Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমাদের গেছে যেদিন একেবারেই কি গেছে

আনোয়ার হাকিম
৩১ অক্টোবর ২০২৩ ১৭:০৩

দেশে প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। উন্নয়ন এখন দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারো কাছে উন্নয়ন দৃশ্যমান। কারো কাছে তা বাহুল্যপূর্ণ। সর্ব বিষয়ে আমাদের এই আপাত বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জীবনে নিয়ে এসেছে বিভাজন। গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, শিবির, জোট, মহাজোট ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত হচ্ছে আমাদের মানব পরিচয়। আমরাই আমাদেরকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে জমাট বদ্ধ করতে ভালোবাসি। ফলত: পাশাপাশি থেকেও আমরা আলাদা আলাদা জীবন যাপনে সিদ্ধ হয়ে পড়ছি। একের দাহ আমাদেরকে স্পর্শ করে না। অন্যের যাতনা আমাদেরকে ক্লিষ্ট করে না। অন্যের আনন্দে আমাদের বুক ভাঙ্গে। আমার জয়ে অন্যে বুকে কষ্ট পেয়ে থাকে। সব কিছুতেই আমরা পাটিগণিতের ব্র্যাকেট বসিয়ে দিতে ভালোবাসি। তাই ‘আমরা আর মামুরা’ ছাড়া কোন কিছুই ভাবতে পারি না। আর এই সমাজ চিত্রের বেশির ভাগ জুড়েই রয়েছে গোষ্ঠী-প্রীতির সংস্কৃতি। আমাকে বাঁচতে হলে অন্যকে নিশ্চিহ্ন করেই বাঁচতে হবে এই ধরণের কর্কট রোগে আমাদেরকে পেয়ে বসেছে।

বিজ্ঞাপন

আমাদের এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিভাজনের ফলে জাতীয় ইস্যুতে আমাদের কোন ঐকমত্য নেই। আছে উপেক্ষার কদর্য প্রতিশোধ। অপরকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েই যেন আমাদের শান্তি। অন্যের উত্তম কিছুকে মেনে নিতে আমরা একেবারেই অপারগ। বিরোধিতাই যেন আমাদের একমাত্র বিকল্প। ফলতঃ পরস্পর বিরোধী শিবিরের যুদ্ধংদেহী মনোভাব আমাদের জাতিসত্তাকে করছে কলংকিত ও দুর্বল। আমাদের উন্নয়ন অভিধায় সকলের অংশগ্রহণ নেই। আমরা নিজেরাই একে আন্তর্জাতিক সীমারেখার মত সীমানাবদ্ধ করে রেখেছি। বিরোধিতার কারণেই বিরোধিতা করা আমাদের কাছে এখন প্রাথমিক ও একমাত্র দীক্ষা হয়ে গেছে। এই মনস্তত্ব থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না কিছুতেই। আমরা ব্র্যাকেট বন্দী হয়েই থাকতে ভালোবাসি। যেন এটাই আমাদের নিরাপদ বলয়। আমরা কাউকে সার্বিক ভাবে মূল্যায়ন করতে ভুলে গেছি। কারো একক উৎকর্ষ সাধনে গোষ্ঠীর লেজুড় জুড়ে দিয়ে যেন শান্তি পাই। যেন এই একক কৃতিত্ব সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র গোষ্ঠীর মাহাত্ব্যে। যার ফলে একক কৃতিত্বের ঔজ্জ্বল্য ম্লান হয়ে যায়। ব্যাক্তির, প্রতিভার ভবিষ্যত অংকুরোদগম আর সেভাবে হয় না। হতাশা বোধ নতুবা বিশেষ গোষ্ঠীর স্বীকৃতির লোলুপতা পেয়ে বসে। সময় বা কালকেও আমরা নিস্তার দেই না। আমাদের কালে এমন হয়েছে, আমরা এই করেছি, সেই করেছি – এইরূপ ফলাও প্রচারণার টার্গেট শুধুমাত্র প্রতিপক্ষকে হেয় করা বা ঘায়েল করা। তা মোটেই প্রতিযোগিতার মনোভাব থেকে উৎসারিত নয়। দেশের উন্নয়নে দশের তথা সকলের অংশগ্রহণের যে সুযোগ অবারিত থাকার কথা তা আমরা ভুলে যাই। কোন কিছু শুরু করার আগেই আমরা তার সার্বিকতাকে প্রকল্পের মত টার্গেট গ্রুপে সীমাবদ্ধ করে ফেলি। যাতে করে এর সুবিধা বা সুঘ্রাণ টার্গেট গ্রুপের বাইরে থাকা লোকদের মনে দাহ দেয়, খোঁটার যাতনা দেয়। আমরাই কেবল ভালো কিছু করি, অন্যরা লুটেরা বা হায়েনা এই তকমা সেঁটে আমরা পরস্পরের প্রতি একধরণের জিঘাংসা ও আস্থাহীনতার জন্ম দিয়ে থাকি। বিভাজন আমাদেরকে আজ এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে আমরা উদারতা, মানবিকতা, সার্বজনীনতার প্রকৃত অর্থ ভুলে গেছি বা কদর্থ করছি। এর জের এখন সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে এমনভাবে প্রোথিত যে আমরা এর বাইরে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি বা চিত্ত বৈকল্যে ভুগছি। দশ বন্ধু একত্রে জড়ো হলে আলাপ আলোচনার এক পর্যায়ে হয়ত খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করার চেষ্টা করি আমাদের মধ্যে কারা কারা শহুরে শিক্ষিত, কারা ক্যাডেট বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের ছবক প্রাপ্ত। কারা আশরাফ, কারা অতরাফ। কারা ইংলিশ আভিজাত্যে আর কারা বাংলা মিডিয়ামের স্মেল নিয়ে বেড়ে উঠেছি। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে তালাশ করি কাদের শিক্ষার ব্যাকগ্রাউন্ড কারিগরি, কাদের ডাক্তারি, কাদের সামাজিক বিজ্ঞানে, কাদের সাধারণ কলায়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাজন তো আছেই। কে কে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের টুয়িংকল স্টার আর কে কে প্রাইভেটের অনুজ্জ্বল তারা। ব্যস! শুরু হয়ে গেল বিভাজনের পদধ্বনি। আর রাজনৈতিক ভিন্নতা থাকলে তো অংকুরোদগমন পর্যায়েই তা মুখ থুবড়ে পড়বে। দশের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল খুব ঔৎসুক্য নিয়ে অচিরেই তাতে দেখা দিবে ফাংশনাল সম্পর্কের হাই- হ্যালো। যা হতে পারত দশের শক্তি তা আপনা আপনি বিভাজিত হয়ে অদৃশ্য বা দৃশ্যমান অন্তত দু’টি ফেডারেশনে, ন্যুনপক্ষে তিন-চার সিন্ডিকেটে এবং একই ছাতার নিচে কমপক্ষে ছয়-সাত মিনি সার্কেলে পরিণত হয়ে যাবে। এভাবেই সম্মিলিত উদ্যোগ শক্তিহীন হয়ে পড়ে। আমরা তো স্বল্প মেয়াদি কোন কিছুতেই স্থির থাকতে পারি না। দীর্ঘমেয়াদি বিষয় তো বহুত দূর কা বাত।

বিজ্ঞাপন

কথায় আছে দশের লাঠি একের বোঝা। তা প্রবাদ। বাস্তবপ্রদ নয়। আমরা ইম্প্রোভাইজ করে তাতে আংশিক সংশোধনী এনেছি। দশ এখন আর সার্বজনীন গাণিতিক সংখ্যা মাত্র না। তা এখন একইরূপ বা গোত্রের জোট আবদ্ধ সমজাতীয় সংখ্যা নির্দেশক। এই ফর্মূলা মেনে যাবতীয় কাটাকুটি শেষে হয়ত উত্তর ইতি বা নেতি বা শূন্য বাচক হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এভাবে উন্নয়ন যাত্রা টেকসই হয় না।

দেশ সবার উপর। এর সম্পদে আপামরের অংশ রয়েছে। তাই এর দেখভালে সবার মতামতের অধিকার রয়েছে। এর মাধ্যমেই উন্নয়ন-ভোগ তৃপ্তিকর হতে পারে। ব্যাক্তি অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। তবে তা দেশ ও জাতিসত্তাকে উপেক্ষা করে নয়। শুধু মুখে উপ্ত বাক্য দিয়ে কথার ফুলঝুরি হয়ত হবে, তবে তা ক্ষনিক বাদেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে বাসি ফুলের কটু গন্ধ আর পোকামাকড়ের দংশনে।

দীর্ঘ বন্ধুর পথের অভীষ্ট অর্জনে চারপাশের কণ্টকাকীর্ণ বাধা সরিয়ে সম্মুখবর্তী হতে সবার সহিষ্ণুতা আর বিবেকের আলোক ছটা দরকার। সবাই পারে, আমরাও পারবো – এই ঐকান্তিক ইচ্ছাটাই জরুরি। রবী বাবু প্রশ্ন রেখেছিলেন, “আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে”? তার উত্তরটাও তিনি দিয়ে গেছেন, “রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে”। স্থির প্রত্যাশার এই মর্মবাণীই হতে পারে আমাদের চালিকা শক্তি।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

সারাবাংলা/এসবিডিই

আনোয়ার হাকিম আমাদের গেছে যেদিন একেবারেই কি গেছে মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর