পুঁথি গবেষক ইসহাক চৌধুরীর দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহশালা
২৩ নভেম্বর ২০২৩ ২০:১৯
পটিয়া নয়া হাট পেরিয়ে গেলে দক্ষিন হুলাইন গ্রাম। আড়াকান সড়ক থেকে ৩ মিনিট হেঁটে গেলে পুঁথি গবেষক প্রয়াত আবদুস সাত্তার চৌধুরীর বাড়ি। সবুজে ঘেড়া গ্রামটি বাড়ির সামনে পুকুর, পাশে অমর পুঁথি গবেষক আবদুস সাত্তার চৌধুরীর সমাধি। এই বাড়িতে ইসহাক চৌধুরী ৩০ জুন ১৯৫২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাড়িতে প্রবেশ করলে চোখে পড়বে ড্রয়িং রূমে বিশাল সংগ্রহশালা।
ইসহাক চৌধুরীর মুলত তার পিতার কাছে পুঁথি পাঠের হাতেখড়ি। পিতার অনুপ্রেরণায় নিজের মেধা ও মননে পুঁথি সংগ্রহ ও সংরক্ষণে উৎসাহিত হন। তিনি ছিলেন বিবলিওগ্রাফার, পুঁথি গবেষক। পুঁথি নিয়ে জীবনের সাথে খেলা করা ছিল তার নেশা। সংগ্রহ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার পদে চাকুরীরত অবস্থায় নিয়মিত লিখেছেন চট্টগ্রামে জাতীয় দৈনিক পত্রিকায়। আশির দশকে লেখক ও গবেষক শামসুল হক কর্তৃক সম্পাদিত পটিয়া থেকে প্রকাশিত মাসিক অভয়বাণী পত্রিকার মাধ্যেমে লেখালিখি শুরু করেন। আবদুস সাত্তার চৌধুরী ইন্তেকালের পরে ইসহাক চৌধুরী পুঁথির সাগরে সাঁতরে বেড়িয়েছেন। ১৯৬৬ সাল থেকে বাবার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও জনপদে পুঁথি সংগ্রহের জন্য সাহিত্যের প্রতিটি পরতে পরতে বিচরণ করেছেন। ইসহাক চৌধুরী ছিলেন লোকসাহিত্যের কিংবদন্তি- অনেকটা জীবন্ত অভিধানও বলা যায়। ৫৭ বছরের পুরানো সংগ্রহশালায় বইয়ের থাকে পুঁথি বই ছাড়াও বৃটিশ আমলে পটিয়া কাগজী পাড়ায় হাতে তৈরী কাগজ পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রেখেছেন। এছাড়ার রয়েছে ইতিহাস ঐতিহ্য বিভিন্ন বই, গল্প, কবিতা, ধর্মীয় গ্রন্থ বিশেষ করে সুফি সাধকদের জীবনিসহ আরো নানা দুর্লভ বই। বুক সেলফে তরে তরে সাজানো রয়েছে।
তার দুর্লভ সংগ্রহ পুঁথির মধ্যে রয়েছে, কবি সৈয়দ গাজী বিরচিত শাস্ত্র বার্তা, কবি জমসের আলী বিরচিত চারি মোকামবেদ, মহিলা কবি বিরচিত স্বামীর বিলাপ, কবি শরফুদ্দিন বিরচিত কোরআনের মাহাত্য বয়ান, কবি আবদুল মজিদের বে-নজির বদরে মুনির, কবি জামাল উদ্দিনের শরা শরীয়ত বিষয়ক, কবি রহমত শরা শরীয়ত বিষয়ক , কবি রূপগাজী শরা শরীয়ত বিষয়ক, কবি শ্রী বুদ্ধদেবের ঔষধী শাস্ত্র, কবি ছৈয়দ আহমদুল্লাহ ঔষধী শাস্ত্র, কবি আজমুল্লাহ বিরচিত খোলাছাতুন মুছল্লিন, কবি ছৈয়দ আলম বিরচিত হিন্দুয়ানী ইমামের ছাওয়াল, কবি শেরবাজ বিরচিত মহ্ববত নামা, কবি মোহাম্মদ হোসেন বিরচিত শরা শরীয়ত, কবি লাল খান শাহ বিরচিত মুসানামা, কবি মনচুর শাহ রচিত যোগ কালন্দর, কবি সুমন বিরচিত সুগত শাসন, কবি আমির উদ্দীন বিরচিত মনচোরের কেচ্ছা, কবি হিলাল খা বিরচিত নূর নামা। এসব পুঁথি কিছু কাগজে লেখা, কিছু তালপাতায় লেখা, কিছু তুলট কাগজে লেখা।
