Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে

আবু আফজাল সালেহ
২২ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৩৪

প্রতি শীতে দূর দূরান্ত থেকে শীতের পাখিরা আসে আমাদের দেশে। ভ্রমণ পিপাসু মানুষ পাখি দেখতে ভিড় করে বিভিন্ন জলাশয়ে। পাখিদের কলকাকলি যেন প্রকৃতির শোভা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। গাছের সবুজ, জলের নীল আর পাখিদের নানা রঙ মনে যে বর্ণিল আবেশ তৈরি করে তার রেশ রয়ে যায় অনেক দিন। পাখিগুলোকে অচেনা পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে আমাদের বন্ধু সূলভ আচারণ করা দরকার। এই পাখিগুলো রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। আন্তর্জাতিকভাবে জলচর পাখির জন্য স্বীকৃত ২৮টি জায়গা বাংলাদেশের সীমানায় রয়েছে। এগুলো হলো: বরিশাল বিভাগের চর বারি, চর বাঙ্গের, কালকিনির চর, চর শাহজালাল, টাগরার চর, ডবা চর, গাগোরিয়া চর, চর গাজীপুর, কালুপুর চর, চর মনপুরা, পাতার চর ও উড়ির চর; চট্টগ্রাম বিভাগের চর বারী, বাটা চর, গাউসিয়ার চর, মৌলভীর চর, মুহুরী ড্যাম, মুক্তারিয়া চর, ঢাল চর, নিঝুম দ্বীপ, পতেঙ্গা সৈকত, সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপ; সিলেট বিভাগের আইলার বিল, ছাতিধরা বিল, হাইল হাওর বাইক্কা, হাকালুকি হাওর, পানা বিল, রোয়া বিল, শনির বিল ও টাঙ্গুয়ার হাওর।

বিজ্ঞাপন

শীত এলেই এসব জলাশয়সহ বিভিন্ন হাওর, বিল ও পুকুরের পাড়ে চোখে পড়ে নানান রঙ-বেরঙের নাম জানা, অজানা পাখির। এদেরকে আমরা অতিখি পাখি বলে থাকি। অতিথি পাখির বড় আশ্রয়স্থল হচ্ছে চট্টগ্রামের সোনাদিয়াসহ সেখানকার চরাঞ্চল, ভোলার বিভিন্ন চরাঞ্চল আর বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলাঞ্চল। আর সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ আর মৌলবীবাজারের বিভিন্ন জলাশয় আর হাওর-বাওর হচ্ছে অতিথি পাখিদের আর একটি বড় আশ্রয়স্থল। আবাসিক ও পরিযায়ী মিলে বাংলাদেশে পাখির সংখ্যা প্রায় ৬৫০ প্রজাতির। এর মধ্যে ৩৬০ প্রজাতি আবাসিক। বাকি ৩০০ প্রজাতি পরিযায়ী। সব পরিযায়ী শীতের সময় আসে না। ৩০০ প্রজাতির পাখির মধ্যে ২৯০টি শীত মৌসুমে আসে ও ১০টি প্রজাতি থেকে যায়। চরে শীত মৌসুমে যেসব পাখি বেশি দেখা যায় তার মধ্যে আছে- দেশী কানিবক, গো বগা, মাঝলা বগা, ধুপনি বক, কালামাথা কাস্তেচরা, পাতি চকাচকি, খয়রা চকাচকি, ইউরেশিও সিঁথিহাঁস, পাতি তিলিহাঁস, পাতি শরালি, উত্তরে লেঞ্জাহাঁস, উত্তরে খুন্তেহাঁস, পাকড়া উল্টোঠুঁটো, ছোট নথজিরিয়া, কালালেজ জৌরালি, নাটা গুলিন্দা, ইউরেশিও গুলিন্দা, পিয়ং হাঁস, গিরিয়া হাঁস, প্রশান্ত সোনাজিরিয়া, মেটে জিরিয়া, পাতি লালপা, পাতি সবুজপা, পাতি বাটান, টেরেক বাটান, জুলফি পানচিল, খয়রা মাথা গাঙচিল, কাসপিয়ান পানচিল, চামচঠুঁটো বাটান, খুন্তেবকসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।

