Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

লোক সাহিত্য ও বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস প্রণেতা দীনেশচন্দ্র সেন

সৈয়দ আমিরুজ্জামান
২০ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:১২

লোক সাহিত্যবিশারদ, শিক্ষাবিদ, গবেষক, ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’-র সম্পাদক ও বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস প্রণেতা দীনেশচন্দ্র সেনের ৮৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।

দীনেশচন্দ্র সেন ১৮৬৬ সালের ৩ নভেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার বগজুরি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত বৈদ্যব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ঢাকা জেলার সুয়াপুর গ্রামে। পিতা ঈশ্বরচন্দ্র সেন মানিকগঞ্জ আদালতের উকিল ছিলেন। মাতা রূপলতা দেবী। কবি ও সাংবাদিক সমর সেন তার পৌত্র।

বিজ্ঞাপন

শিক্ষা

দীনেশচন্দ্র সেন জগন্নাথ স্কুল থেকে এনট্রান্স (১৮৮২), ঢাকা কলেজ থেকে এফ.এ (১৮৮৫) পাস করেন। ১৮৮৯ সালে বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্ম

তিনি কর্মজীবন শুরু করেন সিলেটের হবিগঞ্জ স্কুলে (১৮৮৭)। পরে তিনি কুমিল্লার শম্ভুনাথ ইনস্টিটিউশন (১৮৮৯) ও ভিক্টোরিয়া স্কুল (১৮৯০)-এর প্রধান শিক্ষকের পদে যোগদান করেন। ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলো’ নির্বাচিত হন দীনেশচন্দ্র সেন। এর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রীডার’ পদে কর্মরত ছিলেন তিনি।

সাহিত্য

১৮৯০-এ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনকালে গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে প্রাচীন বাংলার পুঁথি সংগ্রহ করেন এবং সেসব উপকরণের সাহায্যে ১৮৯৬-এ “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য” শিরোনামে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনা করেন। ১৯০৫ সালে বিনোদবিহারী কাব্যতীর্থের সহযোগিতায় শ্রীকর নন্দীর লেখা ‘ছুটিখানের মহাভারত’-এর পুঁথি এবং হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সহায়তায় মানিক গাঙ্গুলীর লেখা ‘শ্রীধর্মমঙ্গল’ পুঁথি দুটি দীনেশচন্দ্র সেন প্রথম প্রকাশ করেন।

বিজ্ঞাপন

১৯১১ সালে তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ “হিস্ট্রি অব বেঙ্গলি লিটারেচার” প্রকাশিত হলে তা সর্বমহলের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করে। ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে “রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলোসিপ” প্রদান করে এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি মৈমনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা সম্পাদনা করেন।

উপাধি

১৯২১-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.লিট ডিগ্রী এবং ১৯৩১-এ “জগত্তারিণী স্বর্ণপদক” প্রদান করেন। ১৯২১-এ ব্রিটিশ শাসিত ভারত সরকার তাকে “রায় বাহাদুর” উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯২৬-এ মৈমনসিংহ গীতিকা গ্রন্থটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন রচিত গবেষণাধর্মী “বৃহৎবঙ্গ” গ্রন্থটি বাঙালীর ইতিহাস চর্চায় অনন্য!

প্রধান গ্রন্থসমূহ

বঙ্গভাষা ও সাহিত্য (১ম ও ২য় খণ্ড) (১৮৯৬), তিন বন্ধু (১৯০৪), রামায়ণী কথা (১৯০৪), বেহুলা (১৯০৭), সতী (১৯০৭), ফুল্লরা (১৯০৭), জড় ভরত (১৯০৮), সুকথা (১৯১২), গৃহশ্রী (১৯১৬), নীলমানিক (১৯১৮), মুক্তা চুরি (১৯২০), সরল বাংলা সাহিত্য (১৯২২), বৈদিক ভারত (১৯২২), ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য (১৯২২), আলোকে আঁধারে (১৯২৫), চৌকির বিড়ম্বনা (১৯২৬), ওপারের আলো (১৯২৭), পৌরাণিকী (১৯৩৪), বৃহৎ বঙ্গ (১ম ও ২য় খণ্ড) (১৯৩৫), আশুতোষ স্মৃতি কথা (১৯৩৬), শ্যামল ও কাজল (১৯৩৬), পদাবলী মাধুর্য্য (১৯৩৭), পুরাতনী (১৯৩৯), বাংলার পুরনারী (১৯৩৯),
প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান (১৯৪০), হিন্দু সমাজ ও বৈষ্ণব ধর্ম, মৈমনসিংহ গীতিকা।

মৃত্যু

১৯৩৯ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতার বেহালায় তার মৃত্যু হয়।

