লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা: প্রতিরোধের পাশাপাশি চাই শিক্ষা
২৭ নভেম্বর ২০২৩ ১৪:১০
হো চি মিন ইসলামকে নিয়ে সম্প্রতি যে তোলপাড় শুরু হয়েছে এবং তার পক্ষে বিপক্ষে যে যুক্তি প্রতিযুক্তি চলছে, তার পেছনের আমাদের আসলে জ্ঞান কতটুকু? কেন আমরা ট্রান্স নারীকে সহ্য করতে পারছি না? আমার বিশ্বাস, এর মূল কারণ, আমাদের এই বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকা এবং প্রতিষ্ঠানের বাস্তব জ্ঞানহীন মার্কেটিং পলিসি।
সেক্সুয়াল আইডেন্টিটি এবং জেন্ডার একেবারেই ভিন্ন বিষয়। একজন মানুষ শারীরিকভাবে পুরুষ না নারী সেটি তার জন্মের সময়েই নির্ধারণ করা যায়। এটি মানুষের যৌনাঙ্গের ভিত্তিতে নির্ধারিত। কিন্তু শরীরের অঙ্গের বাইরেও নানা ধরণের অনুভূতি আছে, হরমোন আছে, মানসিক পছন্দ, শারীরিক পরিবর্তন, যৌনাঙ্গের পরিবর্তন বা প্রভাবিত হওয়ার ব্যাপার আছে। সেটির ভিত্তিতে মানুষের জেন্ডার নির্ধারিত হয়। যেমনঃ হাসপাতালে সেক্স অপশনে আমরা যে নারী বা পুরুষ লিখি তা সম্পূর্ণভাবে আমাদের শরীরের কারণে। আবার একজন পুরুষ শারীরিক আইডেন্টিফিকেশনে পুরুষ হলেও জেন্ডারের ভিত্তিতে নারী হতেই পারেন।
এই সামান্য ব্যাখ্যাটুকু আমাকে নানা স্থানে বলতে হয়েছে। সেক্স শব্দটি শুনে আমি প্রচুর প্রগতিশীল, আধুনিক ও সফল মানুষকে চমকে যেতে শুনেছি। নারীদের লজ্জার কথা জোরে বলতে নেই। আমরা সেক্স মানে বুঝি যৌনতা। দরজা বন্ধ করে বলার কথা। এফডিসি’র ডালিয়া ফুলের টোকাটুকি। যা আবার বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে করতে হয়। কিন্তু সেক্স যে আসলে মানুষের লিঙ্গ, শারীরিক সম্পর্ক নয় এইটা আমাদের ট্রান্সলেশনের মধ্যে পানিতে ডুবে গেছে।
বাংলাদেশের প্রচুর ডেজিগনেশন হোল্ডার জেন্ডার কর্মীরা খুবই এলিট। তারা এসির নিচে বসে বড় বড় আলাপ দেন কিন্তু প্রত্যন্ত বাংলায় কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, তার থেকে বড় কথা সেখানকার বাস্তবতা কী সে সম্পর্কে বই পুস্তকে পড়া বা জীবনের শুরুতে দুই চার বছর এনজিওতে কাজ করা ছাড়া কোনো জ্ঞান রাখেন না। একটা মেয়েকে কেন ধর্ষকের সাথে বিয়ে দেয়া হয়, এই বাস্তবতা তারা জানেন না। তারা মনে করেন, মানুষ হতে পারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কিন্তু পারিবারিক সহিংসতার শিকার হলে, গায়ে হাত তুললে, পরকীয়া করলে, তাকে অবশ্যই স্বামীকে ফেলে চলে যেতে হবে। কই যাবে, কীভাবে যাবে, কী খাবে, সেখানে কী হবে এসবের চিন্তার বালাই তাদের নাই। যার অনেকখানি প্রতিফলন আমরা দেখতে শুরু করেছি।
১৬ দিন ব্যাপী লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার যে ক্যাম্পেইন, সেখানে ঢালাওভাবে যে নারী ও শিশুর অধিকারের কথা বলা হয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, পুরুষেরা কি লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয় না? আপনারা কি জানেন, অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের সময়ও মানুষের অর্গাজম হতে পারে। এবং এটি পরিবর্তিতে সে মানুষকে ভয়াবহভাবে মানসিক নিপীড়নের ভেতর ফেলে দেয়? পৃথিবীতে প্রচুর পুরুষ লিঙ্গভিত্তিক ধর্ষণ সহিংসতার শিকার হয়। তার থেকে বড় কথা, পরিবারে যে মানুষটা সহিংসতায় বিশ্বাস করে এবং করে, তাকে যদি বদলাতে না পারেন, তাহলে ভিক্টিমকে বদলে, প্রতিবাদী ও জ্ঞানী করে আসলে কী করছেন?
আমাদের দেশে সহিংসতার ক্ষমতার বড় উৎস পুরুষ, এবং শ্বশুর বাড়ি স্থানীয় নারীরা। আপনি নারীকে বোঝালেন তার অধিকার, কিন্তু সে অধিকার তাকে যারা দিবে, তারা কোথায়? এভাবে আসলে সম্ভাব্য ঝুঁকি তৈরি করে আপনারা আরও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছেন। এক এলাকার মেয়েদের খোলা পোশাক নিয়ে আপত্তি থাকলে দশজন খোলা কাপড় পরে ঘুরে বেড়ানোটা প্রতিবাদ না। এটা কালচার শক এবং স্থানীয় মেয়েদের জীবন নরকে পরিণত করার মতো অবিবেচকেতা। উচিত হচ্ছে, ওই এলাকার পুরুষ ও নারীদের ধীরে ধীরে বিষয়টি বোঝানো ও পরিবর্তনের জন্য তৈরি করা।
একটা কমিউনিটিকে ব্যাকগ্রাউন্ডট না বলে, জেন্ডার সেন্সেটাইজেশনের ভেতর দিয়ে না নিয়ে যদি বলেন, আপনারা ট্রান্স নারীকে সম্মান দেন, তার কথা শোনেন, তাকে আইডল মানেন বিষয়টা কাজ করবে? কেন কাজ করবে? আমি যদি ২৩-২৪ বছর পর্যন্ত জানি পৃথিবীতে লিঙ্গ দুইটা, বাকি সব অস্বাভাবিকতা, আপনি আমাকে না বুঝিয়ে, না শিখিয়ে শুধু মার্কেটিং এর জন্য এই টানেলের ভেতর ঠেলে দিতে পারবেন না।
হো চি মিন ইসলাম, একজন সফল ট্রান্স নারী এবং তিনি বহু ট্রান্স নারী ও পুরুষকে মোটিভেট করার ক্ষমতা রাখেন। তাকে যদি তার পরিবেশে, তার মতো করে উঠে আসতে চাওয়া, একই যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যাওয়া, একইভাবে নিপীড়িত হওয়া মানুষের কাছে তুলে ধরা হতো, পৌঁছে দেয়া যেতো, তাহলে সেটি হতো সফল ক্যাম্পেইন। যার প্রয়োজন তাকে না দিয়ে বাকিদের ফোর্স ফিড করালে তো হবে না।
একজন প্রফেশনাল নার্সের কথা কেন একদল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছেলে মেয়েকে কেন বলতে হবে? কেন ধরে নেয়া হচ্ছে, টিভিতে দেখানো ট্রান্স নারীর নার্স হয়ে ওঠাটা একটা ভালো ক্যারিয়ার সচেতনতার বিষয়? এ ধরণের একটা আয়োজনের আগে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় কোনো সার্ভে করেছে? তারা জানার চেষ্টা করেছে তাদের ছাত্ররা প্রস্তুত কিনা? তাদের নার্সিং পেশাকে সম্মানজনক মনে হয় কিনা বা তারা কাদের ক্যারিয়ারে সফল মানুষ মনে করেন? সব থেকে বড় কথা, একজন মানুষকে নারী, পুরুষ বা ট্রান্স হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে সম্মান দিতে হয়, এই শিক্ষা তারা পেয়েছে কিনা?
আমাদের এই যে একচেটিয়া মার্কেটিং-এর স্বভাব, এগুলো থেকে বের হয়ে আসলে জেন্ডার নিয়ে কাজ করার সত্যিকারের আগ্রহ থাকতে হবে। নইলে শুধু শুধু একজন মানুষের প্রতিনিয়ত হতে থাকা যুদ্ধটা বড় করে তাকে আরও বড় দুঃখের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
লেখক: জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ, আন্তর্জাতিক গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা
সারাবাংলা/এসবিডিই
মুক্তমত লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা: প্রতিরোধের পাশাপাশি চাই শিক্ষা লীনা দিলরুবা শারমিন