Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভাষা সৈনিক হামিদুর রহমান: আজও পেলেন না মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি

রশীদ এনাম
১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:৪২

“যারা দান করে আপানারে তারা নিঃশেষে দিয়ে যায়,
মেঘ ঝরে যায় ভাবে না তার বিনিময়ে সে কি পায়।
প্রদীপ নিজেরে তিলে তিলে দাহ করে দেয় নিজ প্রাণ
প্রদীপ জানে কী আনন্দ দেয় তারে এই মহাদান”- কাজী নজরুল ইসলাম।

ইশকুলবেলায় শুনেছিলাম হামিদুর রহমান চাচার গল্প। যে কিনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য নিঃস্বার্থ ও জনহিতৈশিভাবে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। হামিদুর রহমান ১৯৩০ সালে ২০ মে পটিয়া ৫ নং ওয়ার্ড এ জন্মগ্রহন করেন। পিতা- আহম্মদ ছগীর, মাতা আজাল খাতুন।

বিজ্ঞাপন

হামিদুর রহমানের বাবা ছিলেন কৃষক ও ব্যবসায়ী। কিন্তু ছেলেমেয়েদের সবাইকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। হামিদুর রহমান ছিলেন বাবা মায়ের আদুরে সন্তান। শৈশব পুরোটা কেটেছে পটিয়া সদরে। প্রাথমিক শিক্ষার হাতে খড়ি মোহছেনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তিনি ১৯৪৯ সালে আবদুস সোবহান রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ১৯৫১ সালে বোয়ালখালী স্যার আশুতোষ কলেজ থেকে এইচএসসিতে অধ্যায়নকালীন থেকে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। ছোট বেলা থেকে দস্যিপনার মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠা। দুরন্ত কৈশোর কাটে গ্রামে। হামিদুর রহমান ছোটবেলা থেকে বন্ধুদের সাথে হৈ চৈ করে ছুটে বেড়াতেন। যেমনি সাহসী তেমনি বেশ মেধাবী ও মিষ্টভাষী ছিলেন। হামিদুর রহমান সংস্কৃতিমনা ছিলেন। পটিয়া ক্লাবের মঞ্চ নাটকেও তিনি অভিনয়ও করতেন। ফুটবল আর ব্যাটমিন্টন ছিল প্রিয় খেলা। বেশ ভোজন রসিকও ছিলেন। হামিদুর রহমান মাঝির ঘাটে বেশ কিছুদিন লবণের ব্যবস্যাও করেছিলেন। তিনি বেশ রসিক ও আমোদে প্রকৃতির ছিলেন। তার ছিল বিশাল ব্যক্তিত্ব। এলাকার বিচার আচারে হামিদুর রহমান সাহেবের ডাক পড়ত। এলাকায় তার বেশ সম্মান ছিল। পোষাক আশাকে ও ছিলেন বেশ পরিপাটি। তিনি পাঞ্জাবী ও ফতুয়া পরিধান করতে পছন্দ করতেন। টসবগে যখন তরুন হামিদুর রহমান একসময় আওয়ামীলীগের সক্রিয় সদস্য হয়ে উঠেন। আওয়ামী লীগের একনিয়ষ্ট কর্মী ও সাবেক মন্ত্রী অধ্যাপক নুরুল ইসলামের হাত ধরে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। অধ্যাপক নুরুল ইসলামের সাহচার্য সার্বক্ষনিক সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন না করলেও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার বিতরণ থেকে শুরু করে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন নিজেই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক। যুদ্ধকালীনসময়ে হামিদুর রহমানের বাড়িটি পাকহানাদার বাহিনীরা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি দীর্ঘ ২২ বছর পটিয়ায় অবিভক্ত আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ছিলেন। বেঁচে থাকা অবস্থায় তিনি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার এক সাক্ষাতে বলেছিলেন, “৫২” এর ভাষা আন্দোলনে তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু তখন ঢাকায় ভাষার জন্য আন্দোলন শুরু হলে, তিনি এবং প্রয়াত মিয়া আবু মোহাম্মদ ফারুকী, ন্যাপ নেতা আবুল মাসুদ চৌধুরী, রিজুওয়ানুল কবির আনছারীসহ আরো বেশ কয়েকজন ছাত্র নেতাদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য পটিয়ায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে পটিয়া আদর্শ ইশকুল ও রাহাত আলী ইশকুলের ছাত্রদের নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করি”। রাষ্ট্র ভাষা বাংলা প্রতিষ্টা করার জন্য হামিদুর রহমানসহ তাদের সঙ্গিসাথীরা ভাষা আন্দোলনে পটিয়ায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তারা প্রধান সড়কে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন।

বিজ্ঞাপন

শিক্ষাবিদ রমেশ চন্দ্র গুপ্ত “শিক্ষার ইতিহাসে পটিয়ায়” একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ১৯২৮ সালে কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা রেবতী বরণ দত্ত পটিয়াতে কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু পরিতাপের বিষয় কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল তা করতে দেয়নি।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “দানের সহিত প্রেম ও শ্রদ্ধা মিলিলে তবেই না তাহা সমগ্র ও সুন্দর হয়”।

বীর প্রসবিনী পটিয়ার কৃতিসন্তানরা সত্যি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য দানের সহিত প্রেম ও শ্রদ্ধা ছিলো বলে পটিয়ায় তৎকালীন বিভিন্ন শিক্ষানুরাগীরা উদ্যেগ নিয়ে পর্যায়ক্রমে অসংখ্যা স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেসময় দক্ষিণ ভূর্ষি গ্রামের দত্ত পরিবারের কথা না বললে নয়। দত্ত পরিবারের দুর্গা কিঙ্কর দত্ত ১৮৪৫ সালে পটিয়া সদরে পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্টা করেন। দুর্গা কিঙ্কর দত্ত ছিলেন পটিয়া ইশকুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক।

তৎকালনীসময়ে জনহিতৈষী গুটিকয়েক মানুষের দান ও সহযোগিতায় আজকের পটিয়া সরকারি কলেজ। বিশেষ করে সুচক্রদন্ডী গ্রামের খলিলুর রহমান পটিয়াতে প্রথম কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যেগ নিলে তার অনুরোধে পটিয়া ইশকুল কর্তৃপক্ষ পটিয়াবাসীর উচ্চ শিক্ষার কথাভেবে কিছু জমি ছেড়ে দেন। ১৯৬২ সালে পটিয়া কলেজ যাত্রা শুরু করেন। ১৯৬৩ সালে পটিয়া আদর্শ ইশকুলের দানকৃত ২.৫ একর জমির উপর কলেজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। এবং আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে পটিয়া নাইখাইন গ্রামের দেশবরেণ্য গণিতবিশারদ ডক্টর আতাউল হাকিম আনুষ্ঠানিকভাবে কলেজের ক্লাস উদ্বোধন করেন। ১৯৬৭ সালে পটিয়া কলেজের ২৩ জুলাই বিজ্ঞান ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। ১৯৭৮ সালে পটিয়া কলেজ জাতীয়করণ হয়।

হামিদুর রহমানের সবচেয়ে বড়ো সামাজিক অবদান তিনি ১৯৬২-৬৩ সালের দিকে পটিয়ার কিছু পরিত্যাক্ত সম্পত্তি এবং শত্রু সম্পত্তি পটিয়া সরকারি কলেজের নামে নিয়ে নেন। পরিত্যাক্ত সম্পত্তিগুলো ছিলো শান্তিময় খাস্তগিরের। তৎকালীন হামিদুর রহমান ছিলেন পটিয়া কলেজ পরিচালনা কমিটির সাধারন সম্পাদক এবং পটিয়া কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

পটিয়ায় কলেজ প্রতিষ্টার কথাভেবে হামিদুর রহমান রমেশ চন্দ্র গুপ্ত-র মাধ্যেমে পরিত্যাক্ত সম্পত্তি প্রায় ৪.৭৬ একর জমি পটিয়া কলেজের নামে হয়ে যায়। পটিয়া ইশকুলের দক্ষিন পাশে পুকুর পাড়ের চতুর্দিকে জমিগুলো ছিলো পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের নামে ছিলো। আবদুস সোবহানা রাহাত আলী ইশকুরে প্রাক্তন ছাত্র পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শ্ক্ষিক রমেশ চন্দ্র গুপ্ত হামিদুর রহমানকে সহযোগিতা করেন। পটিয়া কলেজ প্রতিষ্টার পেছনে যাদের সবেচেয় বড়ো ভূমিকা ছিলো শিক্ষাবিদ রমেশচন্দ্র গুপ্ত(ভাটিখাইন), খলিলুর রহমান(সুচক্রদ-ী),শান্তিময় খাস্তগির, কাশেম জুট মিলের মালিক আবুশ কাশেম(৪নং ওয়ার্ড), হামিদুর রহমান(৫নং ওয়ার্ড) ন্যাপ নেতা মাসুদ চৌধুরী (৪নং ওয়ার্ড) সহ আরো অনেকে। হামিদুর রহমান চাইলে পরিত্যাক্ত সম্পত্তিগুলো নিজের নামে করে নিতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামে করে দিয়েছেন। কলেজের কোনো জায়গায় তার নামকরণ পর্যন্ত রাখেননি। ১৯৭১ সালে আজকাল তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিছু দান করার আগে কার নামে নামকর হবে দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। পটিয়ায় শুধু নামকরণ নিয়ে কাদাছোড়াছুড়ির কারনের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা হয়নি।

পটিয়া কলেজের দক্ষিন পাশে রাস্তাটি একসময় কলেজ সংলগ্ন ছিলো। হামিদুর রহমানের সহযোগিতায় তিনি কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের অসুবিধার কথা ভেবে কলেজের দক্ষিণ পাশে রাস্তাটি স্থানান্ত করেন। শুধু তাই নয় পটিয়া কলেজের ভিতরে একসময় ক্যান্টিন স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। অধ্যাপক আবদুল আলীম স্যরের পরামর্শে হামিদুর রহমানের সহযোগিতায় উক্ত ক্যান্টিনটি রাস্তার মাথায় খালের পাড়ে যেখানে বর্তমান কাঁচাবাজার/মাছ বিক্রি করে সেখানে স্থাপন করা হয়েছিল। সত্যি বর্তমানযুগে হামিুদর রহমানদের মতো ত্যাগি ও শিক্ষানুরাগী মুক্তিযুদ্ধ সংগঠকের বড়ো অভাব এরাই ছিলেন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক পটিয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যারাই অবদান রেখেছিরেন তারাই আমার কাছে এ যুগের সোনার বাংলার সোনার মানুষ। নিরঅহংকার সহজ সরল বিনয়ী শিক্ষানুরাগী হামিদুর রহমান ২০১৪ সালে ১৩ ডিসেম্বর না ফেরার দেশে চলে যান তার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। নবম মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রীসহ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতি তার পরিবারের আকুল আবেদন ও আমাদের প্রত্যাশা ভাষা সৈনিক ও জনহিতৈষী মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক প্রয়াত হামিদুর রহমানকে যেনো মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেয়া হয়।

লেখক: কলামিস্ট, সদস্য; বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী

সারাবাংলা/এসবিডিই

ভাষা সৈনিক হামিদুর রহমান: আজও পেলেন না মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মুক্তমত রশীদ এনাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর