিন মাছের পাঁচ পদের রান্না হয়। আবার পশ্চিমবঙ্গীয় রীতিতে এই দিন পুরো নিরামিষ খাওয়া দাওয়া হয় এবং চালের কোনো রান্না করা হয় না। ধান হল লক্ষ্মীর প্রতীক। চাল , অন্ন , খাদ্যশস্য হল লক্ষ্মীর প্রতীক। তাই যারা খাদ্য অপচয় করেন , তাদের ওপর দেবী লক্ষ্মী কখনোই তুষ্ট হন না। ধানক্ষেতের আশেপাশে ইঁদুর বা মূষিকের বাস এবং এরা ধানের ক্ষতি করে থাকে। পেঁচক বা পেঁচার আহার হল এই ইঁদুর। গোলাঘরকে লক্ষ্মীর প্রতীক বলা হয়। গোলাঘরের আশেপাশে ইঁদুরের বসবাস। পেঁচা এই ইঁদুরকে খেয়ে খাদ্যশস্য রক্ষা করে। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজাতে দেখা যায় জেলা ভিত্তিক আঞ্চলিক আচার অনুষ্ঠান। এখনও ঘরে ঘরে প্রতি বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ করে তার আরাধনা করা হয়। উপচারে ফল মিষ্টি ছাড়াও থাকে মোয়া, নাড়ু ইত্যাদি। লক্ষ্মীর আচার অনুষ্ঠানেও দেখা যায় নানা ধরনের তাৎপর্য। কোনও কোনও পরিবারে পূজায় মোট ১৪টি পাত্রে উপচার রাখা হয়। কলাপাতায় টাকা, স্বর্ণ মুদ্রা, ধান, পান, কড়ি, হলুদ ও হরিতকী দিয়ে সাজানো হয় পূজা স্থানটিকে। পূজার উপকরণ এবং আচার অনুষ্ঠান দেখে অনুমান করা যায় এর নেপথ্যে থাকা কৃষি সমাজের প্রভাব। কিছু কিছু জায়গায় লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে মেলা বসে। অন্যান্য পূজা আর কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার আলপনাতে বেশ কিছু পার্থক্য থাকে। এই পূজাতে মূল আল্পনার সঙ্গে বাড়ি জুড়ে আঁকা হয় ধানের ছড়া, মুদ্রা, আর মা লক্ষ্মীর পায়ের ছাপের ছবি। এই প্রতীকগুলি পূজার মহত্ত্ব যেমন ব্যাখ্যা করে, তেমনই পূজার আচারের একটা অংশ হয়ে উঠেছে এই বিশেষ ধরনের আলপনা।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
অভিরাজ নাথ কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মীর আরাধনায় সনাতন ধর্মাবলম্বী মুক্তমত