১৬ ডিসেম্বর সংবিধান কার্যকর দিবস
১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ১১:১৬
স্বাধীনতার ৫২ বছর পাড়ি দেয়ার পাশাপাশি আমরা বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের ৫১ বছরও পার করছি। প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর জাঁকজমকপূর্ণভাবে আমরা বিজয় দিবস পালন করলেও অনেকেই আমরা অবগত নই যে ওই দিনটি আমাদের সংবিধানের কার্যকর দিবস হিসেবেও পরিচিত। ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আমরা সদ্য জন্মানো বাংলাদেশের নতুন শাসনতন্ত্র উপহার পেয়েছিলাম ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে।
এর আগে ১৯৫৬ ও ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানে দুটি সংবিধান প্রণীত হলেও মানুষের স্বায়ত্ত্বশাসন, শোষণমুক্তি ও গণতন্ত্র ছিলো উপেক্ষিত। পরবর্তীতে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এক ঐতিহাসিক যাত্রার সু্যোগ সৃষ্টি হয়। ১৯৬৬ সালে ৬ দফার মাধ্যমে শ্রেণিসংগ্রামের ডাক দিয়ে সারা দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন বাঙ্গালী জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। উনারই নেতৃত্বে একটি সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল সত্তরের নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়।
চার শতাধিক জন প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই গণপরিষদের সকলেই ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত পাকিস্থানের জাতীয় পরিষদ এবং পূর্ব পাকিস্থান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও নির্বাচিত হিসেবে ছিলেন জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামানসহ ছিলেন তরুন আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এবং আদিবাসি নেতা মানবেন্দ্র লারমা।
১০ এপ্রিল সকাল ১০টায় পরিষদের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব মওলানা আবদূর রশীদ তর্কবাগীশকে পরিষদের সভাপতি নিয়োগ করেন। তার নেতৃত্বে পরিষদের সকল সদস্য বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য পোষণের শপদ গ্রহন করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রথম স্পীকার হিসেবে শাহ আব্দুল হামিদ এবং প্রথম ডেপুটি স্পিকার হিসেবে মোহাম্মদ উল্লাহ্কে নির্বাচিত করা হয়। গণপরিষদের প্রথম দিনের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্ধারণ করা হয়।
সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে একটি গণতন্ত্র, শোষণমুক্ত সমাজ, সাম্য এবং জনগনের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয়েছিলো। এ বিষয়ে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল্প ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে সংবিধানের খসড়া তৈরি করা। এর জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে রাজনৈতিক স্টিয়ারিং গ্রুপ বা পরিচালনা কমিটি গঠিত হয়, তাতে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, খোন্দকার মোশতাক, কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও কামাল হোসেন।’
এছাড়া ১৯৭১ এর ১০ এপ্রিল মহান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলোকে আদর্শ স্বরূপ ধারন করার একটি প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছিলো। ১৯৭২ এর ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চার মূলনীতির ব্যাপারে গঠনমূলক বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, ‘জনাব স্পিকার সাহেব, আজ স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, এর সঙ্গে সঙ্গে আমি চারটি স্তম্ভকে স্মরণ করতে চাই। যে স্তম্ভকে সামনে রেখে আমাদের দেশের সংবিধান তৈরি করতে হবে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’
১১ এপ্রিল সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে চেয়ারম্যান করে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি ও চারটি কার্যপ্রণালী বিধি প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। এই অধিবেশনটির স্থায়ীত্বকাল ছিলো মাত্র দুদিন। সংবিধান প্রণয়ন কমিটি মোট ৭৪টি সভায় মিলিত হয় ও খসড়া সংবিধান প্রস্তুতে সর্বমোট ৩০০ ঘন্টা সময় তারা ব্যয় করে। কমিটি তাদের প্রথম বৈঠকের রেজুলেশন অনুসারে যেকোনো আগ্রহী ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি সংবিধানের ব্যাপারে যেকোনো পরামর্শ থাকলে ১৮ মে ১৯৭২ এর মধ্যে লিখিতভাবে জানাতে আহবান করে। কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে এই ধরনের পরামর্শ আসে ৯৮টি, যা পরবর্তীতে বিবেচনায় নেয়া হয়।
খসড়া কমিটি ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে ২৯ এপ্রিল এবং ১০ মে থেকে ২৫ মে পর্যন্ত বৈঠকে বসে। ৩ জুন কমিটির বৈঠকে তা পেশ করা হলে ১০ জুন পর্যন্ত আলোচনা এবং বিভিন্ন সংশোধনী গৃহীত হয়। পরবর্তীতে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি খসড়াটির ভাষাগত দিক পরীক্ষা করে দেখে এবং কাজ সম্পূর্ণ হলে সংবিধান প্রণয়ন কমিটি পরবর্তী বৈঠকে মিলিত হয়। এছাড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ড. কামাল হোসেন খসড়া প্রণয়নের বিভিন্ন সময় ভারতীয় সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েটের সহায়তা নিয়েছিলেন।
অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের আত্মজীবনী অনুসারে, বঙ্গবন্ধু সংবিধানের বিষয়ে পরামর্শ দিতে ড. কামাল হোসেনকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং রাজনীতির সাথে ধর্মের সংযোগ ছিন্ন করার লক্ষ্যে সংবিধানে ৩৮ অনুচ্ছেদের সাথে একটি শর্তাংশ জুড়ে দিতে যেখানে বলা হয়েছে-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পন্ন কোনো সাম্প্রদায়িক সমিতি বা ধর্মভিত্তিক সমিতি বা সংঘ করার বা তার সদস্য হওয়ার অধিকার কোনো ব্যক্তির থাকবে না।
১৯৭২ সালের ১০ জুনের মধ্যে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির খসড়া সংবিধান জমা দেয়ার নির্দেশনা থাকলেও ১১ অক্টোবর সংবিধান কমিটির শেষ বৈঠকে খসড়া সংবিধান চুড়ান্ত করা হয়। ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের বাংলা পাঠ বিল আকারে গন পরিষদে উপস্থাপন করা হয়। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর হইতে গণপরিষদে খসড়া সংবিধানের আলোকে একটানা ৪ নভেম্বর পর্যন্ত যুক্তিতর্ক, পাল্টা যুক্তি ও আলোচনা হয়।
গণপরিষদে আওয়ামীলীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার দরুণ বিরোধী দলের আলোচনায় অংশ নেন তৎকালীন ন্যাপ (মোজাফ্ফর) নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত আদিবাসি নেতা মানবেন্দ্র লারমা এবং আব্দুল আজিজ চৌধুরী। পুরো গণপরিষদের বিতর্ক চলাকালে যুক্তি পাল্টা যুক্তির আলোচনায় ছিলো ভরপুর। ড. কামাল হোসেনের যুক্তি এবং তরুণ নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত এবং মাঝে মধ্যে মানবেন্দ্র লারমার পাল্টা যুক্তি গণপরিষদের শোভা আরো বৃদ্ধি করে।
অবশেষে ৪ নভেম্বর স্পীকারের আহবানে ‘লীডার অব দ্যা হাউজ’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সংবিধান প্রণয়ন চুড়ান্ত করেন। নিজের বক্তব্যের একটি অংশে তিনি বলেন- ‘জনাব স্পীকার সাহেব, আজ এই পরিষদে শাসনতন্ত্র পাস হয়ে যাবে। কবে হতে এই শাসনতন্ত্র বলবৎ হবে, তা আমাদের ঠিক করতে হবে। আমি মনে করি, সেইদিন, যেদিন জল্লাদ- বাহিনী রেসকোর্স-ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও আমাদের বন্ধু-রাষ্ট্রের মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, সেই তারিখ। সেই ঐতিহাসিক ১৬ই ডিসেম্বর তারিখ থেকে আমাদের শাসনতন্ত্র কার্যকর করা হবে। সেই দিনের কথা রক্তের অক্ষরে লেখা আছে। স্পীকার সাহেব, সেই ইতিহাস আমরা রাখতে চাই। আজ আমাদের কাজ শেষ হয়ে যাবে। আপনি ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিষদ মূলতবী করতে পারেন। ১৪ই ডিসেম্বর তারিখে সদস্যরা এসে আপনার সামনে অরিজিনাল সংবিধানে দস্তখত করবেন। শাসনতন্ত্র বাংলায় হাতে লেখা হচ্ছে। তাতে সদস্যরা আপনার সামনে দস্তখত করবেন। ১৪ এবং ১৫ তারিখের পর ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২ তারিখে শাসনতন্ত্র চালু হবে। চালু হবে বাংলার মানুষের নতুন ইতিহাস।’
তথ্যসূত্র: ‘সংবিধান বিতর্ক ১৯৭২’, আসিফ নজরুল, প্রথমা প্রকাশন। ড. আনিসুজ্জামানের আত্মজীবনী। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: কাছে থেকে দেখা’, নুরুল ইসলাম, প্রথমা প্রকাশন।
লেখক: কলামিষ্ট, রাজনৈতিক কর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই