দুর্নীতিকে বরং নীতিতে পরিণত করুন
৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৮:৫৫
আমি গ্রামের ছেলে। আমি টুকটাক লেখাপড়া করেছি। বিশ্বের ছোট বড় এবং সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটু আধটু সময় কাটিয়েছি, কিছু শিখি বা না শিখি সেটা কথা নয়, তবে সার্টিফিকেট অর্জন করেছি। পরে সম্ভবত ২০০৫ সালে সব সার্টিফিকেট লজ্জা এবং ঘৃণার কারণে ছিড়ে ছুটে একেবারে গার্বেজে ফেলে দিই। এটা নিয়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়। অনেকে মন্তব্য করেছিল মাথা খারাপ হলে যা হয় আর কী! ২০০১-২০০৪ সালে আমার শারীরিক ওজন সম্ভবত ৭৮কেজি। এ সময় আমি আমার চাকরির পাশাপাশি গ্লোবাল প্রডাকশন ম্যানেজমেন্ট এবং এক্সিকিউটিভ এমবিএ করছি। আমাকে বিশ্বসেরা প্রডাকশন এবং সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের ডাইরেক্টর বানাতে যারা উঠেপড়ে লেগেছিল তাদের মধ্যে স্টকহোক স্কুল অব ইকোনোমিকস, হার্ডভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়, ইতালির পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডেনের গোথেনবার্গের সালমার ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি, হল্যান্ড এবং ফ্রিবোর্গের বিশ্ববিদ্যালয় এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় সাথে যুক্ত ছিল ফার্মাসিয়া, ফাইজার, এরিকশন, টোসিবা, ইলেক্ট্রলুস, সাবস্কনিয়া, বেনিটন, টয়োটা, নোকিয়া সহ আরো কিছু গ্লোবাল কম্পানির নাম উল্লেখযোগ্য। ২০০৫ সালের দিকে আমি নতুন চাকরির সুবাদে যখন মুভ করি তখন দেখি আমার সেই বাংলাদেশের ডিপ্লোমা, সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে ২০০৪ সাল পর্যন্ত যত ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট জমা হয়েছে তার ওজন আমার নিজের শরীরের ওজনের চেয়ে বেশি। পরে সব ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট গার্বেজ ফেলি সেই সাথে শরীরের ওজন কমাই। বর্তমান আমার শরীরের ওজন ৭০কেজি, জ্ঞানের ওজন কত বলতে পারব না তবে অনেকে তখন মন্তব্য করেছিল ‘মাথা খারাপ হলে যা হয় আর কী’ সেটা সঠিক নয় এতটুকু নিশ্চিত।
উপরে বলেছি আমি গ্রামের ছেলে। যদিও গ্রাম ছেড়েছি প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে তবুও অনেক কথা মনে পড়ে। একবার দেশ স্বাধীনের পর সম্ভবত ১৯৭৪ সাল হবে। দেশে প্রচন্ড হাহাকার। অন্ন, বস্ত্র এমনকি বাসস্থানের, তারপর প্রচন্ড জগড়াঝাটি। বাড়ির পাশেই মুচি, বাগদিদের জীর্ণ কুটির। ঝড় এলেই পরিবারের সবাই মিলে বাঁশ ও ছোনের তৈরি ঘরের চাল অর্থাৎ ছাদ ধরে ঝুলে থাকত যাতে করে ঝড় পুরো ঘর উড়িয়ে নিয়ে না যায়। একদিন তারা শত চেষ্টা করেও ঘরটা ঠেকাতে পারেনি। ঘর যখন ঝড়ের দাপটে উড়াল দিল বাপ-বেটারা এক সঙ্গে চিৎকার করে বলেছিল “যা বাল ছিড়ে ছুটে নিয়ে যা কাল আমার নতুন করে তালপাতার একটি ঘর করব”।
গোটা বিশ্বের শিক্ষা প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার ধরণ দেখে মনে হচ্ছে যদি সব কিছু ঝড়ের ছোবলে ধ্বংস হয়ে যেত তবে নতুন করে উন্মুক্ত সু এবং স্বশিক্ষার আবির্ভাব হতো যেখানে জানা এবং বোঝা থেকে শেখা যেত।
আমার এক বাল্যবন্ধু মাহবুবুর রাজ্জাক তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নামকরা এবং মস্তবড় প্রফেসর। তিনি আমার দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত একটি লেখা “ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, দুর্নীতিবাজদের ঘা মেরে তুই বাঁচা” পড়েছেন। পড়ার পর আমাকে ছোট্ট একটি টেক্স্ট করেছেন “দুর্নীতিবাজরা কিন্তু আধমরা নয়, মোটাতাজা। নবীন কাঁচার দল ঘা মারতে যেয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে।“।
পরে বন্ধুর সঙ্গে অনেকদিন পর কিছুক্ষণ কথা হলো। কথার মূলমন্ত্র ছিল ওভারঅল শিক্ষার মান নিয়ে এবং কথা শেষে তিনি একটি তথ্যবহুল লিখা “দেশে ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে” ফরওয়ার্ড করেছেন যার ”কী মেসেজ” হচ্ছে বিশ্বমানের শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক মানের মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্য, পড়াশোনা করতে বার্ষিক ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ এ স্কুলগুলোতে এবং দেশে ইংরেজি মাধ্যমে ব্যয়বহুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা এবং সেবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এসব প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের ভর্তিতে আগ্রহ বাড়ছে অভিভাবকদেরও।
আমার ভাবনা থেকে কিছু কথা– যদি ৪০ লাখ টাকা প্রতি বছর এবং কম করে হলেও ধরি ১০ বছর লেখাপড়ার পর যে বেতনের চাকরি পাবে সেটা বাংলাদেশে কত, দুর্নীতি ছাড়া? এতবড় একটি ইনভেস্ট অথচ কী রিটার্ন বা কীভাবে রিটার্ন হবে ভেবেছেন কি অভিভাবকরা?
গোটা বিশ্বজুড়ে মানসিক অশান্তি, দুঃখের দহনে করুণ রোদনে তিলে তিলে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে অসংখ্য তরুণ-তরুণীর জীবন। নির্জনতা, ধৈর্য্য, নির্মমতার ব্যথা বুকে চাপিয়ে ধুকে ধুকে একাকীত্বের জীবন পার করছে মানুষ জাতি। ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে মানসিক ভারসাম্য এবং নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে করছে অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত। ঠিক একই সময় অন্যদিকে একই বিশ্বের এক প্রান্তে চলছে লুটপাট, দুর্নীতি, রাহাজানি, হয়রানি এমনকি ডাকাতি। জাতির দুর্দিনে অবৈধ অর্থের প্রাসাদ গড়ছে অনেকে। মানব জাতির এই দুর্দিনে যারা কু-কর্মে লিপ্ত তাদেরকে যদি আমরা সঠিক পথ দেখাতে ব্যর্থ হই তবে জাতি হিসেবে আমরা সবাই হবো নির্লজ্জ, বেহায়া এবং বেশরম। অনেকে পেটের দায়ে অন্যায় করে। এমন লোকের অভাব নেই মেনে নিলাম কিন্তু যারা লোভ-লালসা এবং বিলাসের জন্য অন্যায় করে কীভাবে মেনে নিবো তাদেরকে? এরা পেটের দায়ে নয় এরা অন্যায় করে চলছে এদের পাশবিক ও বিকৃত রুচির তৃপ্তি মিটাতে।
কিন্তু এই তৃপ্তিটা কতক্ষণ রাখতে পারবে সেটার জন্যও কি ভাবা হচ্ছে? এই কাজগুলো যারা করছে তারা মনেই করে না যে এটা অন্যায়, কারণ সমাজের সব অন্যায় এদের কাছে এখন ন্যায়সঙ্গত। তাদের ধারণা তারা সৃজনশীল কর্মের মধ্যেই আছে। তাদের চোখে এখন আঙ্গুল দিয়ে জানাতে হবে যে এ কাজগুলো সৃজনশীল বা বাস্তবসম্মত নয়। একই সাথে জানতে হবে কেন তাদেরকে এটা আকর্ষণ করছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে সমাজ এখন আপদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। এটার সীমাহীনতা কঠিন হয়ে আরও গভীর সীমাহীনতায় ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বজনীন দুর্নীতি হচ্ছে যা সর্বজনীন নয়। কারণ দুর্নীতি কখনো চিরস্থায়ী হতে পারে না।
আসলে কোথাও এর তেমন শক্ত জবাবদিহিতা নেই। আমি মনে করি, সুশাসনের মূলনীতি হচ্ছে জবাবদিহিতা বা দায়বদ্ধতা। এটি প্রতিষ্ঠা না করা গেলে সুশাসন আসবে না। এটা আসতে হবে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে।
দুর্নীতির সব সঞ্চয় জমা হয় শেষে ব্যাংকে, আসুন জেনে নেই কী হচ্ছে সেখানে। দেখা যাচ্ছে সরকার কর্তৃক একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়ার পর ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৮০ শতাংশ, আগে যা ছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশ। শুধু একজন চেয়ারম্যান ও এমডির কারণে ব্যাংকটির এমন অবস্থা হয়ে গেল! ৮০ শতাংশ ঋণ যখন খেলাপি হয়ে গেল, তখন তো সরকারের উচিত কাউকে না কাউকে দায়ী করা। আর এত ঋণ যে খেলাপি হয়ে গেল, তা তো কোনো শাখা ব্যবস্থাপকের জন্য হয়নি। চেয়ারম্যান-এমডি ছাড়া একটি ব্যাংকে এত খেলাপি হতে পারে না। কিন্তু চেয়ারম্যান দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তার মানে চেয়ারম্যানকে যারা রক্ষা করছেন, তারা দুদকের চেয়ে শক্তিশালী। এ কারণে তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
মূলত ব্যাংক খাতকে রাজনীতিকীকরণ করতেই এমন পরিবর্তন। কিন্তু ব্যাংক রাজনীতির জায়গা না। একটি ব্যাংকের শতকরা ১০ ভাগ টাকা মালিকের বা সরকারের। বাকি টাকা পুরোটাই জনগণের আমানত। এই আমানতের টাকা সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর যত চাপ, যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমানতকারীদের স্বার্থ না দেখে যারা লুটপাট করে তাদের স্বার্থ দেখে। এটা বলতে ভালো না দেখালেও বাস্তবতা এটাই।
সমস্যা হচ্ছে আমানতকারীদের স্বার্থ দেখার জন্য যারা আছে তারাও দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই বলতে হয় অভাগা দেশের মানুষের চোখ থাকতেও তারা অন্ধ না হলে এ সকল ব্যাংক চেয়ারম্যানদের কিছু হতো। সবকিছু জানার পর মনে প্রশ্ন উদয় হয়েছে, যেমন এদেরকে কারা রক্ষা করছে, কিসের বিনিময়ে রক্ষা করছে? আমার প্রশ্ন দুর্নীতি কি তাহলে অর্থনীতি, পৌরনীতি, রাজনীতির মতই একটি নীতি? নাকি সবকিছুর সমন্বয়ে গঠিত এই নীতি যাকে ধরতে গেলে যায় না ধরা, ছুঁতে গেলে যায় না ছোঁয়া। নাকি এটা জাতির হৃদয়ে লতার মতো জড়িয়ে পড়েছে! তাই যদি হয় তবে সংসদ থেকে দুর্নীতিকে বরং নীতিতে পরিণত করুন।
আমার পরের প্রশ্ন অভাগা তরুণ প্রজন্মের কী হবে?
দেশ ভরা নেতা আছে কিন্তু নেতার অনুসারী নেই। নেতা তার মনুষ্যত্ব, লজ্জা শরম এবং বিশ্বস্ততা হারিয়েছে। নেতা বলছেন কী করতে হবে কিন্তু কে কার কথা শোনে। জনগণ বুঝে গেছে নেতার নেতৃত্বের সুযোগ করে দিলে সে করবে পরিবর্তন নিজের এবং পরিবারের।
সেক্ষেত্রে জনগণের কী হবে? হয়ত সবাই বলবে তাহলে মিটিংয়ে নেতার বক্তৃতা শুনতে এত লোক জড়ো হয় কেন? মাওলানার ওয়াজ শুনতেও জনগণ যায়, তার অর্থ এই নয় যে তিনি যা বলছেন জনগণ সেভাবে কাজ করছে। জনগণ স্ট্রিট স্মার্ট, তাই তারা চোখ কান খোলা রেখে সব শুনছে, দেখছে এবং তারপর তাদের সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছে।
লন্ডন বা ঢাকার লাক্সারি পরিবেশে বসে যে সব নেতা অর্ডার করছে কী করতে হবে তাদের কথা কেউ আর শুনছে না। বর্তমানে ক্ষমতায় যে সরকার তার কথাও হয়তো জনগণ শুনছে না। তবে সরকারের বেতনভুক্ত কর্মচারীরা তাদের রুটিন অনুযায়ী কাজ করে চলছে। দেশের রাজনীতিতে শুধু ধান্দাবাজি, যার কারণে নেতার পেছনে কোনো অনুসারী নেই, আছে শুধু চামচারা। অনেকেই সরকারের সমালোচনা করে বলেছে, দেশে আজ ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের মধ্যে একটা ঐকমত্য গড়ে উঠেছে। তাদের এগিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সরকার যেভাবে দেশ চালাতে চাচ্ছে, সেটা আর পারবে না। মানুষ একদিন দাঁড়িয়ে বলবে, এটা একেবারে অসহ্য হয়ে গেছে। এর পরিবর্তন আনতে হবে। এখন কথা বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? জনগণ? কে সেই জনগণ? বিদেশিরা নাকি দেশের ১৭ কোটি মানুষ?
জনগণ তো এখন আগের মত বোকা নয়, যখন যার যা খুশি বলবে আর তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে। ও দিন গুজার গেয়া। কই দেশের প্রতি যদি সত্যিই এত দরদ তাহলে আগের সেই শহিদ ভাইদের মত করে কেন আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ছিনা? কারণ আমরা জনগণ বার বার শুধু জর্জরিত, শোষিত, নিপীড়িত এবং নির্যাতিত। আমাদের ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হয়েছে। হতাশায় নিমজ্জিত আমাদের সমস্ত শরীর।
মন বলে শোষণ, শাসন আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে সোচ্চার হই আর ঝাঁপিয়ে পড়ি কিন্তু না তা করব না কারণ আমরা শান্তিপ্রিয় শান্ত জনগণ।
আমরা এখন ভীত হয়ে গেছি, প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছি আর অপমান সইতে শিখেছি। নীতিহীন এবং পথভ্রষ্ট নেতার নেতৃত্বের কারণে আমরা এখন নিজের দেশে পরাধীন। আমাদের নেতা আছে তবে নেই নেতৃত্ব। আমরা এখন স্বাধীন দেশে পরাধীন, কিছু হলেই বিভিন্ন দূতাবাসে গিয়ে নালিশ করি। অতীতেও এমনটি ছিল এখন আরো বেড়েছে।
এমন একটি ক্রাইসিস সময় ভাবছি আমি একা বসে স্মৃতির জানালার পাশে, অতীতের স্মৃতিগুলো এসেছে ফিরে মোর হৃদয়ে, যারে আমি বেসেছি ভালো মনে প্রাণে। ভাবছি বিশ্বের কথা, ভাবছি স্বপ্নীল সোনার বাংলার কথা। আমি কোটি টাকা খরচ করে পড়িনি তবে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি ছাড়া আয় করেছি। কারণ কি জানেন? আমি ছোটবেলায় ৪০ লক্ষ টাকা দিয়ে জেল-হাজতে ভর্তি হইনি। আমি এবং আমার বন্ধুরা বাংলার উন্মুক্ত প্রাকৃতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। ওই যে উপরে বলেছি আমার বাল্যবন্ধু মাহবুবুর রাজ্জাক তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নামকরা এবং মস্তবড় প্রফেসর হয়েছেন। আমার আরেক বন্ধু ডাক্তার এবং ব্রিগেডার জেনারেল নাজমুল হক, তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালের ডিজি সহ শত শত স্বনামধন্য বন্ধু-বান্ধব দেশে বিদেশে রয়েছেন (আমার নিজের ভাইবোন সহ) যারা সবাই আমার মত গ্রামের সাধারণ পরিবেশে শিক্ষাগ্রহণ করেছে। ৪০ লক্ষ টাকা প্রতি বছরে কেউ খরচ করে পড়েনি বরং ৪০ লক্ষ টাকার বেশি স্কলারশিপ পেয়েছে।
মানব জাতির বয়স্কদের চেষ্টার শেষ হতেই তাদের সন্তানদের চেষ্টার শুরু। এ চেষ্টার শুরুতে তারা তাদের নিজ গতিতে শিখবে। এখন সন্তানের জ্ঞানভাণ্ডারের গতি এবং তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় বাবা-মা কী চায় সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় বরং সন্তান নিজে কী হতে চায় সেটার ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এখন অনেকেই বলবে ছেলেমেয়ে যখন ছোট তারা কি জানে কোনটি ভালো বা কোনটি মন্দ? সন্তান যখন ছোট তাদের গড়ে তোলা এবং ভালো-মন্দের দায়ভার নেওয়া বাবা-মায়ের দায়িত্ব। এ কথা কিছুটা সত্য তবে মনে রাখতে হবে দুটি বিষয়। একটি হলো সন্তানকে গড়ে তোলা আরেকটি হলো গড়ে তুলতে সাহায্য করা।
আমরা যখন আমাদের চিন্তাধারাকে শিশুর ওপর চাপিয়ে দেই তখন তাদের নিজেদের চিন্তাশক্তি (ক্রিয়েটিভিটি) লোপ পেতে থাকে। একই সাথে পরনির্ভরশীলতাও বাড়তে থাকে। যার কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় মুখস্থবিদ্যা বা অন্যকে অনুসরণ করা একটি অভ্যাসে পরিণত হয়ে থাকে। এর ফলে দেখা যায় শিশুর নিজের মধ্যে যে নিজস্ব দক্ষতা এবং প্রতিভা রয়েছে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে না। নিজস্ব দক্ষতা হলো ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বা বুদ্ধিবৃত্তিক আবেগ যা হ্রাস পেতে থাকে। শিশুর ব্যক্তি সচেতনতা, আবেগের নিয়ন্ত্রণ, আত্মবিশ্বাস এবং উৎসাহের অঙ্কুরে বিনাশ ঘটে যা তার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
প্রকৃতিতে সব ফুলের কুঁড়ি যেমন ফুল এবং ফল দিতে পারে না, সব শিশুর জীবনও ঠিক তেমনি বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতার কারণে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না। প্রশ্ন উঠতে পারে আজীবন আমরা এই ভাবেই তো সব কিছু করে এসেছি, এখন কেন অন্যভাবে করতে হবে? যুগের অবকাঠামোর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কর্মের ধরন এবং পদ্ধতিরও পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের ডিএনএ এবং ফিঙার প্রিন্টে প্রমাণিত হয় যে আমরা একে অন্যের থেকে ভিন্ন। সুতরাং শিশুর ইন্ডিভিজুয়াল আইডেন্টিটির বহিঃপ্রকাশ যেন ঘটে সে বিষয়ে যেমন বাবা-মায়ের দায়িত্ব রয়েছে তেমন দায়িত্ব স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও।
দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে একটি বিষয় বেশ কমন দেখা যায় তা হলো বাবা-মা সব সময় তাদের সন্তানদের পুশ করে যাতে তারা এমন ধরনের শিক্ষা বেছে নেয় যেখানে চাকরির নিশ্চয়তা বেশি। সন্তান কী হতে চায় তার প্রতি মনোযোগী না হয়ে বরং নিজেরা যেটা ভালো মনে করে সেটাই সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেয়। যদিও বাবা-মায়ের এ ধরনের চিন্তাধারার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে।
আমি গড়ে উঠেছি তিলে তিলে সেই স্মৃতি ঝলমল সবুজে ভরা গ্রাম-বাংলার ইছামতি বিলের পাশে। সেই পানি টলটল নবগঙ্গা নদীর ধারে।
আমি পড়েছি নহাটা স্কুলে, পড়েছি গঙ্গারামপুর স্কুলে, পড়েছি ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এবং কলেজে, শেষে ইউরোপ, জাপান এবং আমেরিকার খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় হতে শিক্ষা গ্রহণ করেছি। আমি গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন মানেজমেন্ট, ফাইজার ফার্মাসিউটিক্যালসের ডিরেক্টর হয়েছি।
আমি বিশ্ব নাগরিক হয়েছি। আমি একজন আদর্শ স্বনামধন্য চাকরিজীবী এবং সুন্দরী রমণীর স্বামী হয়েছি। আমি দুইজন উদীয়মান (rising star) টেনিস তারকার বাবা হয়েছি। আমি বাংলাদেশে আমার বাবা-মার পরিবার গঠনে অবদান রেখেছি, যেখানে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নেপথ্যের কাহিনী উল্লেখযোগ্য। কিন্তু যে ইছামতি বিলের পাশে আমি জন্মেছি এবং গড়ে উঠেছি নবগঙ্গা নদীর তীরে, এর চেয়ে বড় পাওয়া পাইনি জীবনে এখনও। কারণ বিশাল বিলের পাশে আর দেশখ্যাত নবগঙ্গা নদীর তীরে আমার জন্ম এবং যেখানে কেটেছে আমার ছোটবেলার দিনগুলো তার তুলনা অন্য কারো সাথে করার মত জায়গা পৃথিবীর কোথাও দেখিনি আজও। গ্রামের কাছে, গ্রামের মানুষের কাছে, গ্রামের আলো বাতাসের কাছে, আমার যে অনেক ঋণ হয়ে আছে।
মনে হচ্ছে নহাটায় জন্মগ্রহণ করেছিলাম বলে আমার মনপ্রাণ আজ এত বড় হয়েছে, জন্ম আমার ধন্য হয়েছে। তবে হ্যাঁ, বিদেশে এসে কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছে, মনের মতো জায়গাটি দখল করে নিতে। তাইতো আজ নতুন প্রজন্মদের সঙ্গে মনের আনন্দে ভাগাভাগি করছি আমার জীবনের মূল্যবোধ, অভিজ্ঞতা আর সুশিক্ষা (যে শিক্ষায় দুর্নীতি নেই, আছে মানবতা এবং মূল্যবোধ)। কারণ আমি আশা করি নতুন প্রজন্ম অনুপ্রাণিত হবে আমাকে দেখে, আমার বন্ধুদেরকে দেখে।
আমি ০-২১ বছর বাংলাদেশে কাটিয়েছি। এই ২১ বছরে বাংলাদেশ আমাকে যা দিয়েছে পুরো পৃথিবী তার অর্ধেকও দিতে পারেনি গত ৪০ বছরে। গ্রামের বাবা-মা, ভাই-বোন, শিক্ষক-স্কুল, সাথীরা, খেলার মাঠ-সাথী এবং সেই সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা পরিবেশ আমাকে তৈরি করেছে ভালোবাসার ছোঁয়ায়। সে ছোঁয়া আমি অনুভব করি প্রতিটি মুহূর্তে, অনুভব করি প্রতিটি নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে আর বিশ্বাসে।
তাইতো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, নহাটায় জন্মগ্রহণ করে আমি যখন আমাকে মনের মতো করে গড়তে পেরেছি, নতুন প্রজন্ম কেন পারবে না? আমি মনে-প্রাণে এবং ধ্যানে বিশ্বাস করি তারাও পারবে জীবনে বড় হতে। দরকার শুধু সাধনা, চেষ্টা, মোটিভেশন এবং আত্মবিশ্বাস। আমাদের সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা এত ভালো ছিল না। নহাটা থেকে ঢাকায় যেতে পুরো একটা দিন পার হয়ে যেত। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চিঠি যেতে লাগত একমাস। উত্তর পেতে লাগত আরও একমাস! কিন্তু আজ যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটেছে। ইন্টারনেট আমাদের হাতে বিশ্বের জ্ঞান ভাণ্ডারকে উম্মুক্ত করে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেই জ্ঞান ভাণ্ডারকে তোমরা নিজেদের মতো করে আবিষ্কার করবে। সেই জ্ঞানের আলোয় নিজেদের আলোকিত করবে। মনে রাখবে সমসাময়িক শিক্ষা ব্যবস্থা যদি তোমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য না করে, বা তোমাদের মধ্যে আত্মনির্ভরতা ও আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য না করে, তবে সে শিক্ষা সুশিক্ষা নয়। সুশিক্ষা পরিপূর্ণতার এক প্রকাশ। অতএব ৪০ লক্ষ টাকা খরচ করে জেল হাজতে না ঢুকে বরং সেই অর্থ দিয়ে দরিদ্র সহপাঠিদের মোটিভেট করে প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষা গ্রাম থেকে শুরু করে পুরো দেশব্যাপী চালু করুন, দেখবেন আমরা সবাই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছি।
লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
সারাবাংলা/এসবিডিই