Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিজয়ের ৫২ বছরে বাংলাদেশ: অর্জন ও প্রত্যাশা

ইমরান ইমন
১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:৪৩

দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ত্রিশ লাখ শহীদের তাজা রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা অর্জন করেছি চূড়ান্ত বিজয়, পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র, পেয়েছি লাল-সবুজের গৌরবান্বিত একটি পতাকা। এদেশের প্রতি বর্গকিলোমিটার অর্জিত হয়েছে শহীদদের তাজা রক্তের বিনিময়ে।

১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির মহান বিজয় দিবস। জাতির সূর্যসন্তান যাদের মহান আত্মত্যাগে এই বিজয় অর্জিত হয়েছিল তাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করার দিন। বাংলাদেশের ইতিহাস হলো স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য কোটি কোটি খেটেখাওয়া মানুষের সুদীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস। আজকের এই মুক্তি ও স্বাধীনতা বাঙালির দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ও সাধনার ফসল। বঙ্গোপসাগরের বুক থেকে জেগে উঠা প্রায় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই সুজলা-সুফলা উর্বর জনপদটির জনগণ সুপ্রাচীন কাল থেকেই মুক্তি ও স্বাধীনতাপ্রিয়। কালে কালে এ দেশের মানুষ লড়াই করেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, দেশীয় সামরিক-বেসামরিক স্বৈরাচার ও লুটতরাজ শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে।

১৭৫৬ সালে পলাশীর প্রান্তরে এক প্রহসনমূলক যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর এদেশের মানুষ বৃটিশ শাসন-শোষণ এবং ষড়যন্ত্রের সকল জাল ছিন্ন করে একটি স্বাধীন স্বদেশভূমি প্রতিষ্ঠিত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। ১৯৪৭ সালে বৃটিশদের বিতাড়িত করে স্বাধীনতা লাভ করলেও অচিরেই বাঙালিরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে যে—এ স্বাধীনতা আসলে স্বাধীনতা নয়; এটা ক্ষমতার হাত বদল মাত্র। বিষয়টি খুব স্বল্প সময়ে স্পষ্ট হয়ে উঠে যখন বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত আসে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় জীবন দিয়ে বাঙালি বিশ্বের বুকে ইতিহাস সৃষ্টি করে। ভাষা আন্দোলনে জীবন বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতির মধ্যে যে চেতনা ও দেশপ্রেমের বীজ বপিত হয়েছিল, অধিকার আদায়ের পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অবশেষে ১৯৭১-এর উত্তাল মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে বীরবাঙালি একটি স্বাধীন আবাসভূমির জন্য যার যা আছে তাই নিয়ে মরণ-পণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেদিন সকলের চোখে ছিল দীর্ঘ দিনের শোষণ-নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একটি সুখী-সমৃদ্ধ স্বাধীন দেশ অর্জনের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে ত্রিশ লক্ষ শহীদের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মধ্যদিয়ে বাংলার আকাশে উদিত হয় স্বাধীনতার সোনালী সূর্য। অর্জিত হয় বাঙালির দীর্ঘদিনের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র—বাংলাদেশ।

কিন্তু আজ স্বাধীনতা অর্জনের ৫১ বছর পরও মহান মুক্তিযুদ্ধের এই বিজয়বার্ষিকীতে স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে সেদিন বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে জীবন বিসর্জন দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তার কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে! বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিরা আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে নস্যাৎ করতে বিভিন্নসময়ে নানাভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে এবং তা এখনও চলমান।

২০২১ সালে আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছি। বিজয় অর্জনের এবছর ৫১ বছর পূর্ণ হয়ে ৫২-তে পা দিলো। বিজয় অর্জনের ৫১ বছর পর জাতি প্রকৃতঅর্থে কতটুকু বিজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে পেরেছে—সে প্রশ্নটি সঙ্গত কারণে সামনে চলে আসে।

কত অমুক্তিযোদ্ধা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে যাচ্ছেন। আবার অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আছেন যারা আজ পর্যন্ত সুযোগ-সুবিধা তো দূরে থাক নিজের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতিটুকুও আদায় করতে পারেননি। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার হিসেবটি কখন, কীভাবে জানা যাবে—সে কথাটি কেউ বলে দিতে পারে না। আমাদের জীবিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা খুব দ্রুত কমে যাচ্ছে। সম্ভবত আগামী বিশ বছর পর আমরা হয়তো কোনো জীবিত মুক্তিযোদ্ধা খুঁজেই পাবো না। মুক্তিযুদ্ধের অনেক প্রকৃত ইতিহাস তখন চাপা পড়ে যাবে। বিশেষ করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের নারীসমাজের অবদানটি সঠিকভাবে আজ পর্যন্ত ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে নারীর ইতিহাস পৃথক করে লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন। কতজন তারামন বিবি ও কাঁকন বিবি আমাদের আছেন সে হিসেব কারো কাছে নেই। তারা কতইনা কষ্টে তাদের জীবন অতিবাহিত করেন। তাদের কতজনের বাড়ি-ঘর নেই, কতজনে ভিক্ষা করে খায়, কতজনে রোগে-শোকে জর্জরিত সে খবরটুকুও রাখার আগ্রহ কারো নেই।

মুক্তিযুদ্ধের এতগুলো বছর অতিক্রম হওয়ার পরও আমরা মুক্তিযুদ্ধের নানা ইস্যুতে এখনও দ্বিধা-বিভক্ত। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আজও বিতর্কে জড়িয়ে আছি। মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার মহান ঘোষক কে—সে নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। যিনি পাঠ করেছেন তিনি পাঠক। তিনি ঘোষক হন কীভাবে? ঘোষক আর পাঠকের মধ্যকার পার্থক্যটুকু আজ পর্যন্ত আমরা বুঝে উঠতে না পারলে কে আমাদের বুঝিয়ে দেবে? আমাদের জাতির জনক প্রশ্নে আজও বিভক্তি ও বিতর্ক রয়ে গেছে। পৃথিবীর আর কোথাও তা নেই, আমাদের প্রতিবেশী ভারত কিংবা পাকিস্তানেও জাতির পিতা নিয়ে কোনো প্রকার বিতর্ক কোনোদিন শোনা যায়নি।

পাকিস্তানে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর ভারতে মহাত্মা গান্ধী তাদের অবিসংবাদিত জাতির পিতা। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে এতো বিসংবাদ কেন?

তাছাড়া জাতীয়তা নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে দেয়ার প্রয়াস অব্যাহত আছে। আর তা আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয়ের বড় কলঙ্ক ছাড়া আর কিছু নয়।

আরেকটি বিষয়ে অপরিহার্যভাবে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। তা হলো—আমাদের স্বাধীনতার স্বাদ ও বিজয়ের সুফল সাধারণ জনগণ অপেক্ষা সমাজের কথিত উঁচুশ্রেণী, ক্ষমতাবান গোষ্ঠী বেশি ভোগ করে আসছে। কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামে সাধারণ জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ তাদের চেয়ে বেশি ছিল। আমাদের চারদিকে ভালো করে তাকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একেবারে সাধারণ পরিবারের অশিক্ষিত কিংবা অর্ধ-শিক্ষিত লোকেরা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে স্বতঃস্ফুর্ত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল—একটু ধনী, স্বচ্ছল কিংবা কথিত বড় লোকেরা সেভাবে মুক্তিযুদ্ধে আগ্রহ দেখায়নি। আজ কিন্তু বিজয়ের স্বাদ ও স্বাধীনতার সুফল মূলতঃ তাদেরই ঘরে। মাঝখান দিয়ে সঠিক মানুষরা বঞ্চিত। বিজয়ের ৫১ বছর পরও এমন বৈষম্যমূলক দৃশ্য দেখা—এর চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে?

স্বাধীনতা পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে পুণর্গঠনের দায়িত্ব হাতে নেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার স্বপ্ন ছিল সোনার বাংলা গড়ে তোলার। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্নকে ঘাতকের বুলেটে থমকে দেওয়া হয়। সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন তখন কিছুটা থমকে যায়। কিন্তু ধাপে ধাপে দেশ আজ সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। স্বপ্নের পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

যেখানে পুরো বিশ্ব বলেছিল বাংলাদেশ পদ্মাসেতু নির্মাণ করতে পারবে না, বাংলাদেশকে অনেকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন—সে বাংলাদেশ এখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—বাংলাদেশ সবই পারে।
সময়ের তুলনায় বাংলাদেশ খুব বেশি অগ্রসর কিংবা অগ্রগতির স্বাদ না পেলেও এগিয়ে চলেছে ধাপে ধাপে। বর্তমানে আমাদের কতগুলো উন্নয়ন পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে। তা হলো— আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবো।

যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমীক্ষায় বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশসহ ‘নেক্সট ইলেভেন’ সম্মিলিতভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশকে ছাড়িয়ে যাবে। লন্ডনের একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা লিখেছে, ২০৫০ সালে প্রবৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশ পশ্চিমা দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে।

অর্থনীতির দিক দিয়ে আমরা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছি সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সব দিক দিয়েই আমাদের সমান্তরালে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। দেশের শিক্ষাখাতে দিতে হবে বিশেষ গুরুত্ব। শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার মান বৃদ্ধি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

তাছাড়া অপরাধপ্রবণতা বন্ধে, দেশকে শান্তিপূর্ণ রাখতে রাষ্ট্রকে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, পাশাপাশি নাগরিকদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করে অসাম্প্রদায়িক, নৈতিক ও মানবিক হতে হবে। সর্বোপরি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে ধারণ করে দেশপ্রেমের মাহাত্ম্যকে লালন করে প্রত্যেক নাগরিককে যার যার অবস্থান থেকে দেশের সার্বিক কল্যাণের জন্য কাজ করে যেতে হবে। তবেই আমরা বিনির্মাণ করতে পারবো সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ। তখনই অর্জিত হবে স্বাধীনতার প্রকৃত উদ্দেশ্য।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

ইমরান ইমন বিজয়ের ৫২ বছরে বাংলাদেশ: অর্জন ও প্রত্যাশা মুক্তমত


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর