Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জালালকন্যা মরিয়মের চোখে লাশকাটা ঘর

ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
২২ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:৪৮

মুখটা ঢাকা কেবল চোখদুটো দেখা যাচ্ছে আর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের লাশকাটা হিমঘরের দিকে। চোখদুটো বিষন্ন, বিদ্ধস্ত আর একটি চোখ বেয়ে নেমে গেছে জলের স্রোত। যে হিমঘরে শুয়ে তার বাবা জালাল উদ্দিন (৪০), সে একজন গার্মেন্টস শ্রমিক। সাম্প্রতিক সময়ে গাজিপুরে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে তার মৃত্যু হয়। এই অশ্রশিক্ত বেদনার্ত মেয়েটার নাম জান্নাতুল বাকিয়া মরিয়ম (৯)। বেশ কিছুদিন ধরে ওর একটা করুণ মায়াময় ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সবাই এই শিশুটির ভবিষ্যৎ আর দুঃখজাগা মুখটি ভেবেই যন্ত্রনা বোধ করে সমবেদনা জানাচ্ছেন। কিন্তু যে জালাল মৃত তার তো আর কিছু করার নাই। এই জালাল আর কোন দাবিও তুলতে পারবেনা, পারবেনা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাতে। এই রাষ্ট্র সরকারও তার কথা শুনবে না, ভাববেনা। আঞ্জুয়ারা খাতুন (৩০) মারা যান জালাল মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে। এই মৃত্যুগুলো কখনই কোন হিসেবের মধ্যে পড়েনা। যেমন একজন সাংবাদিক, পুলিশ, আমলা, ছাত্র, শিক্ষক কিংবা ব্যবসায়ী মারা গেলে আমরা যেমন মাতম করি, বিচার চাই, শাস্তি চাই। ঠিক একই জায়গায় দাড়িয়ে আমরা কি একজন শ্রমিক হত্যার বিচার চাই? চাই না। কারণ এখানে শ্রেণী প্রশ্নটি খুবই জরুরি। এই শ্রমিকরা তাদের রক্তপানি করে আমাদের দেশকে সচল রাখলেও তাদের নূন্যতম মর্যাদা আমরা দিতে চাইনা। রাষ্ট্রও তাদের প্রতি উদাসিন।

বিজ্ঞাপন

আচ্ছা, আপনাদের কি তাজরিন গার্মেন্টসে অগ্নিকান্ডের কথা মনে আছে! যেখানে শতাধিকের বেশি শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছিলো। সরকারী তদন্তে মালিকদের গাফিলতির কথা সেখানে উঠে এসেছিলো, মালিককে গ্রেফতার করাও হয়েছিল। সেই হত্যাকান্ডের শিকার হওয়া শ্রমিকদের পরিবারের কোন খোঁজ কি আমরা কোনদিন নিয়েছিলাম বা এখনও নেওয়ার চেষ্টা করেছি, রাষ্ট্র নিয়েছে? নেয় নি। একই কথা আমরা রানা প্লাজার ঘটনার ক্ষেত্রেও বলতে পারি। এই হত্যাকান্ডের আসামীরা কিন্তু এখনও চূড়ান্ত বিচারের আওতার বাইরে, আবার কেউ কেউ জামিনে আছেন। এদের হয়তো শেষ পর্যন্ত কিছুই হবেনা, এর পাশাপাশি নিহত শ্রমিকদের পরিবারেরও কিছু হবেনা। তাদের খোঁজ কেউ নেয় না। না রাষ্ট্র, না রাজনৈতিক দলগুলো। কিছু শ্রমিক, গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠনগুলো বছরে দু’একবার তাদের মনে করেই হয়তো দায়িত্ব শেষ করবেন। এই যে এদেশে শ্রমিকদের হত্যার যে দুটি বড় বড় ঘটনা এই ঘটনাই প্রমাণ করে এদেশটি প্রকৃতপক্ষে শ্রমিকবান্ধব নয়। শ্রমিকের নুন্যতম অর্থে বেঁচে থাকার দাবি যখন এদেশে অপরাধ হয়, তখন এদেশে শ্রমিকদের আসলেই কিছু করার থাকে না। সরকার সাড়ে বারো হাজার টাকা মজুরি ঘোষণা করে গ্যাজেট প্রকাশ করেছেন, অধিকাংশ শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিকরা এই ঘোষণায় খুশি নয়। হয়তো এই মজুরি নিয়েই তাদের আবারও কাজে যোগ দিতে হবে। কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে এই টাকায় নূন্যতম অর্থে বেঁচে থাকার যে চেষ্টা তা কতটা ফলপ্রসু হবে সেটা কি আমরা বলতে পারি?

বিজ্ঞাপন

গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন কেন! কার স্বার্থে?

পৃথিবীর সকল জায়গায়, দেশে দেশে শ্রমিক আন্দোলন একটি ন্যায্য আন্দোলন হিসেবে স্বীকৃত। শ্রমিক আন্দোলনকে স্বীকৃতি দেয় না এমন দেশ নেই বললেই চলে। শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবি দাওয়াগুলো একটি নিয়মতান্ত্রিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আদায় করার ধারাবাহিক চেষ্টাটাকেই আমরা শ্রমিক আন্দোলন বলে থাকি। ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার, মজুরি বৃদ্ধি দাবি তোলার অধিকার, স্বাধীন মতামত প্রদানের অধিকারসহ নানান দাবি নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে উঠে। আমরা আজকে যে ৮ ঘন্টার শ্রম ঘন্টা হিসেবে সরকারী বেসরকারিসহ সকলেই যে কাজ করি তা কিন্তু এই শ্রমিক আন্দোলনেরই ফল। আজকে সাংবাদিক ইউনিয়ন, ব্যাংকার্স অফিসার কর্মচারী ইউনিয়ন, ঘাট শ্রমিক কিংবা রেল শ্রমিক, পরিবহন কিংবা হকার ও কুলি শ্রমিক ইউনিয়ন কোনটাই কিন্তু এই হিসাবের বাইরে পরে না। সরকারী কর্মকর্তারাও কিন্তু নিজেদের সমিতিসহ নানান পেশাজীবী সংগঠন করে থাকেন। এটাও কিন্তু একধরনের ইউনিয়ন কালচারই। তবে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এতো বাধা আর বিপত্তি কেন? কেন একজন গার্মেন্টস শ্রমিক ২৩/২৫ হাজার টাকা মজুরি চাইলে সবাই তাতে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে। আজকের মুক্ত বাজার অর্থনীতির যুগে ২৫ হাজার টাকার একটি সংসার চালানো কি খুব সহজ? ঢাকার নগর দরিদ্র মানুষদের নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে নূন্যতম অর্থে বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয় তা পাওয়া খুবই কঠিন হয়ে যায়। নগরে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, খাদ্য সকল কিছুরই মূল্য আকাশচুম্বি। আমরা চাইলেও এই মূল্যবৃদ্ধি জামানায় কোনভাবেই কম আয় দিয়ে সংসার চালাতে পারবোনা। এর মধ্যে নগরে প্রধানতম খরচের জায়গা হলো চিকিৎসা। শুধুমাত্র একটি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নগরে বস্তিবাসী ও গার্মেন্টস শ্রমিকরা বসবাস করে বলে তাদের রোগাক্রান্ত হবার সম্ভাবনা দশগুণ বেশি থাকে। তারপর সুপেয় পানি, পয়ঃনিস্কাষন, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে তাদের ভয়াবহ জীবনযাপন করতে হয়। তারা অসুস্থ হলেও তাদের চিকিৎসা কিন্তু ফ্রি না। পৃথিবীর অনেক দেশে এমনকি পাকিস্থান আমলেও শ্রমিক কলোনিতে স্কুল, মসজিদ, স্থাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও বর্তমানে শ্রমিক কলোনি নামে কোন শব্দের অস্থিত্ব নেই। তাই চিকিৎসা একটি ভয়াবহ সংকটের নাম। আমাদের পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ অনেক প্রদেশেই রেশনিং ব্যবস্থা আছে এবং শ্রমিকদের জন্যও সেটা প্রযোজ্য। এই রেশনিং তাদের জীবনকে অনেকটাই সহনশীল করে তুলেছে। পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমিকদের জন্য রেশনিংসহ নানান সুবিধাদি দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের এই বিশাল জনগোষ্ঠীর শ্রমিকদের জন্য নেই কোন রেশনিং ব্যবস্থা। যখন একজন শ্রমিক আগুনে পুড়ে কিংবা যেকোন দুর্ঘটনায় মারা যায় সেই শ্রমিক পরিবার কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোন ধরনের আর্থিক ক্ষতিপূরণ পায় না। আমরা তাজরিন গার্মেন্টসসহ এমন হাজারো ঘটনার কথা বলতে পারবো। কিংবা রানা প্লাজার মতন ঘটনা ঘটলে সেক্ষেত্রেও এই ক্ষতিপূরণ পাওয়াটাও বিশাল চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাড়ায়।

আমাদের শ্রমিক কি আমাদের শত্রু?