মৈমনসিংহ গীতিকা একটি সংকলনগ্রন্থ যাতে ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রচলিত দশটি পালাগান লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। প্রথম খণ্ডের দশটি পালার রচয়িতা ভিন্ন ভিন্ন হলেও সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে। এই গানগুলো প্রাচীন কাল থেকে মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে আসছে। তবে ১৯২৩-৩২ সালে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন এই গানগুলো অন্যান্যদের সহায়তায় সংগ্রহ করেন এবং স্বীয় সম্পাদনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রকাশ করেন। তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোণা মহকুমার আইথর নামক স্থানের আধিবাসী চন্দ্রকুমার দে এসব গাথা সংগ্রহ করছিলেন। এই গীতিকাটি বিশ্বের ২৩টি ভাষায় মুদ্রিত হয়।

উল্লেখযোগ্য পালা

স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের আনুকূল্যে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ড.দীনেশ চন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গাথা সংগ্রাহক হিসেবে চন্দ্র কুমার দে মহাশয়ের কাছ থেকে নিম্নের পালাগুলো সংগ্রহ করেন।

মহুয়া (দ্বিজ কানাই), চন্দ্রাবতী (রচয়িতা নয়নচাঁদ ঘোষ), কমলা, দেওয়ানা মদিনা (রচয়িতা মনসুর বয়াতী), দস্যু কেনারামের পালা (রচয়িতা চন্দ্রাবতী), কঙ্ক ও লীলা (দামোদর দাস, রঘুসুর, শ্রীনাথ বেনিয়া এবং নয়ানচাঁদ ঘোষ প্রণীত), মলুয়া (এই পালাটির সূচনাতে মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর একটি বন্দনা রয়েছে বলে এর রচয়িতা হিসেবে চন্দ্রাবতীকে মনে করা হয়), দেওয়ান ভাবনা (চন্দ্রাবতী প্রণীত), কাজলরেখা, রাবিয়া রূপবতী দোলা (রচয়িতা- মিরাজ)।

‘মহুয়া পালা’ নামকরণ

ময়মনসিংহে ১৬৫০ সালে রচনা হয় মহুয়া পালা । দীনেশ চন্দ্র সেন মহুয়া পালাকে ২৪টি অধ্যায়ে বিভক্ত করেন। মৈনমনসিংহ গীতিকায় মহুয়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২৩ ভাষায় মুদ্রিত হয়। এই মহুয়া গাছের নাম ধরেই মহুয়া পালা।

মহুয়ার পালার রচয়িতা দ্বিজ কানাই। রসের দিক থেকে রোমান্টিক ট্র্যাজেডি ঘরানার কাব্য মহুয়া পালার সংগ্রাহক দীনেশচন্দ্র সেন। এর চরিত্রগুলো হলো- নদের চাঁদ, মহুয়া, হুমরা বেদে। এর রচনাকাল ধরা হয় ১৬৫০ সাল। এই পালায় মোট ৭৮৯টি ছত্র আছে। দীনেশচন্দ্র সেন মহুয়া পালাকে ২৪টি অধ্যায়ে বিভক্ত করেন।

নদের চাঁদের বসতভিটা সুসং দুর্গাপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্ব দিকে এবং ঝাঞ্ছাজাইল বাজার থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে বাউরতলা গ্রামের পাশে। সুদর্শন পুরুষ নদের চাঁদ ছিলেন এক জমিদারের দেওয়ান। অপর পক্ষে রূপবতি মহুয়া বেদে সরদার হুমরা বেদের পালিত কন্যা, যাকে শিশুকালে হুমরা বেদে নেত্রকোণার কাঞ্চণপুর থেকে ডাকাতি করে নিয়ে আসে। জানা যায়, বেদে মহুয়াও এক সভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন। বেদেরা ঘাটে ঘাটে নোঙ্গর ফেলত ও হাট বাজারে পাড়ায় সাপের খেলা দেখাত। বেদে মহুয়া যখন নদের চাঁদের গ্রামে সাপের খেলা দেখাতে আসেন তখন মহুয়ার রূপে মুগ্ধ হয়ে নদের চাঁদ তাকে প্রণয় নিবেদন করেন। মহুয়াও নদের চাঁদের প্রণয়ে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। কিন্তু দুজনের প্রণয়ের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সরদার হুমরা বেদে। একদিন নদের চাঁদ মহুয়াকে নিয়ে পালিয়ে যান। এদিকে হুমরা বেদে তা জানতে পেরে দলবল নিয়ে তাদের পিছু ধাওয়া করে। অবশেষে তারা মহুয়া এবং নদের চাঁদকে ধরে ফেলে। হুমরা বেদে নদের চাঁদকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। সরদার মহুয়ার হাতে বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে বলে ‘‘যাও নদের চাঁদকে মেরে ফেল’’। বিষলক্ষা ছুরি নিয়ে মহুয়া নদের চাঁদের দিকে এগিয়ে যান। নদের চাঁদের সম্মুখে পৌছে বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে তিনি তাঁর নিজের বক্ষ বিদীর্ণ করেন এবং মাটিতে ঢলে পড়েন। প্রণয় পিয়াসী নদের চাঁদ মহুয়ার এই আত্মত্যাগ সহ্য করতে না পেরে প্রেমের প্রতিদান সরূপ বিষলক্ষা ছুরি দিয়ে নিজ জীবন আত্মহুতি দেন। মহুয়া ও নদের চাঁদের এই আত্মত্যাগ চিরন্তন প্রেমকে মহিমান্বিত করেছে। আজও সেই প্রেমের অমর কহিনী লোক মুখে মুখে বিরাজমান।

