কুইন: এক অনিন্দ্য ফুলের ফুল্লরা
৩০ নভেম্বর ২০২৩ ১২:৪৫
জগতে মা ও মেয়ের মধ্যে সম্পর্কটা গভীর, নিবিড়, আন্তরিক, স্বার্থহীন।
কারণ, এই সর্ম্পকটা গড়ে ওঠে রক্তের বন্ধনে স্নেহের পরম গভীর আবেগে। এখানে ভালোবাসা ছাড়া কোনো লেনদেন থাকে না। কেবলই ভালোবাসা আর ভালোবাসা। কুইন, মেয়েটি সেই ধরনের এক মমতাময়ী মায়ের কোল জুড়ানো ধ্রুব। আসমানের পর্দা ভেঙ্গে বিশাল চাঁদের একটা টুকরো হয়ে নেমে এসেছে মায়ের স্নিগ্ধ কোমল হৃদমন্দিরে। দুঃখ, কুইন জীবনের পরিধি পার হয়ে পূর্ণ মানুষ হওয়ার আগেই অজানা জগতের অন্ধ অন্ধকারে হারিয়ে গেছে, পিশাচ- আত্মলোভী চিকিৎসকের নির্মম খামখেয়ালীর লোভে।
মা, কুইনের মা- প্রিয় সন্তান কুইনকে হারিয়ে এক অসীম শূন্যতার মধ্যে ভেসে ভেড়াচ্ছেন। হাওয়ায় হাওয়ায় খুঁজছেন প্রিয় কুসুম- কুইনকে। কুইন কতোটা সত্যিকারের ফুল হয়ে ফুটেছিল, জানতে হলে- কুইনের চারটি বইয়ের সন্ধান নেয়া দরকার। চার চারটে বই? হ্যাঁ ছয়টা গল্প লিখেছে কুইন, আর এ পর্যন্ত বইপ্রকাশ হয়েছে চারটি। ওর সম্পূর্ণ নাম- রাইদাহ গালিবা।
ও ফুটেছিল কুইন- ফুলের রানীর মতো। ওর প্রথম বই- ‘পিটুর জাদু জুতা’। পিটু গরীব ছেলে। ওর একটা পাখি ছিল। সেই পাখি বিক্রি করে পিটু একটা জাদুর জুতা নিয়ে আসে। জাদুর জুতা পায়ে দিয়ে যা চায়, সেটাই পাওয়া যায়। পিটু জাদুর জুতা পরে অনেক ধনদৌলত চাইলো। খুব শ্রীঘ্রই পিটুরা ধনী হয়ে গেলো। ধনদৌলতের কারণে পিটুর মধ্যে অহংকারের জন্ম হলো। কিন্ত জাদুর জুতা সহ্য করতে পারে না পিটুর এই অহংকার। ফলে, জুতা আর কিছু দিতে রাজি হয় না। পিটু ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চায় জুতার কাছে। জাদুর জুতা পিটুকে ক্ষমা করলেও পিটুর কাছে থাকে না। কারণ, অন্য মানুষের দুঃখ দূর করাও দায়িত্ব।
আমরা রাইদাহ গালিবা কুইনের এই গল্প থেকে বুঝতে পারি- কুইনের মধ্যে সকল মানুষের প্রতি পরম ভালোবাসা ছিল। নইলে কুইন কেনো জাদুর জুতাকে অন্য দরিদ্র মানুষের কাছে পাঠাবে? কুইন, তোমার শুভ বোধ আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক। আমরা স্নাত হই তোমার মহত্মের উদার্য্যে।
কুইন বা রাইদাহ গালিবার দ্বিতীয় বই ‘এক যে ছিল মুচি’। মুচি পেশায় সমাজে সংসারে খুব ছোট হতে পারে কিন্ত আমাদের প্রয়োজনের সময়ে কত গুরুত্বপূর্ন হয়ে ওঠে, টের পাই যখন রাস্তায় পায়ের জুতা ছিঁড়ে যায়। হন্যে হয়ে খুজিঁ একজন মুচিকে। সেই মুচিকে নিয়ে অনন্য গল্প লিখেছে কুইন। কুইনের দৃষ্টি- অনেক প্রসারিত, উদার আর মানবিক। কারণ, সমাজের সবচেয়ে অবহেলিতজন মুচির জীবন এবং সততাকে আকড়ে ধরে গল্প লিখেছে ছোট্ট কুইন।
ধারাবাহিকভাবে ইমা ও দৈত্য অনন্য কুইনের তৃতীয় গল্পের বই। ইমা বাবার সঙ্গে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। যেতে যেতে গভীর একটা জঙ্গলে ঢোকে। ইতিমধ্যে সন্ধ্যা নামে। ইমা ভয়ে ঘুমিয়ে পড়ে গাছের তলায়। সেই জঙ্গলের দৈত্য এসে ঘুমন্ত ইমাকে নিয়ে যায় প্রাসাদে। সেই প্রাসাদ থেকে বুদ্ধি করে বের হয়ে আসে ইমা- দৈত্যকে বেঁধে রেখে। বুঝতে পারি- আমাদের কুইন যথেষ্ট সাহসী আর বুদ্ধিমান। প্রমাণ- এই গল্প। গল্পের মধ্যেই কুইন প্রমাণ করেছে- বাঁধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হবে, ভয়কে জয় করে। কুইন বা রাইদাহ গালিবার জন্য আমাদের বুকের মধ্যিখানে জেগে ওঠে গভীর মমতা। আর যারা, যে ডাক্তারের অবহেলায় হারালাম ফুটন্ত ফুল ও উড়ন্ত প্রজাপতিটাকে- তাদের জন্য নিরন্তর অভিশাপ!
ভয়ংকর গাছ কুইনের সর্বশেষ লেখা গল্পটার প্রকাশিত বই। মেয়েটির করোটির মধ্যে অদ্ভুত সব গল্পের আইডিয়া পাখনা মেলে ওড়ে, নইলে এতো চমক লাগানো গল্পগুলো পেলো কোথায়? ভয়ংকর গাছ- গল্পবইয়ের শেষ প্রচ্ছদে লেখা হয়েছে- রাইদাহ হারিয়ে গেছে, তবে রেখে গেছে তার ক্ষুদ্র জীবনের অনন্য সব সৃষ্টি। রাইদাহর লেখা শেষ গল্প ‘ভয়ংকর গাছ’। ভয়ংকর গাছ এমনই এক গাছ যার কাছে গেলে প্রাণ সংহার হয়। রাইদাহ কী জানতো নিষ্ঠুর পৃথিবীতে অচিরেই তারও প্রাণ সংহার হবে?
দুঃখ জাগানিয়া এক নি:শব্দ গানের মধ্যে কুইন জেগে আছে সৃষ্টির সুন্দরে। ছয়টা প্রকাশিত গল্প আর এ পর্যন্ত প্রকাশ হওয়া চারটে বই – মাত্র বারো বছরের এক কুইনের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি। নৃশংস নিকৃষ্ট দাঁতাল ডাক্তারের নিষ্ঠুর পরিকল্পনায় যদি প্রাণ সংহার না হতো- কুইন পূর্ণ সত্তায় বিকশিত হলে বাংলা শিল্প সাহিত্যে ও সংস্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ হতে পারতো। নিত্য নতুন মানবিক ভাবনা ও নির্মাণ কলার স্রোতে আমরাও পূর্ণ হতে পারতাম। একটা প্রশ্ন- যদিও কুইনের প্রাণ সংহারী- একজন ডাক্তার, কিন্ত মানুষতো! কিভাবে পারলো নিরাপরাধ একটি কুসুুম কোমল প্রস্ফুটিত মেয়েকে, হত্যার মতো নির্মম রজ্জুতে ঝুলিয়ে দিতে?
এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাছে কী বিচার পাওয়া যাবে? কারণ, পদ্ধতিগতভাবে, খুনি ডাক্তারের বিচারক একদল ডাক্তারই। মানবিকতার সকল গ্রন্থি শূণ্য করে আমরা নি:শব্দের রোদনে ভেসে যাচ্ছি কুইন, তোমার জন্য, তোমার সৃজন সত্তার জন্য, তোমার মায়ের জন্য, তোমার ছোট ভাইটির জন্যও।
কুইন! তুমি যেখানেই থাকো, আলো কিংবা অন্ধকারে- তোমার সৃজন সৌন্দর্যে তুমি জেগে থাকবে শেষ রাতের তারার দৃষ্টিতে…
লেখক: কথাসাহিত্যিক
সারাবাংলা/এসবিডিই