ইসহাক চৌধুরীর সংগ্রহশালায় প্রায় তিন হাজারেরও অধিক বই আছে। হাতে লেখা পবিত্র কোরআন শরিফও আছে। ক্ষুদ্র আকারের একটি দুর্লভ কোরআন শরিফ আছে যেটি তেলওয়াত করতে হলে আতশী কাঁচের প্রয়োজন হয়। ইসকাহ মামা জীবদ্দশায় তিনি ভাদ্র মাসে খর রোদের মধ্যে সংগ্রহশালার পুঁথিগুলো নাড়াচাড়া করে যত্ন সহকারে শুকাতেন। কোন বই/পুঁথি যদি দেখে যে কীটপতঙ্গের হামলায় আহত হয়েছে ইসহাক মামার মন খারাপ থাকতো দু চারদিন নাওয়া খাওযা বন্ধ করে বাকরুদ্ধ থাকতেন। আহমদ ছফার একটা লেখায় পড়েছিলাম অধ্যাপক আবদু রাজ্জাক স্যার নাকি পুরোনো দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থসমুহকে “পাঁজরের হাড়ের মতো রক্ষা করতেন। যে সকল বইয়ের পাতা বিবর্ণ হয়ে এসেছিল যত দিন নাকি সক্ষম ছিলেন, নিজের হাতে বই গুলো যত্ন করতেন, মুছতেন, রোদে দিতেন এবং পাউডার ছড়াতেন”। ইসহাক মামাকে আমি দেখেছি তার সংগৃহিত বই- তার প্রয়াত বাবা পুঁথিগবেষক আবদু সাত্তার চৌধুরীর সংগৃহিত পুঁথির পাতায় যেন তার বাবার স্মৃতি খুঁজে ফিরতেন। ৫৭ বছেরের সংগ্রহশালাটি সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পরম যত্নে হৃদয়ের সিন্দুকে আগলে রেখেছিলেন। আমি মনে করি যারা বই ভালো করে পড়তে পারে তারা মানুষের হৃদয়ের না বলা পা-লিপিও পড়তে পারে মানুষের মনের অলিতে গলিতে অবাধে বিচরণ করতে পারে। সে জন্য বোধহয় বই অনন্ত যৌবনা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকালীন ইসহাক চৌধুরীকে পুঁথি গবেষণার কাজে উৎসাহ দিয়েছেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুলতান আহমেদ এবং অধ্যাপক ডক্টর মনিরুজ্জামান স্যার। একদা মালঞ্চ কর্তৃক আয়োজিত পটিয়ায় ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আবদুল করিমের স্মরণ সভায় ডক্টর মনিরুজ্জামান স্যার ইসহাক চৌধুরীকে নিয়ে বলেছিলেন, “আমি ডক্টর অধ্যাপক হতে পারি কিন্তু আমার চেয়েও অনেক বড় ডক্টর হলো আমার ইসহাক চৌধুরী। তার পুঁথি গবেষণা, লোক সাহিত্য ও ইতিহাস বিষয়ে পান্ডিত্য আমাকে মুগ্ধ করে”।
ইসহাক চৌধুর পুঁথিগবেষণায় পান্ডিত্য আজও আলোর দ্যুতি ছড়াচ্ছে। পুঁথি সাহিত্যে নিবেদিত প্রাণ হিসেবে সর্বশেষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন ইসহাক চৌধুরী। ইসহাক চৌধুরী মামা আমার কাছে ছিলেন অনেকটা জীবন্ত অভিধানের মতো। একসময় ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে দৈনিকপূর্বকোণের শহর থেকে দূরে নামে একটি পাতা ছিলো আমি নিয়মিত লিখতাম। কোন তথ্যর প্রয়োজন হলে ছুটে যেতাম ইসহাক মামার কাছে। তার কাছে গেলে সমাধান পেতাম। তিনি ছিলেন আমার লেখালিখির গুরুজী যার কাছ থেকে আমি প্রতিনিয়ত শিখেছি। লেখার জন্য ভীষণ অনুপ্রাণিত করতেন। ইসহাক মামার সংগ্রহশালায় বই নিয়ে আড্ডায় বসলে সময় যে কিভাবে চলে যেতো টেরও পেতাম না। মামার সংগ্রহশালা থেকে যখন বাড়ি ফিরতাম তিনি বাড়ির উঠোন থেকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন। ইসহাক মামার মেয়ে প্রভাষক জান্নাতুল নাঈম বলেন, ‘বাবা শুধু একজন গবেষক ছিলেন না তিনি ছিলেন অনেকটা বই পোকার মতো, সংগ্রহশালায় বসে বসে বই পড়তেন লিখতেন, গবেষণা করতেন। বাবাকে অনেকে তার সংগ্রহশালা দুর্লভ পুঁথিগুলো টাকা দিয়ে কিনতে চেয়েছিলেন। অনেকে অনলাইনে সফট কপি দিয়ে পেইজ করতে চেয়েছিলেন। বাবা চাইলে বিক্রি করতে পারতেন তিনি তা করেন নি। তবে যারা গবেষণার জন্য, লেখার জন্য সহযোগিতা চেয়েছেন, বাবা তাদেরকে সবসময় সহযোগিতা করে গেছেন। আমাদের ইচ্ছে আছে বাবার সংগ্রহশালাটি আমরা সংরক্ষণ করব’।
পুঁথিগবেষক ইসহাক চৌধুরী নিজ গ্রামে বড় হয়েছেন। গ্রামীণ জীবনযাপন ছিল তার পছন্দের। কখনও শহরে থাকতেন না। বেশ মিষ্টভাষীও বিনয়ী ছিলেন। খুব সহজে মানুষকে আপন করে নিতেন। মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থাকতেন। খুব সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। বেশ ধার্মিকও ছিলেন। এতিমখানার ছাত্রদের খাওয়াতে পছন্দ করতেন। আতিথেয়তা, আপ্যায়ন এবং প্রিয়জনদের দাওয়াত করে খাওয়ানো ছিল তাঁর বড় গুণ। বই পড়তে বেশ পছন্দ করতেন। কখনও পরিবারের সদস্যদের সাথে অভিমান করলে তিনি বই নিয়ে বসে যেতেন। বই ছিল ওনার কাছে মনের দাওয়াইর মতো।
পুঁথিগবেষক ইসহাক চৌধুরী গ্রামীণ লোকসাহিত্য, ইতিহাস, পুঁথিগবেষণা বিবলিওগ্রাফার হিসেবে সংগ্রাম ও সাধনা করে গেছেন। তার সংগ্রহশালার প্রতিটি পুঁথির পরতে পরতে মুহুর্মুহু বেজে উঠেছে লোক সাহিত্যের আনন্দিত আতœা ইসহাক চৌধুরীরা মরেও অমর হয়ে থাকবেন অনন্তকাল। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পুঁথিগবেষক ইসহাক চৌধুরীর সংগ্রহশালাটি নিয়ে ইসহাক চৌধুরী একাডেমি স্থাপন করা হলে আগামীর প্রজন্মরা পুঁথি নিয়ে গবেষণা করতে পারবে। গত ২৩ নভেম্বর ২০২০ সালে কীর্তিমান ইসহাক চৌধুরী না ফেরার দেশে চলে যান। কীর্তিমান পুঁথিগবেষক ইসহাক চৌধুরীর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী তে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: কলামিস্ট, সমন্বয় সহকারী; ইতিহাসের খসড়া
সারাবাংলা/এসবিডিই
পুঁথি গবেষক ইসহাক চৌধুরীর দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহশালা মুক্তমত রশীদ এনাম