দীনেশচন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গীতিকার প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় লিখেছেন, ”মহুয়ার প্রেম কী নির্ভীক, কী আনন্দপূর্ণ! শ্রাবণের শতধারার ন্যায় অশ্রু আসিতেছে, কিন্তু প্রেমের মুক্তাহার কণ্ঠে পরিয়া মহুয়া চিরজীবী, মৃত্যুকে বরণ করিয়া মৃত্যুঞ্জয়ী হইয়াছে।”

মলুয়া পালা

প্রধান চরিত্র মলুয়ার নামে পালার নামকরণ করা হয়েছে “মলুয়া পালা”। মলুয়া পালার রচয়িতা অজ্ঞাত। তবে রচনার শুরুতে কবি চন্দ্রাবতীর একটি ভণিতা থাকার কারণে ধারণা করা হয় এটি চন্দ্রাবতীর রচনা। কিন্তু দীনেশচন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গীতিকার প্রথম খণ্ডে এই ধারণা অসত্য বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু বাংলার পুরনারী নামের বইয়ে মলুয়া চন্দ্রাবতীর রচনা বলা মন্তব্য করেন। মলুয়া গাথার মোট ছত্রসংখ্যা ১২৪৭। পালাটি মোট ১৯টি অঙ্কে বিভক্ত।

মলুয়া ও চাঁদ বিনোদের দাম্পত্য সম্পর্ক, কাজির ক্ষমতায় বিচ্ছেদ, উত্থান-পতন, ক্ষমতাবান কাজির দাপট ও তার কাছে হার না মানা এক বাঙালি নারীর কাহিনী হলো “মলুয়া পালা”। মলুয়া চরিত্র সম্পর্কে দীনেশচন্দ্র সেন মন্তব্য করেন, ” রাগে উজ্জ্বল, বিরাগে উজ্জ্বল, সহিষ্ণুতায় উজ্জ্বল এই মহীয়সী প্রেমের মহাসম্রাজ্ঞীর তুলনা কোথায়?”

কমলা পালা

মূল চরিত্র কমলার নাম থেকে পালার নামকরণ করা হয়েছে। পালাটির রচয়িতা দ্বিজ ঈশান। কমলা পালায় মোট ১৩২০টি ছত্র এবং ১৭টি অঙ্কে বিভক্ত।
প্রিয়তমা স্ত্রীর শখ পূরণে রাজা জানকীনাথ মল্লিক তার স্ত্রীর নামে কমলা সায়র দিঘি খনন করান। কিন্তু দিঘিতে জল না উঠায় রাজা নরকপ্রাপ্ত হওয়ার ভয় পেলে রানি কমলা স্বামীকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন। তিনি তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে দাসীদের হাতে সমর্পণ করে সদ্যখোঁড়া দিঘিতে নিজেকে উৎসর্গ করে চিরতরে হারিয়ে যান। রানিকে হারানোর শোকে কিছুদিনের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। মৈমনসিংহ গীতিকার ভূমিকায় দীনেশচন্দ্র সেন বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা আলোচনা করে ধারণা করেন এই কাহিনীর মূল ঘটনা সত্য।

কাজল রেখা

মৈমনসিংহ গীতিকায় যুক্ত হওয়া একমাত্র রূপকথা কাজল রেখা পালা। এই পালার রচয়িতা অজ্ঞাত। এই পালার কিছুটা সংক্ষিপ্ত রূপ সংকলিত হয়েছে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলিতে।
ধনেশ্বর তার অর্থনৈতিক দুর্ভাগ্যের কারণের শুকপাখির উপদেশে কন্যা কাজল রেখাকে এক গভীর নির্জন বনের ভাঙা মন্দিরে রেখে আসে। সেই মন্দিরে এক সন্ন্যাসী কোনো এক মৃতপ্রায় রাজপুত্রের জীবন ফিরিয়ে আনার জন্য সূঁচ বিঁধিয়ে রেখেছিলেন। পিতা ও সন্ন্যাসীর কথায় কাজল রেখা সেই সূচরাজপুত্রকে স্বামী হিসেবে স্বীকার করে নেয়। তার সূচ তুলে রাজরানী হয়ে থাকার সময় আবার এক দুর্ঘটনা ঘটে। হাতে কাঁকন দ্বারা কিনে নেওয়া দাসীর কৃতঘ্নতায় কাজল রেখা দাসী হয়ে স্বামীর রাজ্যে বাস করতে থাকে। এক সময় সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে কাজল রেখা।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

মুক্তমত লোক সাহিত্য ও বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস প্রণেতা দীনেশচন্দ্র সেন সৈয়দ আমিরুজ্জামান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর