মুক্তিযুদ্ধ থেকে বাংলাদেশ হওয়ার ইতিহাস
১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৬:০৬
পরাধীন জাতির স্বপ্ন সাধ ও মর্যাদা বলতে কোন কিছুই থাকেনা। কোন জাতি পরাধীন থাকতে চাই না। পরাধীন জাতি শোষিত ও বঞ্চিত হতে-হতে একসময় তাদের মধ্যে জন্ম নেয় সংগ্রামী চেতনার। একসময় আমাদের আজকের বাংলাদেশে পরাধীন ছিল। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। শুরু হয় বাঙ্গালীদের উপর আরো ২৪ বছরের শাসন শোষণ ও নিপীড়ন । প্রথমেই ৫২ এর বাকরুদ্ধ করণের চেষ্টা, ৫৪ তে নির্বাচনে বানচাল করা ও ৫৮ সালের সামরিক শাসন জারি করা সহ আরো কত অমানবিক নির্যাতন। সামাজিক রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে ক্ষোভের অবসান ঘটে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের মাধ্যমে। তারপর একাত্তরের ১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে পরিচিতি লাভ করে ।
এবার আসুন পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালির অবস্থা সমন্ধে অবগত হোন। পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালির অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলাকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে গড়ে তোলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। বাংলা ভাষা ও সাংস্কৃতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, পাকিস্তানের রাজধানী ও সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তর শিল্প কারখানা সহ সবই পশ্চিম পাকিস্তানের গড়ে তোলা হয়। ফলে বাঙালীরা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রশাসনিক সামরিক সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হতে থাকে । প্রথমেই জেনারেল মোঃ আলী জিন্না ৫৬.৪% বাঙালি থাকা সত্তেও ৩.২৭% মানুষের উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চায়। প্রথম গণপরিষদে মোট সদস্য সংখ্যা ৬৯ জনের মধ্যে ৪৪ জন বাঙালি ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় গণপরিষদে মোট সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৮০ জন হলেও বাঙালি ছিল মাত্র ৪০ জন। আবার ১৯৪৭-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত প্রথম প্রথম শ্রেণীর মোট ২,৮১৬ জন কর্মকর্তার মধ্যে বাঙালি ছিল মাত্র ৭৩২ জন। অর্থাৎ শতকরা ২৩%। সামরিক ক্ষেত্রেও ৫৯০ জনের মধ্যে বাঙালি কর্মকর্তা ছিল মাত্র ২০ জন। তেমনি অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বৈশম্য বিদ্যমান ছিল।
এবার আমরা মুক্তিযুদ্ধের পেক্ষাপট সমন্ধে একটু জানবো : ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ই মার্চ রাতের আগ-পর্যন্ত পাকিস্তানিদের দ্বারা গঠিত সকল বর্ভরতা, অত্যাচার, নির্যাতন বাঙালির মনে স্বাধীনতার সংগ্রামী চেতনার উন্মেষ ঘটায়। যার প্রতিফলন ঘটে বাঙালির স্বাধীনতার মহা নায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর বহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে। কিন্তু পাকিস্তানের দখলদার শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গোলা বারুদ এনে মজুদ করতে থাকে। একপর্যায়ে ২৫ শে মার্চ রাতে বঙ্গন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায় এবং গভীর রাতে ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর চালায় ইতিহাসের জগন্যতম হত্যাকাণ্ড। আর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
২৫শে মার্চ কালোরাত্রিতে পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞে সারা বাংলাদেশের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এমনি অবস্থায় গ্রেফতারের আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতা ঘোষণা দেন তা ওয়ারলেসের মাধ্যমে প্রাপ্ত হয়ে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে পাঠ করলে সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ঘোষণাটি ছিল এরকম যে, ইয়াই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগনকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছে যাহার যা কিছু আছে তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো, পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এবং চুড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকার গঠন অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের গতি বাড়াতে ও দেশের নেতৃত্বের জন্য মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন হয় এবং একই দিনেই আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র জারি করা হয়। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করেন যেখানে রাষ্ট্রপতি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, প্রধানমন্ত্রী করা হয় তাজউদ্দিন আহমেদকে এবং প্রধান সেনাপতি করা হয় কর্নেল এম. এ.জি.ওসমানীকে।
পাক হানাদার বাহিনীর জ্বালা পোড়াও অত্যাচার নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে জীবন বাঁচাতে লক্ষ-লক্ষ নারী-পুরুষ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নেয়। এর মধ্যেই কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী একটি বিরাট গেরিলা বাহিনী ও নৌ কমান্ড বাহিনী গঠন করেন। এর পাশাপাশি তিনি বিমানবাহিনী গঠন করেন। বিমানবাহিনী তাদের নিজস্ব বিমান নিয়েই ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম ও ঢাকায় প্রথম বিমান হামলা চালায়। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সমগ্র বাংলাদেশকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রত্যেক সেক্টরে একজন কমান্ডার নিযুক্ত করা হয় এবং এই কমান্ডারদের অধীনেই মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষের দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধ তীব্রতর হয়ে ওঠে। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ৪ ডিসেম্বর থেকে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী যৌথভাবে আনাদার বাহিনীদের বিপর্যস্ত করে তোলে। ৬ ডিসেম্বর ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ৪-১২ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সবগুলো ঘাঁটি দখল করে নেয়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যেই বিভিন্ন অঞ্চল শত্রুমুক্ত হয়। ১৬ই ডিসেম্বর বিকালে রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী হাজার হাজার উৎফুল্ল জনতার সামনে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করে যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ববৃহৎ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। তাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আসল চেতনা ধারণ করতে হবে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে সকল শ্রেণীর মানুষকে মানবিক হয়ে একযোগে কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে সেটিকে রক্ষা করা কঠিন। তবেই আমরা সামনে অগ্রসর হতে পারবো।
লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম
সারাবাংলা/এসবিডিই