বিজ্ঞাপন

জলচর সৈকত পাখিদের আরেকটি বড় অংশ দেখা যায় কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়াদ্বীপসহ এর আশপাশের ছোট ছোট দ্বীপগুলোর নরম চরে। বাইক্কা বিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাজার হাজার অতিথি পাখির কিচিরমিচিরে মুখর এখন মৌলভীবাজারের হাইল হাওরের বাইক্কা বিল। স্থানীয় বাসিন্দা পাখি বলে পরিচিত বেগুনি কালেমের সংখ্যা এই বিলে চোখে পড়ার মতো। এই পাখি যেন সৌন্দর্যের রাণী। চোখ ফেরানো যায় না। এবার শুধু বাইক্কা বিলই নয়, বাইক্কা বিলের আশপাশে হাইল হাওরের অন্যান্য বিল এলাকাতেও কালেমসহ অন্য পাখি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। শীতের পাখির জন্য বাইক্কা বিল এখন বেশ জনপ্রিয়। শ্রীমঙ্গলের পাশেই মাছ আর পাখির অভয়াশ্রম এই বিল। এখানে প্রতি বছর প্রায় ১৬০ প্রজাতির পাখি আসে। নানা জাতের এসব পাখির মধ্যে আছে পার্পল সোয়াপ হেন বা কালেম, গ্রেট কর্মোরান্ট বা ছোট পানকৌড়ি, লিটল কর্মোরান্ট বা বড় পানকৌড়ি, ওরিয়েন্টাল ডার্টার বা সাপ পাখি, ডাহুক, জল মোরগ, দল পিঁপিঁ বা নেউ পিঁপিঁ, গ্রেট এগ্রেট বা বড় বক, গ্রে হেরন বা ধুসর বক, পার্পল হেরন বা বেগুনি বক ইত্যাদি। বিপন্ন প্রজাতির পাখি ব্লাক হেডেড আইবিস বা কালোমাথা কাস্তেচরার দেখাও মিলবে এখানে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাওরের নাম হাকালুকি। মৌলভীবাজার শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে হাকালুকি। এই হাওর সিলেট ও মৌলবীবাজার জেলার পাঁচটি উপজেলায় ১৮ হাজার ৩৮৩ হেক্টর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। শীতে এই হাওর পরিণত হয় পরিযায়ী হাঁসের আবাসভূমিতে। এ হাওর বর্ষায় মিঠা পানির সমুদ্র হয়ে ওঠে আর শীতে পরিণত হয় ২৩৮টির মতো ছোট ছোট বিলে। ছোটখাটো পাখির জরিপ এখনো সম্পূর্ণভাবে করা না গেলেও ধরে নেওয়া হয় এখানে পাখির প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ১২০। এর মধ্যে আবার ৭৬টিই জলার পাখি। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-মেটে রাজহাঁস, চকাচকি, ফুলুরি হাঁস, ল্যাঞ্জা হাঁস, গিরিয়া হাঁস, খুন্তে হাঁস, মরচেরং ভূতি হাঁস, বড় সরালি, কালিম, কুট। এখানে আরো দেখা মিলবে বিশ্বে মহাবিপন্ন পাখি পাতি ভূতি হাঁসও। শীতকালে অতিথি বা পরিযায়ী পাখির একটা অংশ আসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যা¤পাসে। এখানেও পাখি কমতে শুরু করেছে। এছড়া বরিশাল, চট্টগ্রামের বিভিন্ন চরাঞ্চলে ও বিভিন্ন জলাশয়ে শীতে অতিথি পাখি ভিড় জমায়। এতে নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টিসহ পরিবেশের ভারসাম্য সৃষ্টি করে। কিন্তু আমরা অতিথি পাখি কমে যাওয়ার জন্য অনেকাংশ দায়ী। বাসস্থান সংকট, বিষটোপ ব্যবহার করে খাদ্যসংকট ও জীবন বিপন্ন করা, শিকার, পাচার ইত্যাদি কারণে আশংকাজনকহারে আমাদের দেশে শীতে পাখি আসার সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ক্যামেরার ক্লিক বা নিরবতা ভঙ্গ করলেও পাখিরা বিরক্তবোধ করে এবং অন্যত্র চলে যায়। আমরা বাঙালিরা জাবি, বাইক্যা বিল বা অন্যত্র অতিথি পাখি দেখতে গেলেই পাখির খুব কাছে যেতে চাই। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ক্যামেরার ক্লিক দিই। একই কারণে ভারতের পাখির অভয়াশ্রম গজলডোবাসহ পশ্চিমবঙ্গের অনেক পাখির আবাসস্থলে পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এ থেকে আমাদের সতর্ক হতে হবে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ক্যামেরা বা শব্দযন্ত্রের ব্যবহার প্রয়োজন ছাড়া একেবারেই কমিয়ে আনতে হবে।

পরিযানের সময় মূলত শিকারি পাখি, আবাসস্থল ধ্বংস প্রভৃতিই পরিযায়ী পাখির প্রধান শত্রু। আমাদের দেশে প্রতিনিয়তই পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে,খাবারের অনুপযোগী কিংবা মানুষের বসতি হয়েছে। একশ্রেণির লোভী, ব্যাধের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য দুর্লভ প্রজাতির অতিথি পাখি। জালের ফাঁদ পেতে, বিষটোপ এবং ছররা গুলি দিয়ে নির্বিচারে ও নির্মমভাবে এসব অতিথি পাখি শিকার চলছে প্রতিনিয়ত। কেউ শখের বশে আবার কেউ বাজারে বিক্রির জন্য অতিথি পাখিদের দিকে বন্দুকের নল উঁচিয়ে নিষ্ঠুর হাতে ট্রিগার টিপে এবং ফাঁদ পেতে অতিথি পাখিদের জীবন হরণ করে চলেছে। অতিথি পাখিদের বিচরণ ভূমি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। বন-জঙ্গল কেটে উজাড় করে ফেলায় পাখিরা হারাচ্ছে তাদের নিরাপদ আশ্রয়। আবার ফসলি জমিতে কৃত্রিম সার এবং মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে অতিথি পাখিরা বিষে আক্রান্ত কীট পতঙ্গ খেয়ে মারা যাচ্ছে। উপকূলে চিংড়ি চাষের ফলেও অতিথি পাখিদের বিচরণ ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের অনেক জলচর পাখি বিলে বসবাস করে। কিন্তু শীতে জলাশয় শুকিয়ে গেলে এরা দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এদের অধিকাংশই শরালি। বিশ্বের চরম শীতপ্রধান এলাকাগুলোর ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে। খাদ্য ও প্রজননের অনুপযোগী হয়ে পড়লে সেসব এলাকা থেকে পাখিরা উষ্ণমন্ডলীয় এলাকায় যায়। শীতে বাদাভূমিগুলো শুকিয়ে যায়। ফলে এ সময়টা পাখিদের জন্য দুঃসময়।

বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী, পরিযায়ী (অতিথি পাখি) পাখি হত্যার দায়ে একজন অপরাধীকে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদন্ড অথবা সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রয়েছে। একইভাবে কোনো ব্যক্তি যদি পরিযায়ী পাখির মাংস, দেহের অংশ সংগ্রহ করেন, দখলে রাখেন কিংবা ক্রয়-বিক্রয় করেন বা পরিবহন করেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হওয়ার আইন প্রচলিত রয়েছে। অতিথি পাখি নিধন এবং বাজারে বিক্রি নিষিদ্ধ জেনেও আইনের ফাঁক গলিয়ে এক শ্রেণির পেশাদার এবং সৌখিন শিকারি কাজগুলো করে চলেছে।

পাখি হলো প্রকৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। পাখি শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়ায় না,আমাদের অনেক উপকারও করে। পরিযায়ী পাখিরা আমাদের দেশেও এখন নিরাপদ নয়। মানুষের অজ্ঞতা ও অসচেতনতার ফলে এ দেশে পরিযায়ী পাখিরা আজ বিপন্ন। আমরা পাখির নাচ গান আর ওড়াউড়ি দেখব এবং উপভোগ করব। তবে সীমার মধ্যে, সতর্ক থেকে। আইন প্রয়োগে কঠোর হতে হবে। তবে আমরা সচেতন না হলে আইনে খুব একটা সফল পাওয়া যাবে না। প্রশাসনের সাথে আমাদেরকেও সহযোগিতা করতে হবে। মনে তো আছেই–‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?’

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এসবিডিই

আবু আফজাল সালেহ আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর