মানবাধিকার ইস্যুতে শেখ হাসিনার অবদান
১০ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৯:৩৬
একটি রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য সর্বজনীন, সহজাত, অ-হস্তান্তরযোগ্য এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকারই হলো মানবাধিকার। মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এক ধরনের অধিকার যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিটি মানুষ এ অধিকার শুধু ভোগই করবে না, চর্চাও করবে।
তবে এ মানবাধিকার চর্চা কোনভাবেই অন্যের ক্ষতি কিংবা প্রশান্তি বিনষ্টের কারণ হতে পারবে না। এ অধিকার সহজাত এবং সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য হবে। কিন্তু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের দিকে দৃষ্টিপাত করলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বহু মানুষ ব্যক্তি বিশেষে কিংবা জাতি বিশেষে নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, নির্বিচারে হত্যার শিকার হচ্ছেন।
বৈষম্যের শিকার কিংবা বিপন্ন মানবতার পক্ষে কথা বলা মানুষের বড্ড অভাব। অত্যাচারিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, গরীব, অসহায়, দুঃস্থ মানুষের মৌলিক অধিকার তথা মানবাধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বদা আপসহীন। তিনি খুব ভালো করেই জানেন কিভাবে পিছিয়ে পড়া অবহেলিত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব এবং সে লক্ষ্যেই তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানের কথা। ১৯৪২ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা ছিল বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম অত্যাচারিত ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠী।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার প্রাণঘাতী আক্রমণ থেকে বাঁচতে তাদের পৈত্রিক ভিটে-মাটি ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় রোহিঙ্গারা। সর্বশেষ ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে সামরিক জান্তা ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়াসহ রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে গুলি করে এবং আগুন দিয়ে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করা হয় এবং বলপূর্বক তাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। ফলে এ সময় প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থান নেয়।
রোহিঙ্গাদের উপর চালানো এ গণহত্যা কিংবা তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তেমন কোন উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা কিংবা প্রতিবাদ লক্ষ্য করা যায়নি। এমনকি এগুলো বন্ধ করার বিষয়ে তাদের আন্তরিক কোন তৎপরতা দৃশ্যমান হয়নি। কিন্তু চুপ থাকতে পারেননি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৫১ সালের জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষরিত দেশ না হয়েও শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দিয়ে বিপন্ন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেন।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে করা ‘১৬ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারলে ৭ লাখ মানুষকেও খাবার দিতে পারবো’ এ উক্তিটির মাঝেই মজলুম মানুষের প্রতি শেখ হাসিনার মমত্ববোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। শুধুমাত্র আশ্রয় দিয়েই তিনি থেমে থাকেননি। তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোসহ হারানো অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য পশ্চিমাদেশসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহে সাহসী উচ্চারণের মাধ্যমে জনমত গড়ে তোলার কাজ প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছেন।
ওয়াশিংটনের ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা সার্ভিসে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তাদের (রোহিঙ্গাদের) নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে এবং নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
বর্তমান বিশ্বে ফিলিস্তিনে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষ গত ৪৬টি বছর ধরে স্বাধীন, সার্বভৌম ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে চলেছেন। ফিলিস্তিনের ভূমি জবরদখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও ইসরাইল সর্বদা তার রাষ্ট্রের পরিধি বাড়ানোর জন্য যখন তখন ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের উপর হামলা চালিয়ে নতুন নতুন এলাকা তার দখলে নিয়ে চলেছে।
গত ৭ অক্টোবর’২০২৩ তারিখে হামাস কর্তৃক ইসরাইলে হামলার কারণে পুনরায় শুরু হয় হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ইসরাইল ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় বিমান, রকেট ও স্থল অভিযান চালিয়ে প্রায় ১৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য মতে, নিহতদের ৪০ শতাংশই শিশু। এছাড়াও নিহতদের একটি বড় অংশই হচ্ছে নারী ও বেসামরিক লোকজন।
হামলার কারণ ফিলিস্তিনিদের হাজার হাজার বসতি, ঘর-বাড়ি, স্থাপনা মাটির সাথে মিশে গিয়েছে। প্রায় ২ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। শুধু তাই নয় দখলদার ইসরাইল যুদ্ধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সকল আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে এবং সারা বিশ্বে তীব্র বিরোধিতা ও সমালোচনা থাকা স্বত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের তোয়াক্কা না করে একের পর হাসপাতালে হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এই সকল হাসপাতালে অনেক আহত ও মুমূর্ষু বেসামরিক, নারী, শিশু ভর্তি ছিলেন যারা সকলেই নিহত হয়েছে।
এমনকি, হামলা পরবর্তী গাজায় খাবার, ওষুধ এবং পানি বহনকারী ত্রাণের গাড়ি পর্যন্ত প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এক কথায়, গাজায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। ইসরায়েল কর্তৃক গাজায় নির্বিচারে হামলার পক্ষে আমেরিকাসহ অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ অবস্থান নেয় এবং হামাসকে জঙ্গী সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্বব্যাপী ইসরায়েল কর্তৃক গাজায় পরিচালিত গণহত্যার বৈধতা দেয়ার নিমিত্তে জনমত গঠনের লক্ষ্যে তারা কাজ করে।
আশার কথা হচ্ছে, সারা বিশ্বব্যাপী সাধারণ জনগণ ফিলিস্তিনিদের পাশে। আর হাতেগোনা যে কয়টি দেশ গাজায় মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দখলদার ইসরাইলের বর্বরোচিত হামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার দখলদার ইসরাইল কর্তৃক গাজায় পরিচালিত গণহত্যার প্রতিবাদ করেছে এবং জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখেছে।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও ওআইসি সম্মেলনে ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনের নিরীহ মানুষ, নারী ও শিশু হত্যার প্রতিবাদে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন এবং বিশ্বনেতাদের প্রতি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একইভাবে, ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকে ৫০০ শিশুসহ নিহত হয়েছেন আরও ৯ হাজারেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক। এ জায়গাতেও আওয়ামী লীগ সরকার মানবাধিকারের পক্ষ নিয়েছেন। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের জরুরি অধিবেশনে যুদ্ধ বন্ধ করা এবং রাশিয়ান সেনা ফেরত নেওয়ার প্রস্তাব উত্থাপিত হলে বাংলাদেশ সরকার প্রথমে ভোটদানে বিরত থাকলেও পরবর্তীতে ইউক্রেনের পক্ষে ভোট দেয়। এর একমাত্র কারণ মানবতা।
দেশের অভ্যন্তরে সমাজের নিম্ন স্তরের মানুষের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। পশ্চাৎপদ মানুষদের এগিয়ে নেয়ার জন্য তিনি নানাবিধ কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধি বৃদ্ধি, ছিন্নমূল- দুঃস্থ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে নানামুখী পরিকল্পনা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
অর্থের অভাবে কিংবা থাকার জায়গার অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করা মানুষের জন্য তিনি এক আশীর্বাদ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১,১৩,৫৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করেন। বরাদ্দকৃত টাকার মাঝে রয়েছে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, জেলে ভাতা, এতিমখানার ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট, বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি ইত্যাদি। নামগুলো শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে, দেশের সকল স্তরের মানুষের অধিকারের কথা ভেবেছেন আওয়ামী লীগ সরকার এবং তাদের মানবিক চাহিদা পূরণে সফলও হয়েছেন।
১৯৯৭-৯৮ অর্থবছর থেকে শুরু হওয়া বয়স্ক ভাতায় যেখানে প্রতি ওয়ার্ডের ৫ জন পুরুষ ও ৫ জন মহিলাকে প্রতিমাসে ১০০ টাকা করে দেওয়া হতো; সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভাতাভোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৭.০১ লাখ জন যাদের প্রত্যেকের মাসিক ভাতা ৭০০ টাকা করে। বয়স হয়ে যাওয়ার পর বোঝা হিসেবে গণ্য হওয়া এসব মানুষদের পাশে দাড়িয়ে তাদেরকে সাহস যোগান দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
একইভাবে তিনি বিধবা নারীদের কষ্টও লাঘব করেন। সমাজে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হওয়া এসব নারীদের জন্য ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে চালু হওয়া ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত মহিলা ভাতা’-র পরিমাণ ১০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকায় এনেছেন এবং ভাতাভোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। মাতৃত্বকালীন সময়টি প্রতিটি নারীর জীবনে এক অন্যরকম অধ্যায়। প্রায় সবসময়ই নিয়মিত একটি ডাক্তারি চেক-আপের মধ্যে থাকতে হয় তাদের। তাই মাতৃত্বকালীন সময় নিরাপদ করার লক্ষ্যে তিনি মাসিক ৮০০ টাকা ভাতার ব্যবস্থা করেন।
১৯৯৭ সালেই বাংলাদেশের ভূমিহীন, গৃহহীন ও ছিন্নমূল পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আশ্রয় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তিনি ১০,০০০ টি গৃহপ্রদান করেন গৃহহীনদের মাঝে। মানবতার এক অনন্য নজির স্থাপন করেন শেখ হাসিনা। শুধু গৃহপ্রদান করেই ক্ষান্ত থাকেননি তিনি, চাকরির ব্যবস্থাও করেছেন তিনি। সমাজের উঁচু-নিচু সকল স্তরের মানুষের অধিকার আদায় তথা মানবাধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে তিনি শত চাপেও অনড়। তার অবদানে বেদে, জেলে থেকে শুরু করে হিজড়ারা পর্যন্ত সমাজে মাথা তুলে বেঁচে থাকার প্রেরণা পেয়েছে। তাদের চাকরি ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছেন তিনি।
চা-শ্রমিক, পোশাক শ্রমিকদের জন্যও তিনি কাজ করেছেন। তিনি চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে ১৭০ টাকা নির্ধারণ করেন। পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করেছেন। প্রতিবন্ধী ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করার লক্ষেও কাজ করে চলেছেন তিনি।
মানধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এত কিছু করার পরও কোন কোন মহল তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে । যে নেতা সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও ১১ লাখ শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়, সমাজের সর্বস্তরের অসহায়-দুঃস্থ মানুষের মানবিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে একপ্রকার যুদ্ধ করে কিংবা বিশ্ব রাজনীতিতে নিজের লাভের তোয়াক্কা না করে মানবাধিকারের পক্ষ নেয়; সে নেতা কিভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে? সাধারণ মানুষের বিবেকের কাছে প্রশ্নটি রয়েই যায়।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি
সারাবাংলা/আইই