শিক্ষার্থীদের ভালো-খারাপ রেজাল্ট ও অভিভাবকদের দায়
২৬ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:১৭
ছেলের স্কুলের প্রধান শিক্ষককে লেখা আব্রাহাম লিঙ্কনের সেই চিঠি কিংবা পরীক্ষার আগে অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে লেখা সিঙ্গাপুরের এক স্কুলের প্রিন্সিপালের চিঠি ফেসবুকের কল্যাণে মোটামুটি সবাই অবগত। দু’টো চিঠিই বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় কনসেপ্ট ‘মোটিভেশনাল স্পিচ’-এর চমৎকার উদাহরণ। আর এখনতো মোটিভেশনাল স্পিচ মোটামুটি বাণিজ্যিক পর্যায়ে চলে গেছে যেখানে টাকা দিয়ে আমরা সাইকলজিস্টদের কথা শুনি আর ইউটিউবারদের ভিডিও দেখি। এতে কতটুকু কী উপকার হয় সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। দেখা যায়, যে কথাগুলো বিনে পয়সায় স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে আমাদের শিক্ষকরা বলেন বা আমাদের অভিভাবকরা বলতে বলতে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে যান, সেগুলোই আমরা টাকা খরচ করে শুনি।
যাই হোক, শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি পরীক্ষার রেজাল্টের সময় হলে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের হাইপারটেনশন। ডিভিশন, ক্লাস কিংবা জিপিএ নিয়ে যে উদ্বেগ এবং প্রতিযোগিতা, সেটা শিক্ষার্থী তথা পরীক্ষার্থীদের মনের ওপর এমন প্রভাব ফেলে যে অনেক সময় কারো কারো জীবনে দুঃখজনক পরিণতি বয়ে আনে। বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া বা আত্মহত্যা করার মতো ঘটনা প্রায়ই খবরের কাগজের শিরোনাম হয়। এজন্য বিরাজমান অসুস্থ প্রতিযোগিতা যেমন দায়ী তেমনই দায়ী শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের অতিরিক্ত উচ্চাশা।
প্রত্যাশা মোতাবেক রেজাল্ট না হলে অভিভাবকরা হতাশ হন এবং ছেলেমেয়েদের দোষারোপ করেন। ক্লাসে প্রথম না হওয়া, জিপিএ-৫ না পাওয়া বা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল করতে না পারা নিয়ে এই যে অস্থিরতা, সেটা সমাজে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তার শিকার হয়ে বহু শিক্ষার্থীর অমূল্য জীবন হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় এবং ধ্বংস হয়ে যায়।
আমার বয়েসীরা স্বীকার করবেন, ৪০/৪৫ বছর আগে আমাদের জীবনে এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রতিযোগিতা না আমাদের ছিলো না ছিলো আমাদের অভিভাবকদের মধ্যে। কেউ পড়তে বসতে বলেনি, স্কুলে যাচ্ছি কি না যাচ্ছি খবর নেয়নি, পরীক্ষা কেমন হচ্ছে কখনো কেউ জানতে চায়নি। সত্তর আশির দশকে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি স্কুলে বৃত্তি পাওয়া বা এসএসসি এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করা নিয়ে আমাদের অভিভাবক, আত্মীয়স্বজন বা পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে কোনো আনন্দ উল্লাস বা উত্তেজনা কিছুই ছিলো না।
ফিরে তাকালে মনে হয়, যেন আমাদেরকে প্রকৃতির কোলে ছেড়ে দিয়ে মনে করা হতো- ‘মানুষ হলে হ না হলে জাহান্নামে যা’। এখানে আমি শুধু আমাদের মতো অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা বা পর্যাপ্ত পারিপার্শ্বিক সুবিধাবঞ্চিতদের কথা বলছি। সমাজে শ্রেণিবৈষম্য তখনও ছিলো এখনও আছে। কিন্তু চার যুগের ব্যবধানে একটি স্বাধীন দেশের জন্ম যেমন হয়েছে তেমনই অর্থনৈতিকভাবে দেশের মানুষের সামগ্রিক অবস্থাও বদলেছে তথা অনেক উন্নত হয়েছে। জনসংখ্যা বেড়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে, শিক্ষার সুযোগসুবিধা বেড়েছে, স্বাক্ষরতার হার বেড়েছে। এমনকি বর্তমান সময়ের একটি সাধারণ চিত্র হচ্ছে স্কুল, কলেজ এবং টারশিয়ারি লেভেল পর্যন্ত ছেলেদের চাইতে মেয়েরা সংখ্যা এবং ফলাফলে অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। একইসাথে মানুষের প্রত্যাশা ও প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। এটাই স্বাভাবিক।
সারাদেশে আগামীকাল এইসএসসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হবে। পরীক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের প্রতি বিনীত পরামর্শ থাকবে, ফলাফল যাই হোক না কেন স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করুন। শিক্ষার্থীরা মেনে নিন আপনার প্রস্তুতি অনুযায়ী এটাই আপনার প্রাপ্য ছিলো। আপনার প্রত্যাশার একটা লেভেল থাকতেই পারে। সেটা না হলে জীবন অর্থহীন হয়ে যাবার কোনো কারণ নেই। কোনো কারণে প্রত্যাশিত ফল না হলে অভিভাবকরা সন্তানের পাশে থাকুন। তাকে গালমন্দ না করে ভরসা দিন, উৎসাহ দিন। একটি পরীক্ষার ভালো বা খারাপ ফলাফলের চাইতেও জীবনটা অনেক মূল্যবান আপনি বুঝুন আপনার সন্তানকেও বুঝিয়ে তার ভরসার মানুষটি হয়ে উঠুন। সবার প্রতি শুভকামনা।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, নবাব ফয়জুন্নেসা সরকারি কলেজ, কুমিল্লা
সারাবাংলা/এসবিডিই
প্রফেসর বাবুল চন্দ্র শীল মুক্তমত শিক্ষার্থীদের ভালো-খারাপ রেজাল্ট ও অভিভাবকদের দায়