আমরা সবসময় গার্মেন্টস শ্রমিকদের কোন দাবি দাওয়ার বিষয় নিয়ে কথা বললেই আমরা বলতে থাকি এটা কোন গোষ্ঠীর ইন্ধনে ষড়যন্ত্র হচ্ছে কিংবা তাদেরকে কেউ ব্যবহার করছে। আর এরপরই তাদের উপর দমনপীড়ন এমনভাবে চালানো হয় যেন তারা আমাদের শত্রু। কেন আমাদের এই মানসিকতা? কেন আমরা শ্রমিকদের শত্রু হিসেবে দেখি? এই গার্মেন্টস শ্রমিকরা যখন দেশের বাইরে থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স নিয়ে আসে তখন কি আমরা তাদেরকে বিশেষ কোন কৃতিত্ব দেই! আমরা কি তাদের এ জাতির সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সন্তান বলি? কখনই না। বরং আজকে যে শ্রমিকের বুকে গুলি করে তাকে হত্যা করা হলো তার সন্তান কিভাবে বেঁচে থাকবে তারও কোন নিশ্চয়তা নাই। ঐ যে জালালের কন্যা মরিয়ম কাঁদছে ব্যাকুল হয়ে তার দায়িত্ব কে নিবে? সবাই কেবল আহ! উহ! করেই দায়িত্ব শেষ করবে। দীর্ঘদিন ধরে আমরা দেখেছি, বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানা বন্ধ করা হয়েছে। আমাদের ঐতিহ্য পাট ও পাটকলকে ধ্বংস করা হয়েছে। আমাদের সুতাকল, চিনিকল, রেশম কারখানাসহ যাবতীয় শিল্পকে ধ্বংস করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে খুলনা অঞ্চলে পাটকল শ্রমিকরা আন্দোলন করছে কিন্তু তাদের কথা শোনার কেউ নেই। রেলকে ধ্বংস করা হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে। আমাদের মতো দেশে রেল যেভাবে জনপ্রিয় হবার কথা ছিল স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে তা হয়নি। এই সকল শ্রমিক আন্দোলনের মূল বক্তব্যই হলো শ্রমিকদের মজুরিবৃদ্ধি, নূনতম অর্থে বেঁচে থাকার মতন মর্যাদাকর একটি অবস্থান। ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারটি আন্তর্জাতিক অধিকার হলেও আমাদের মতন দেশে এই অধিকারকে আজও সকল ক্ষেত্রে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করা, নির্বাচন করা, মজুরি নিয়ে দরকষাকষি করা, ভোটাধিকার, রেশনসহ যাবতীয় বিষয়গুলো নিয়ে এদেশের কথা বলার অর্থকেই রাষ্ট্র ও মালিক শ্রেণী ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মধ্যে ফেলে দেয়। এদেশে অধিকার আদায়ের জন্য বিচ্ছিন্নভাবেই প্রায় প্রতিদিনই লড়াই সংগ্রাম করতে হয় শ্রমিকদের। আমাদের দেশে শ্রমিক শ্রেণি ন্যূনতম মর্যাদা পায় না কোনো একটি সেক্টরেও। এদেশের শ্রমজীবীরা হলো কেবল পুঁজি তৈরির হাতিয়ার।

কোথায় গেলে পাবো তারে

শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য জায়গা থেকে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন, লড়াই সংগ্রাম করবে এটা তাদের অধিকার। কিন্তু মালিক পক্ষ যেভাবে ছাটাই এবং কাজ থেকে তাদের বিতাড়িত করার পদ্ধতি নিচ্ছেন তা কি কোন সমাধানের পথ? কারখানার সামনে ঝুলানো কর্ম খালি নাই, এটা যদি মালিকপক্ষের কৌশল হয়। আর শ্রমিকরা যদি ঠিক একই কৌশল নিয়ে কাজে যোগদান না করেন। তবে মালিকপক্ষকে বাধ্য বিদেশ থেকে অনেক বেশি মজুরিতে শ্রমিক আনতে হবে- যদি তারা এই সেক্টরকে বাঁচাতে চান। কারণ বাংলাদেশের মতন শস্তা শ্রম আর কোথাও পাওয়া যাবে না। তাই শুধু নয় বিশ্বব্যাপী এখানকার কাজের, শ্রমিকদের দক্ষতার সুনামও কিন্তু কম নয়। তাই সমাধানের পথ খোলা আছে। সেটা হলো শ্রমিকদের মর্যাদা দিতে হবে আর তাদের নূন্যতম অর্থে বেঁচে থাকার মতন মজুরিটাও নিশ্চিত করতে হবে। কোন শ্রমিক ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে নামলে রাষ্ট্র যদি মালিকপক্ষের হয়ে তার উপর জুলুম নির্যাতন চালায়, সেটাও বুমেরাং হবে। এই শ্রমিকরা যেহেতু এ দেশকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম হাতিয়ার, তাই তার প্রতি রাষ্ট্রের মানবিক ও মর্যাদার দৃষ্টি দেয়া জরুরি। শ্রমিকরা করুণা কিংবা হিংসা কোনটাই চায়না। মরিয়মদের দায় ও দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। সকলের শুভ বোধের উদয় হউক।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সম্পাদক, পরিবেশ বার্তা

সারাবাংলা/এসবিডিই

জালালকন্যা মরিয়মের চোখে লাশকাটা ঘর ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর