ইংল্যান্ডে মানবাধিকারের বিকাশ ‘ম্যাগনে কার্টা’
১০ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:১৫
মানবাধিকারের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ- মানবাধিকারের ধারনা শুরু হয়েছিল খ্রিষ্টীয়পূর্ব ১৫০০ অব্দ হতে। পারতপক্ষে মানবাধিকারের প্রধান ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ মহানবী (সাঃ) কর্তৃক “মদীনা সনদ” ঘোষণার মধ্য দিয়ে। এরপর ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডে যে ম্যাগনে কার্টা সাক্ষরিত হয় যাকে মানবাধিকারের প্রথম সনদ বলা হয়। এই মানবাধিকারের উৎপত্তি এর ব্যাপারে কিছু উল্লেখযোগ্য দিক নীচে তুলে ধরা হল-
এই পৃথিবীতে মানবাধিকারের উৎপত্তির ব্যাপারে যে দলিলটির কথা বলা হয় তা হল ম্যাগনে কার্টা এর দলীল। তৎকালীন রাজা জনের অত্যাচার বন্ধ করতে স্টেফানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল রাজার সাথে ম্যাগনে কার্টা দলীলটির সাক্ষর করেন যেখানে ৬৩টি ধারা উল্লেখ ছিল। প্রকৃতপক্ষে এই চুক্তিটি সাক্ষরিত হয় ব্যারনদের (তথা জমির মালিকদের নিম্নভূক্ত খেতাব) সাথে রাজার যার দ্বারা ব্যারনদের অধিকারের দায়িত্ব রাজাকে নিতে হয়েছিল।
বিল অফ রাইটস প্রদান
১৬২৮ সালে পার্লামেন্ট কর্তৃক “বিল অব রাইটস” প্রদান করা হয় যা ছিল মানবাধিকারের সর্বপ্রথম সাংবিধানিক দলীল। এ দলীলে মাত্র ৪টি ধারা ছিল যার দ্বারা অহেতুক করারোপ, কাউকে জেলে আটকানো, রাজার কমিশন জারী করার ব্যাপারে সীমাবদ্বতা আনা হয়। যদিও এ দলীলটির বাস্তবে প্রয়োগ ঘটে নাই। এ ধারাটি বাস্তবায়ন না করার দরুন রাজা চার্লসকে ১৬৪৯ সালে প্রাণ দিতে হয়েছিল।
পিটিশন অফ রাইটস প্রদান
১৬৮৯ সালে ইংলিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক পিটিশন অব রাইটস প্রণীত হয় যারদরুন রাজশক্তি জনশক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। এ ধারা কার্যকর হওয়ার পর পর রাজার ক্ষমতা অনেকাংশে হ্রাস্ব পায়। এ প্রসংগে ও.হুদ ফিলিপ বলেন, “বিল অব রাইটস হল মানবাধিকারের সর্বপ্রথম ভিত্তি”। পরবর্তীতে ১৭০১ সালে এক্ট অব সেটেলমেন্ট প্রণয়ন করা হয় যার দ্বরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
আমেরিকাতে মানবাধিকারের বিকাশ
ইংল্যান্ডের পর মানবাধিকার বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে যুক্তরাষ্ট্র। ঔপনিবেশিক শাসনের কব্ল থেকে রক্ষা করার জন্য ১৭৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার মহানায়ক জর্জ ওয়াশিংটন পেনসেলভেনিয়ার ফিলাফিলডেল হতে Declaration of Independence এর ঘোষণা দেন। যেখানে বলা হয়,
“All men are created equal with inalienable rights to life, liberty and the pursuit of happiness”.
এ অধিকারগুলোকে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ ঘোষণায় জনগণের এমন ক্ষমতা ও অধিকারের কথা বলা হয়।
ফ্রান্সে মানবাধিকার
যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারকে অনুসরণ করে ফ্রান্সে ১৭৮৯ সালে বিপ্লব সংঘটিত হয়।বিপ্লবে তৎকালীন রাজা ষোড়শ লুই ও তার স্ত্রী রাণী মেরিসহ অনেক রাজপ্রসাদের কর্মচারীদের গিলেটিনে হত্যা করা হয়। এরপর বিপ্লবীদের দ্বারা দেশ পরিচালিত হতে থাকে এবং তারা একটি সংবিধান প্রণয়ন করে। তারা মানুষের মৌলিক মানবাধিকারের ব্যাপারে তারা “Declaration of the rights of man and Citizens” নামে একটি দলীল প্রণয়ন করে।এখানে মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, ধর্মীয় অধিকারের স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকারের স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করা হয়। এখানের বলা হয়, “Men are born and remain free and equal in rights”. এখানকার ধারনাসমূহ কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে মানবাধিকারে বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জাতিসংঘ কর্তৃক মানবাধিকার ঘোষণা
১৯১৪ হতে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত প্রথম বিশ্ব যুদ্ব চলতে থাকে যেখানে প্রায় দেড় কোটি মানুষ নিহত হয়। এরপর ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ব সংঘটিত হয় যেখানে প্রায় ছয় কোটি লোক নিহত হয়। এতে হিটলারের নাৎসি বাহিনী কর্তৃক প্রায় ষাট লক্ষ ইয়াহূদী প্রাণ বিসর্জন দেয়।তখন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সারা বিশ্বের মানুষ নতুন করে চিন্তা-ভাবনা শুরু করল। ২য় বিশ্ব যুদ্ব চলাকালীন সময় থেকে মিত্রশক্তি মানবাধিকারের কথা চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। ১৯৪১ সালের ১৪ই আগষ্ট আটলান্টিক চার্টার ও ১৯৪২ সালের জানুয়ারিতে জাতিসংঘের গৃহীত ঘোষণায় এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়। ১৯৪৫ সালে সান-ফ্রান্সিসকোতে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হলেও সেখানে মানবাধিকারের ব্যাপারে কোন সুস্পষ্ট নীতি-মালা ছিল না যদিও একটি মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়েছিল। ১৯৪৬ সালের জানুয়ারি মাসে সাধারণ পরিষদের প্রথম অধিবেশনে আন্তর্জাতিক অধিকারসমূহের বিল প্রণয়ন করার পরিকল্পণা গ্রহণ করা হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি হতে এর কাজ শুরু হয়।অতঃপর ১৯৪৮ সালের ১০ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের ৩৮টি দেশের সম্মতিতে সর্বপ্রথম মানবাধিকার সনদ প্রণয়ন করা হয়। এ ঘোষণায় ১৯টি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার এবং ৬ টি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের কথা স্বীকৃত। পরবর্তীতে অনেক দেশ ঔপনিবেশিক শাসনের কবল হতে রক্ষা পায় ১৯৬৬ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সে দেশগুলোর সম্মতিক্রমে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা দেয়া হয় এর ফলশ্রুতিতে ১৯৭৬ সালে জাতিসংঘের ৩৫তম সদস্যের অনুমোদন নিতে বাধ্য করা হয়।পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালের ১৫ই ডিসেম্বর ৫৯টি দেশের সম্মতিতে মানুষের রাজনৈতিক অধিকার,মৃত্যুদণ্ডাদেশ বেশ কয়েকটি সনদ যুক্ত করে। এভাবে করে বিভিন্ন সময় মানবাধিকারের ক্রমবিকাশ হতে থাকে এবং তা বর্তমানরুপ ধারন করেছে।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
ইংল্যান্ডে মানবাধিকারের বিকাশ ‘ম্যাগনে কার্টা’ মুক্তমত সৈয়দ আমিরুজ্জামান