Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উচিত কথায় বন্ধু বৈরী

আনোয়ার হাকিম
১ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৭:৪৬

আজকাল প্রবাদ প্রবচনের ক্ষেত্রেও সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় এই সব প্রবাদের প্রেক্ষিত পরিবর্তিত হয়েছে এবং পাত্র-পাত্রীদের বিচার-বিবেচনায় যোগ হয়েছে প্রভূত চিন্তা-চেতনা। তৎকালীন উপমহাদেশীয় আচার-আচরণ বৈশ্বিক ঢেউয়ে পেয়েছে নতুন আদল। ভালো কী খারাপ সে বিশ্লেষণে এখনই যাওয়া যাবে না। উচিতও হবে না। এখন ঢেউয়ে ঢেউয়ে উন্মাতাল হওয়ার কাল চলছে। চারিদিকের উদ্দামতা আর আনন্দের দ্যুতিতে ভাসছে বিশ্ব ও এর মানব-মানবী। এখন চলছে চলতি হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিয়ে আনন্দ-সাগরে অবগাহন করার কাল। বেদনার, যাতনার, বিষাদের চিরচেনা রূপ ভুলে থাকার কাল।

বিজ্ঞাপন

প্রবাদে আছে উচিত কথায় বন্ধু বেজার। এর অর্থ কী? সোজা কথায় যা বোঝা যায় তা হলো─সত্য কথা বললে বা উচিত কথা বললে একান্ত আপনজনও বেজার হয়ে যায়। এটা কোন মনগড়া কথা না। প্রাচীন কাল থেকেই এই প্রবাদের এরূপ চেহারাই এই উপমহাদেশের বাসিন্দারা দেখে আসছে। এর জন্য যুক্তি দিয়ে কাউকে প্রমাণ করার কিছু নেই। এ আমাদের চাক্ষুষ করা বিষয়। সম্পাদ্য-উপপাদ্যের মত প্রমাণিত সত্য। কিন্তু এখানেও মাত্রাগত কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এখন উচিত কথা অর্থাৎ সত্য কথা বললে একান্ত আপনজন, সে অর্থে সুজন বন্ধুও, বেজার তো হয়ই, শত্রুও হয়ে যায়। স্বার্থ বলে কথা।

বিজ্ঞাপন

আজকাল মানব-মানবীর যাবতীয় সম্পর্কই দাঁড়িয়ে আছে পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে। পরিমাপে, পরিমাণে কমবেশি হলেই স্বার্থ ফোঁস করে উঠে। এর দংশন প্রবল হয়ে থাকে আর বিষ নীলকন্ঠ করে তুলে গ্রীবাদেশ। আগে বন্ধুতার মাঝে উচিত কথার বিনিময় হলে মন কষাকষি হত, কথা চালাচালি সাময়িক বন্ধ হয়ে যেত। দেখাদেখি স্থগিত থাকত কিছু কাল। তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্ততায় এই ভুল বুঝাবুঝির অবসান হত। বন্ধুতা ফিরে পেত আগের রূপ। এখনো যে হয় না তা নয়। হলে মন্দের ভালো। না হলেই বরং ভীষণ বিপদ। স্বার্থনাশের জিঘাংসা বড় বেশি মারাত্মক হয়ে উঠে। এখন আর তৃতীয় পক্ষ সমাধানকারীর ভূমিকা নিতে আসে না। আসে ফায়দা নিতে। সমাধান পথকে প্রশস্ত করতে নয়, ব্যারিকেড দিয়ে দ্বার রোধ করে রাখতে। আবার তৃতীয় কোন পক্ষ বা ব্যাক্তিকেও আমরা এখন আর সাদরে গ্রহণ করি না। প্রথমেই তাকে প্রতিপক্ষের এজেন্ট বলে মনে করি। নাক গলানো হিসেবে দেখি। এরপর তার মতলব বুঝার চেষ্টা করি। এরপর মনমত না হলে তাকেও প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলি। ফলত মধ্যস্থতা বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব এখন আর নেই। এখন জোট বাধার সময়, সিন্ডিকেট গড়ার কাল। এতেই ব্যক্তি নিজেকে নিরাপদ ভাবে, গোষ্ঠী নিজেদেরকে ক্ষমতাবান ও অপ্রতিরোধ্য ভাবে।

এখন সর্বত্র প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রকাশ্যে না হলেও উপরে উপরে এভাবেই কায়কারবার চলছে। সবাই ‘উইন উইন সিচুয়েশন’ মননে-মগজে গেঁথে চলছে। হলে ভালো, না হলে বাই বাই। ভাবটা এমন। নিজের অবস্থান অযৌক্তিক হোক আর মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত হোক তাল গাছটা তার হতেই হবে। এটাই ‘উইন উইন সিচুয়েশন’। গরীবের, দুর্বলের, ভদ্রলোকের পক্ষে কেউ নেই। তার জন্য ‘উইন উইন সিচুয়েশন’ হলো নিজের স্বত্বের কিছু ছেড়ে দিয়ে হলেও আপোষ রফা করে নেওয়া। নইলে তার জন্য কোন তৃতীয় পক্ষ নেই। আছে লাগাতার দুর্ভোগ।

সমাজেও এসেছে পরিবর্তন। সমাজ ভেঙ্গে ভেঙ্গে হয়েছে অসংখ্য বদ্বীপ। কারো সাথে কারো সেরকম উঠাবসা নেই। কোন প্রীতি নেই। সৌহার্দ্য বিনিময়ের সৌজন্যতাটুকুও নেই। যে যার চক্রে ব্যস্ত। যোগাযোগের এই অনুপস্থিতিই একে অপরকে করে রেখেছে যার যার ভুবনে স্বাধীন, সার্বভৌম। সমাজে আনন্দ উচ্ছ্বাস ভাগাভাগিতেও থাকে দৃশ্যমান বৈপরীত্য। একের আনন্দে অন্যের জলুনী ভীষণভাবে চাক্ষুষ হয়। একের বেদনায় অন্যের পৈশাচিক উল্লাস চোখে কাটা দেয়, কানে উচ্চগ্রামে বাজে।

মিথ্যার বেসাতি চলছে সর্বত্র। এখন সত্য কথাকে কাউন্টার করা যায় বিভিন্ন অভিধায়। যেমন─ অসত্য, মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা ইত্যাদি। আমরা সোজা কথাও সোজা ভাবে বলতে ভুলে গেছি । বলাও অলাভজনক বলে মনে করি। পক্ষান্তরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাখঢাক করে বলাই নিরাপদ বলে ভাবি। তাতে বিবিধ সুবিধে। চাইলেই পল্টি নিতে সুবিধে হয়। অপব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রেও সহজ হয়। আজকাল সত্য ঘটনাও বেমালুম অস্বীকার করার সময় এসে গেছে। অডিও-ভিডিও ফাঁস হলেও নির্দ্বিধায় সর্বৈব মিথ্যা বলে অস্বীকার করা যায়। সমাজে, পরিবারে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে প্রতিপক্ষের লোকজন বা স্বার্থান্বেষী ও কুচক্রী মহল এডিট করে এই কাজ করেছে বলে প্রচারও করা যায়। অকাম করে হাতেনাতে ধরা খেলেও ক্ষতি নেই। সাঙ্গপাঙ্গ মিলে এমন ভাবে ঢেঢড়া পেটাবে যেন ফুলের মত চরিত্রে ফাঁদ পেতে কালিমা লেপন করা হয়েছে। এদেশে মিথ্যার পক্ষে আওয়াজ তোলার লোকের অভাব হয় না। পয়সা বা ক্ষমতা বা স্বার্থসিদ্ধির লোভে অনায়াসেই এই কাজ করে যাচ্ছে অনেকে। নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই, লজ্জা-শরমের লেশমাত্র নেই। পাপেট হতে, ক্লাউন হতে, জোকার হতে, ক্রীতদাস হতে কত মজা!

আজকাল বন্ধুরও প্রকারভেদ হয়ে গেছে। ইয়ার বন্ধুরা স্থায়ী বন্ধু। কেবল বিপদেই এদের স্মরণ করা হয়ে থাকে। না ডাকলেও বিপদাপদে এরাই কাছে আসে। বিনিময়ের কোন চিন্তা নেই, প্রাপ্তির কোন আশা নেই। অথচ বন্ধু বেশী আরেক দল আছে তারা বিনিময়ের কামলা। ‘ফেলো কড়ি তুলো মাল’ এই নীতির বেনিয়া। আজকাল এরাই খুব নিকটের বন্ধু। বড়সড় বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে এরাই একমাত্র ভরসা। ‘কী হইলে কী করিতে হইবে’ জাতীয় যত অপকৌশল রয়েছে তা এদের জানা। এরা কুবুদ্ধি সৃজনে ও তা প্রয়োগে অত্যন্ত সীদ্ধকাম। তবে তখনই এরা ঘরের শত্রু বিভীষণে রূপ নেয় যখন স্বার্থে বা বোঝাপড়ায় বা ভাগবাটোয়ারায় হেরফের হয়। অথবা যখন সেরের উপর সোয়া সেরের আছর পড়ে।

বন্ধুতা এখন অনেক নিয়ম কানুন মেনে চলে। এর মধ্যে রাজনীতি অন্যতম। বিপক্ষ মতাদর্শ নিয়ে আপনি যতই সুজন বন্ধু হোন না কেন হঠাৎ আবিষ্কারের মত দেখবেন আপনার চিরচেনা বন্ধুটি অতিশয় বেজার। অকৃত্রিম বন্ধুও চোখ উল্টিয়ে মুহুর্তেই পল্টি নিয়েছে। অথবা এড়িয়ে চলছে। স্বার্থের মাত্রা বেশি হলে জিঘাংসার মাত্রা এত বেশি হয় যে ইন্না-লিল্লাহ করে দিতেও সময় লাগে না। রাজনীতির ভালো পাঠ আমরা গ্রহণ করি না। তারই অপ-দীক্ষা আজ আমাদের সমাজ ভাঙ্গছে, গোষ্ঠী ভাঙ্গছে, পরিবার ভাঙ্গছে। বন্ধুতা তো কোন ছাড়!

আগেকার সেই সহৃদয়বান মধ্যস্থকারীরাও এখন রীতিমত হতাশ। গৃহকোণবাসী। তারা এখন আর এগিয়ে আসে না। এগিয়ে আসলেও ভাবগতিক দেখে ‘রিটায়ার্ড হার্ট’ হয়ে নিজ নিজ প্যাভিলিয়নে ফিরে আসে। পাছে বিবদমান বন্ধুদের দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে নিজের জীবনেই নাভিশ্বাস উঠে। তাই বন্ধুতা এখন দায়সারা হাই-হ্যালো বা দলবাজির ব্র্যাকেটে পড়ে গেছে। এতেই সুখ, এতেই শান্তি। এতে ‘উইন উইন সিচুয়েশন’ না হোক অন্তত ‘আদার থিংস রিমেইনিং কন্সটেন্ট’ জাতীয় ‘ইকুইলিব্রিয়াম সিচুয়েশন’ প্রিভেইল করে। বন্ধুতা আর বৈরীতা এখন স্বার্থের এপিঠ-ওপিঠ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এভাবে হয়ত অর্থনীতি চলে, রাজনীতি চলে, রাষ্ট্রনীতিও চলতে পারে। চাই কি গোষ্ঠীপ্রীতিও। কিন্তু বন্ধুতা চলে না। কেননা বন্ধুর পথে খাঁটি বন্ধুরাই শেষ পর্যন্ত একমাত্র সহযাত্রী হয়ে থাকে। এই কথাটাই আমরা আজ বিস্মৃত হতে চলেছি। আমাদের এখন ভেবে দেখার কাল এসেছে। বন্ধুতা অমর হোক। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

সারাবাংলা/এজেডএস

আনোয়ার হাকিম উচিত কথায় বন্ধু বৈরী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর