কর্মস্থলে নারীরা কবে নিরাপদ হবে?
১৫ নভেম্বর ২০২৩ ১৫:০০
মানবিকতা, নৈতিকতা এসব বিষয় এখন আমাদের কাছে কল্পনার বিষয়। মূল্যবোধ, মানবিকতা, ভদ্রতা এসব যা অল্প-স্বল্প আছে বলে মনে হচ্ছে তাও এখন ধস নামছে। যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো স্থানে মূল্যবোধ, মানবিকতা, ভদ্রতার অবক্ষয় দেখা যায় সেখানে নারীর প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধাও আশা করাটাই বেশি বেশি হয়ে যায়। কিন্তু দিন দিন কীভাবে এই বিষয়টা বেড়ে যায়? সমস্যাটা কোথায় আমাদের? একটি দেশে যতদিন পর্যন্ত নারীর প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হবে না, ততদিন সে দেশকে সম্পূর্ণ উন্নত দেশ বলা যাবে না। আমরা মূলত এখানেই অনেক পিছিয়ে আছি।
আমার এমনটা বলার কারণ হচ্ছে, বর্তমানে আমরা আধুনিক হলেও, আমাদের নারীদের প্রতি আমাদের মানসিকতা এখনও আধুনিক হয়নি। এখনও প্রতিটি নারী কর্মস্থলে কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন। এখনও অফিসে সিনিয়র বসের ইভটিজিং, সেক্সুয়েল হ্যারেজম্যন্টের শিকার হতে হয় একজন নারী কর্মীকে। এই অহস্য, অমানবিক যন্ত্রণা সহ্য করেও অনেকে চাকরি করে আসছেন দিনের পর দিন। নীরবে মুখ-বুজে সহ্য করে আসছেন অনেক নারী। আপনার প্রশ্ন হতে পাওে, কিন্তু কেন সহ্য করছেন তারা? আপনি হয়তো জানেন না বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে চাকরির বাজার কতটা কঠিন। এখানে চাকরি হারিয়ে ফেলা মানে জীবনে অন্ধকার চলে যাওয়া। শুধু যে নিজের জীবনে অন্ধকার আসবে তা নয়, পুরো একটা পরিবার অন্ধকারে চলে যেতে পারে। এমন আরও অনেক ভয়ে চাকরিতে এসকল অন্যায়, অমানবিকতা সহ্য করে থাকনে নারীরা। চাকরি হারানোর ভয়ে অভিযোগটাও করেননা। শুধু কি তাই? এই সমাজ কি বলবে? সমাজের মানুষের কথার ভয় আছে, আছে পরিবার, স্বামী কীভাবে নেয় বিষয়টা সেই ভয়। এসবের সাথে পেরে উঠাও যে বড় মুশকিল!
প্লান ইন্টারন্যাশনাল ও গার্লস অ্যাডভোকেসি অ্যালায়েন্সের সহায়তায় একটি জরিপ পরিচালনা করে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, জরিপে অংশগ্রহণকারী ১৩৫ জন নারীর শতভাগই নিজ কর্মস্থলে কোনো না কোনো ভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে বলে জানা যায়। তাদের মধ্যে ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশ ২/৩ বার, ২৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ নারী ৪ থেকে ৫ বার এবং ২২ দশমিক ৯৬ শতাংশ নারী একবার করে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। ১৩৫ জনের মধ্যে ৬১ জন শারীরিক স্পর্শের মাধ্যমে (৪৫ দশমিক ১৯ শতাংশ), ৮০ জন মৌখিকভাবে (৫৯ দশমিক ২৫ শতাংশ), সরাসরি যৌন আবেদনের শিকার হয়েছেন ৬৪ জন অর্থাৎ ৪৭ দশমিক ৪১ শতাংশ নারী। এছাড়া ৬০ জন (৪৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ) সুপারভাইজার দ্বারা, ৮৮ জন (৬৫ দশমিক ১৯ শতাংশ) ম্যানেজার/বস কর্তৃক, ৮ জন (৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ) নারী তাদের নিয়োগকর্তার দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন।
এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের (এসিডি) জরিপ অনুযায়ী, দেশের মোট ৪২ লাখ ২০ হাজার পোশাকশ্রমিকের মধ্যে নারী ২৪ লাখ ৯৮ হাজার। এ খাতে নিয়োজিত নারী কর্মী দেশের শিল্প খাতে নিয়োজিত মোট নারী কর্মীর ৭০ ভাগ। তবে এখানেও যে তারা অন্যায়-অবিচারের শিকার হন না তা কিন্তু নয়। ৭৪ শতাংশ নারী পোশাকশ্রমিক কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত কাজে বাধ্য হন। তৈরি পোশাকশিল্পে নারী বেশী নির্যাতিত। শতকরা ৮৪ দশমিক সাতজনকে কারখানার ভেতর মৌখিক নির্যাতন ও গালাগালের শিকার হতে হয়। শতকরা ৭১ দশমিক তিনজনের ওপর মানসিক নির্যাতন করা হয়। শতকরা ২০ জন শারীরিক নির্যাতন অর্থাৎ তারা মারধরের শিকার হওয়ার কথা বলেছেন। যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা বলেছেন শতকরা ১২ দশমিক সাতজন। কর্মজীবী নারী ও কেয়ার বাংলাদেশের সদ্যসমাপ্ত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
বর্তমানে মামলা করেও খুব বেশি সুবিধা পাওয়া যায় না। সেটা আমরা নিকট অতিতের কিছু ঘটনা দেখলেই বুঝতে পারি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, এসব অপরাধের সাজার হার মাত্র ৩ শতাংশ। আর এত লম্বা সময় লাগে যে এ মামলার ফল আপনি দেখে যেতে না-ও পারেন।
এমন আরও অনেক জরিপ এবং গবেষণা হয়েছে এদেশে। কিন্তু এসব জরিপ কিংবা গবেষণায় নারীদের খুব বেশি উপকার হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। দিন দিন এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হচ্ছে। নারীর প্রতি যৌন হয়রানী, ইভটিংজিং এমনকি ধর্ষণের মতো নোংরামীও চলছে রোজ। এরকিছু গণমাধ্যমে আসছে, কিছু আড়ালে থেকে যাচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে সময়ে দেখা যাচ্ছে, কর্মস্থলের নারীরা বেশ অনিরাপদ। তাঁরা তাদের বিষয়টা প্রকাশ্যে বলতেও ভয় পাচ্ছে। কিন্তু এনিয়ে প্রশাসন এবং সরকারের তেমন ভূমিকা চোখে পড়ে না। অথচ এরজন্য প্রয়োজন নিয়মিত তদারকি।
নারীর নিরাপত্তায় আইন করে প্রতিটি কর্মস্থলে নারীদের জন্য অভিযোগ বাক্স রাখাতে হবে। সেখানে তারা তাদের অভিযোগ জমা দিবে। সেই সাথে শ্রমজীবী নারীর চাকরির নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। তবেই অভিযোগ করার সাহস পাবে নারীরা। এছাড়াও কর্মস্থলে সহকর্মীদের সঙ্গে আচরণের বিষয়ে একটি নির্দেশিকা থাকা প্রয়োজন। নারী কোনো যানবাহনে চড়লে সে পরিবহনের ছবি তুলে রাখতে পারেন। তাহলে তিনি কোন গাড়িতে কখন হয়রানির শিকার হয়েছেন, সেটা জানা সহজ হয়। এভাবে আরও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে এই বিষয়টাকে গুরুত্ব সহকারে নজরে আনা জরুরী বলে মনে করছি আমি। বর্তমান সরকার নারীবান্ধব এটা আমরা সকলেই জানি। তাই সরকারের উচিৎ এই বিষয়টাকে গুরুত্ব সহকারে নজর দিয়ে নারীদের নিরাপদ কর্মস্থলের সুযোগ করে দিবেন।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই