যৌন ও প্রজনন-স্বাস্থ্য শিক্ষা বিষয়ে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি
১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৫:৪৪
কৈশোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় নারী-পুরুষ সকলের জন্য, বিশেষ করে নারীদের জন্য। এ সময়টাকে বয়ঃসন্ধিকাল বলা হয়। এ সময়ে ছেলে ও মেয়ে, উভয়ের শরীর ও মনে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটে। তবে চিকিৎসকদের মতে, এ সময়ে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে বেশি মানসিক চিন্তার ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। এছাড়া মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল ছেলেদের চাইতে কিছুটা আগেও শুরু হয়। একটি মেয়ে পরিপূর্ণ নারী হয়ে ওঠে তার মাসিকের মাধ্যমে। আমাদের সমাজে মাসিক বা পিরিয়ড শব্দটিকে লজ্জা, সংকোচ ও বিব্রতকর হিসেবে দেখা হয়। বিষয়টি এতোটাই স্পর্শকাতর যে, মেয়েটি তার জীবনের আকস্মিক পরিবর্তনের কথা কারো সাথেই মন খুলে বলতে পারে না। ভয়, লজ্জা ও সংশয় মানসিকভাবে তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়; যা তার ওপরে ভয়ানক প্রভাব ফেলে। এমনকি, তার মধ্যে প্রজননস্বাস্থ্য নিয়েও অনেক প্রশ্ন দেখা দেয়। এ সময়ে পরিবার-পরিজনের সহযোগিতা পেলে ভয়, সংকোচ, নেতিবাচক ভাবনা ও মানসিক অস্বস্তি কমে যায় তার। নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার সাথে মানসিক অবস্থা খুব শক্ত ও মৌলিকভাবে জড়িত। প্রজননস্বাস্থ্য বলতে সাধারণত প্রজননের সাথে অঙ্গগুলোর স্বাস্থ্যকেই আমরা বুঝে থাকি, কিন্তু আসলে বিষয়টা তা নয়। নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা, বয়ঃসন্ধিকালের যত্ন, সন্তান জন্মদানের জন্য গর্ভধারণ, পরিবার-পরিকল্পনা ও পদ্ধতি নির্বাচন, স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্কসহ এ সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ই মূলত প্রজননস্বাস্থ্য- এ তথ্যটি অনেকেই বুঝতে ভুল করেন। প্রজনন বিষয়টিকে নিয়ে আলোচনা করাকেও লজ্জার বিষয় হিসেবে দেখা হয় আমাদের সমাজে। তাই এ বিষয়ে স্পষ্ট জ্ঞান না থাকায় সমাজে রয়ে গেছে অজ্ঞতা। অথচ এই প্রজননস্বাস্থ্য সামগ্রিক সুস্থতার সাথে সরাসরি জড়িত। প্রজননস্বাস্থ্য ভালো না থাকলে সার্বিকভাবে সুস্থ থাকা যায় না। প্রজননস্বাস্থ্য সকলের জন্য তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে নারীর সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। মাসিকের সময়ে সতর্কভাবে তার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা আবশ্যক। নিরাপদভাবে এ সময় না থাকলে নানা রোগে তাকে ভুগতে হয়। পরবর্তীতে এর ফলে নারীকে বিভিন্ন জটিলরোগে আক্রান্ত হওয়ার তীব্র আশংকাও রয়ে যায়। সুতরাং, এ সময়ে নারীর স্বাস্থ্যসুরক্ষা শতভাগ জরুরি। সুস্থ থাকার জন্য পুষ্টিকর খাবারের বিকল্প নেই। অপুষ্টির শিকারে ভোগে নারীরা বেশি। তাই এ সময়ে নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সুষমখাদ্য, প্রচুর পুষ্টিকর খাবার এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম প্রয়োজন। পানি শরীরের ত্বককে সজীব ও প্রাণবন্ত রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই পর্যাপ্ত পানি পান করার অভ্যাসও রাখতে হবে। পাশাপাশি, সুস্থ থাকার জন্য পর্যাপ্ত ঘুমেরও প্রয়োজন, কারণ ঘুম মস্তিষ্কের স্নায়ুযুদ্ধের চাপ কমায়; উপরতু শরীরের কোষগুলোকেও আরাম দেয়। শৈশব থেকেই তাই প্রজনন স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হয়, যা তাকে ছোটোবেলা থেকেই শিক্ষা দিতে হয় পরিবার থেকে। কারণ, একটি শিশু ঠিকভাবে পুষ্টি না পেলে তার প্রজনন অঙ্গগুলো ঠিকভাবে বেড়ে ওঠে না। নারীর যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে জনসচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। এ বিষয়ে অ্যাডভোকেসিসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে মনে করি।
বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়বস্তু নতুন এবং স্পর্শকাতর একটি বিষয়। যেকোনো নতুন এবং স্পর্শকাতর বিষয় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তাই কিছু বাড়তি চ্যালেঞ্জ আছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থাসহ সার্বিক বিবেচনায় স্পর্শকাতর কোনো বিষয়ে শ্রেণিকক্ষে পরিপূর্ণভাবে শিক্ষণ-শিখনে অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমাদের পারিবারিক জীবনের দিকে যদি আমরা দৃষ্টি দেই, সেখানেও একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি দেখতে পাই। বিদ্যালয়সহ নিজের পারিবারিক পরিমণ্ডলেও বয়ঃসন্ধিকালীন সঠিক শিক্ষা থেকে আমাদের কোমলমতি শিশুরা কিছুটা বঞ্চিত হচ্ছে। যেটি তাদের জীবনে অনিবার্য। সেই শিক্ষাটি সঠিকভাবে না পাওয়ার কারণে তারা অনেক ভুলভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা পরবর্তীতে তার মানসিক বিকাশেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এমনিভাবেই, বিদ্যালয় ও পরিবার সব জায়গাতেই বয়ঃসন্ধিকালীন যৌন ও প্রজনন শিক্ষা সঠিকভাবে না পাওয়ার মূল কারণ সামাজিক কুসংস্কার, খোলামেলাভাবে এগুলো আলোচনা করার পরিবেশ না থাকা এবং এ সকল বিষয়াদি জনসম্মুখে প্রকাশে কিছুটা লজ্জা বোধ করে। সামাজিক সংস্কারের কারণে, অভিভাবক যেখানে এগুলো এড়িয়ে যান, সেখানে মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে এগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়নে যে চ্যালেঞ্জ থাকবে তা বলাই বাহুল্য। যেহেতু বাংলাদেশের সমাজে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক খোলামেলা আলোচনা অনেকটা অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ একটি বিষয়, তাই এসব বিষয়বস্তু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান করা হলে সামাজিকভাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাধা যে আসবে না, সেটিও গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাবে না। অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুভূতির সাথেও বিষয়টি মেলানোর সম্ভাবনা ও দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে, মাদরাসা পর্যায়ে এগুলোকে আরও বেশি করে সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যৌন, প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার বিষয়ক ধারণা লাভ করা যেহেতু জীবনের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি বিষয়, সুতরাং, এ বিষয়টি শিশুদের সঠিকভাবে শেখানোর জন্য পরিবার এবং বিদ্যালয়ই হচ্ছে সবচেয়ে উপযোগী স্থান মনে করি। বিদ্যালয়ে এ বিষয় শেখানোর জন্য পরিবার ও সমাজকে সম্পৃক্ত করাও প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এগিয়ে আসতে পারে। এছাড়াও শিক্ষক ও অভিভাবকদের উক্ত বিষয়ে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। তা না হলে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে নিয়মিত মিটিং-এর ব্যবস্থা করা এবং শিক্ষার্থীদের সাথে সহজ ও সাবলীল সম্পর্ক গড়ে তোলা, যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে সংকোচ আছে সেটি সহজেই দূরীভূত হয়। বিভিন্ন মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সামাজিকভাবে প্রচার প্রচারণার ব্যবস্থা করা।
যত বেশি যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য পাঠের বিষয়ে প্রচার করা যাবে তত তাড়াতাড়ি বিষয়টি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। সফলভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের সর্বপ্রথমে সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শিক্ষকদের ধ্যান-ধারণা ও মানসিকতা যদি আধুনিক না হয় তবে তা বাস্তবায়ন দুরূহ হবে। কারণ শিক্ষকরা শুধু শ্রেণিকক্ষের শিক্ষকই নন, তারা সেই সমাজের একজন সক্রিয় প্রতিনিধি এবং সচেতন নাগরিক। যেকোনো সমস্যার জন্য প্রথমে শিক্ষকদেরই জবাবদিহি করতে হবে। সুতরাং শিক্ষকদের খুবই ভালোভাবে এ বিষয়ে তৈরি করতে হবে, যেন তাদের মধ্যে কোনোরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব না থাকে। এর বাইরেও সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে সুপারভিশনের কাজ করছেন এরকম সকল স্তরের কর্মকর্তাদেরকেও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সঠিকভাবে তৈরি করতে হবে। শুরুতেই অনেক বেশি এবং খোলামেলা কথাবার্তা না বলে ধীরে ধীরে শ্রেণিভিত্তিক যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক পাঠদান দেওয়া যেতে পারে, যাতে করে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এগুলো গ্রহণ করার ক্ষেত্রে একটা সহজ ও সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। এছাড়াও মূল্যায়ন ব্যবস্থাতেও উক্ত বিষয়ের জ্ঞান ও দক্ষতাকে সক্রিয় বিবেচনায় রাখতে হবে, যেন শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। সমাজের সর্বস্তরের জনগণসহ শিক্ষক ,অভিভাবকগণ যদি যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য পাঠের বিষয়ে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করেন তাহলে যৌন ও প্রজনন-স্বাস্থ্য শিক্ষা বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং কমিউনিটি পর্যায়ে বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই
অমিত বণিক মুক্তমত যৌন ও প্রজনন-স্বাস্থ্য শিক্ষা বিষয়ে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি জরুরি