মনির উদ্দীন ভাসানীর সংগ্রামী জীবন
২৬ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:৫৪
আমরা যখনি বিপ্লবীর প্রতিকৃতি স্মরণ করি তখনি উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে প্রথম কমিউনিস্ট দেশ রাশিয়ার বিপ্লবের মহান নায়ক লেনিনের ছবি। আরও ভেসে ওঠে তারুণ্যের রোমান্টিক বিপ্লবী হিসেবে খ্যাত চে গুয়েভারার নাম। যে রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা নেই, সে রাষ্ট্র স্থবির, বদ্ধ ডোবার মতো। তাই বিপ্লবীরা জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলেন। তারপর তাদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য শ্রম, পুঁজি, কারখানা, যন্ত্র, মেশিন, বাজার, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি সব শেখান। মহামতি কার্ল মার্ক্সের ভাষায়, পুঁজি হলো ঘনীভূত শ্রম।
উদ্বৃত্ত মূল্যে কার কী অবদান? ব্যক্তিমালিকানায় শ্রমিক মালিক কর্তৃক কীভাবে শোষণের শিকার হন এসবই তত্ত্ব দিয়ে বিপ্লবীরা শোষিত মানুষের জ্ঞানকে শানিত করেন। তেমনি বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আজীবন বিপ্লবীর জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে স্মৃতিচারণ করছি _
বিপ্লবী-সংগ্রামী কমরেড মনির উদ্দীন ভাসানী। কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের মুক্তি আন্দোলনের আলোকবর্তিকা, তেভাগা আন্দোলনের কনিষ্ঠ কর্মী, ভাষা সৈনিক, দেশমাতৃকার স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। আজ তিনি স্মৃতির আড়ালেই পড়ে আছেন অনেকটা।
যিনি মানুষের অধিকার আদায়ে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছেন মনির উদ্দীন ভাসানী। রাজনীতিবিদ কৃষক নেতা, ভাষা সৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা কমরেড মনির উদ্দীন ভাসানীর প্রয়াণ দিবসে তার সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। কারণ তার সংগ্রামী জীবন থেকে নতুন প্রজন্মের শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছুই আছে। মনির উদ্দীন ভাসানী ১২ জুন ১৯৩০ সালে নীলফামারী জেলা ডিমলা উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের ভাসানী পাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
মনির উদ্দীন ভাসানীর বাবার নাম আয়েজদ্দীন সরকার ও মায়ের নাম গুলধন বিবি। তিনি পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান। তিনি গোমনাতী উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়তেন। তখন ১৯৪৯ সালে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ, যা পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ নামে গঠিত হয়। তখন থেকে ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির একজন তরুণ কর্মী ছিলেন।
১৯৫০ সালের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এর আহবায়ক ছিলেন আবদুল মতিন। পরবর্তীতে ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়। ৩১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধিদের এক সভায় ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়, যার আহবায়ক ছিলেন কাজী গোলাম মাহবুব। এ সময় সরকার আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব পেশ করে। এর বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি (একুশে ফেব্রুয়ারি) সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল, জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে স্লোগানে রাজপথে ছিলেন মনির উদ্দীন ভাসানী। তিনি তৎকালিন ডিমলা থানার ভাসানী ন্যাপের সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন । তিনি সে সময়ের ন্যাপের সমর্থক তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে পৌঁছাতেন। সেই সাথে তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিতেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদদের স্মৃতিতে নির্মিত বধ্যভূমি ২নং বালাপাড়া ইউনিয়নে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মনির উদ্দীন ভাসানী কাঠের নির্মিত মিনারে প্রথম স্তম্ভ নির্মাণ করে শহীদদের সম্মান জানানোর প্রচলন শুরু করেছিলেন। স্বাধীনতাত্তোর তিনি দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি হক সাহেবদের ইপিসিপি এম এল পার্টিতে এবং অল্পদিনের মধ্যে ১৯৭৩ সালে কমরেড ইদ্রিস লোহানী, সত্য মৈত্র ও শরদিন্দু দস্তিদারদের নেতৃত্বধীন বাংলাদেশের মার্কসবাদী লেনিনবাদী পার্টির বৃহত্তর রংপুর জেলার জেলা কমিটির একজন অন্যতম সদস্য হিসেবে দায়িত্ত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় নিজ প্রচেষ্টায় লঙ্গরখানা চালু করেন। সে সময় কর্মহীন মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য ধান ভানবার ঢেঁকি নির্মাণ করে গ্রামের দুঃস্থ মহিলাদের মাঝে বিতরণ করেন। তার নেতৃত্বে ডিমলায় ভূমিহীনদের জন্য খাস জমি উদ্ধারের আন্দোলন হয়। সেই সাথে পার্টির নেতৃত্বে ভারতের কমরেড চারু মজুমদারের শ্রেণি শত্রু খতমের রাজনৈতিক লাইনের বিরোধীতা করে জোতদারের ফসল দখল করার রণকৌশল গ্রহণ করেন।
আর তা কার্যকরী করার জন্য ১৯৭৫ সাল থেকে ৭৬ সালের দিকে বৃহত্তর রংপুর জেলার ৪টি থানায় জোতদারদের ফসল দখল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। থানাগুলো মধ্যে ছিল মিঠাপুকুর, কালিগঞ্জ, বদরগঞ্জ ও ডিমলা। মনির উদ্দিন ভাসানীর নেতৃত্বে ডিমলা থানার বালাপাড়া ইউনিয়নসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের হাজার হাজার গরিব, কৃষক, শ্রমজীবী ও ভূমিহীনদের নিয়ে শ্রেণি সংগ্রামের ভিন্ন রূপ মনে করে জোতদারদের ধান কাটা অর্থাৎ ফসল দখল করেছিলেন। এরমধ্যে খগাখড়িবাড়ির বৃহৎ জোতদার মশিউর রহমান জাদু মিঞার পরিবারের ৬ শত একর জমির ফসল দখলের আওতায় ছিল।
এ ঘটনার পর তার নামে থানা থেকে হুলিয়া বের হয়। তাকে এবং তার নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশি আক্রমণ শুরু হয়েছিল। তিনি তখন পার্টির নির্দেশ মত আত্ম গোপনে যান। তাকে ধরার জন্য বার বার তার বাড়িতে পুলিশ আক্রমণ করেছিল। তাকে থানায় উপস্থিত হতে বাধ্য করার জন্য তিনবার তার বাড়ি-ঘর ভেঙে বাড়ির সকল আসবাবপত্র সহ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার পরিবারকে খোলা আাকাশের নিচেও বাস করতে বাধ্য করা হয়েছিল। পুলিশ তার পরিবারকে সাহায্য সহযোগীতা না করতে তার আত্মীয় স্বজনসহ পাড়া প্রতিবেশীদের ভয়ভিতি প্রদর্শন করা হয়েছিল। ফলে অনেকেই তার পরিবাবের সাথে সম্পর্ক রাখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
তিনি আত্মসমর্পণ না করে তার পার্টির আাদর্শ বাস্তবায়নে রংপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন চালিয়ে যান। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর জাসদ নির্মূল অভিযান শুরু করে। সে সময়ে মেজর হারুন পরবর্তীতে মেজর জেনারেল হয়ে সেনাবাহিনী প্রধান হয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে নীলফামারীতে জাসদ নির্মূল অভিযান শুরু হয়। সেই সাথে তিনি মনির উদ্দিন ভাসানীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তখন তার ভাগিনা বীর মুক্তিযোদ্ধা তবিবুল ইসলাম জাসদের রাজনীতিতে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হয়ে ওঠেন।
নিজের ভাগিনাকে গ্রেফতারের হাত থেকে রক্ষার জন্য তিনি পার্টির সেল্টারে সেল্টারে লুকিয়ে রাখার চেষ্ঠা চালিয়েছিলেন। যা মেজর হারুনসহ তৎকালিন ক্ষমতাসীন সরকারকে বিক্ষুব্ধ করেছিল। যার ফলে তাকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশ ও সেনাবাহিনী মরিয়া হয়ে উঠেছিল এবং নিজের এক আত্মিয়ের বিশ্বাস ঘাতকতায় ১৯৮০ সালে গ্রেফতার হন। গ্রেফতারের পর তিন মাস জেল খানায় আটক থাকেন।
আটক থাকাকালিন সময়ে ডিমলার ভাসানী ন্যাপের এককালিন কেন্দ্রীয় সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিঞা বিএনপির সিনিয়র মন্ত্রী হিসেবে তার সাথে যোগাযোগ করে প্রস্তাব দেন বিএনপিতে যোগ দিলে তাকে বড় পদসহ তার সকল মামলা থেকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং সকল সুবিধা পাবেন। কিন্তু তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। শেষে তিনি আইন প্রক্রিয়ায় জামিন নেন এবং নিজের জমি বিক্রি করে দীর্ঘদিন মামলা চালিয়ে মামলা থেকে মুক্তি লাভ করেন।
পরবর্তীতে পিকিং পন্থি রাজনৈতিক দল সমূহের ঐক্য প্রক্রিয়ায় তিনি কমিউনিস্ট লীগ, ইউনাইটেড কমিউনিস্টলীগ হয়ে বর্তমান রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নীলফামারী জেলায় প্রধান ভূমিকা পালন করেন। আজীবন বিপ্লবী বামপন্থী কৃষক নেতা মনির উদ্দীন ভাসানী ২৭ জানুয়ারি ২০২০ সালে নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি গ্রামীণ মানুষের চেতনাকে শানিত করার জন্য তার নিজ জমিতে মুক্তিযোদ্ধা পাঠাগার গড়ে তোলেন যা গোটা দেশের জন্য একটি অনন্য চেতনার অংশ। তার নেতৃত্বে বালাপাড়া ডাঙ্গারহাটে মনির উদ্দীন ভাসানী নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। তিনি বালাপাড়া ইউনিয়নব্যাপী সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে বিকশিত করার পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত তিনি কৃষক শ্রমিক মেহনতী মানুষের জন্য লাল পতাকার লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন। তার রাজনৈতিক জীবন ছিল অত্যন্ত বর্ণ্যাঢ্য। কৃষকের ফসলের ন্যায্য মূল্য ও ন্যায্য মূল্যে সার প্রাপ্তির আন্দোলন, ঘুষ দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনসহ নানা ধরনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নীলফামারী জেলার প্রথম সারির নেতৃত্ব হিসেবে ভূমিকা রাখেন।
স্বাধীনতা ৫৩ বছরের বাংলাদেশে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিৎকার শোনা যায়। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ভীরে প্রকৃত, ত্যাগী, দেশপ্রেমিক ও বীর সন্তান মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও জীবন সংগ্রাম চাপা পড়ে আছে। মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি না নিয়ে মনির উদ্দীন ভাসানী মৃত্যুবরণ করছেন ঠিক, কিন্তু তার স্বপ্নের মৃত্যু হয় নি। তার স্বপ্ন ছিল শিক্ষা হবে কোনো পণ্য নয়, শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। হাসপাতাল কোনো কসাইখানা নয়, হাসপাতাল অর্থাৎ চিকিৎসা সেবা বিনামূল্যে সার্বজনীন। শ্রমিকের শ্রম চুরি নয় ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতকরণ। কৃষকদের কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য। জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। আজও তার সংগ্রামী জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে বিপ্লবী বন্ধুরা তার স্বপ্ন পূরণের জন্য রাজপথে মুক্তির স্লোগান দেয়। লাল সালাম কমরেড।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
মনির উদ্দীন ভাসানীর সংগ্রামী জীবন মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