নির্বাচন ও তরুণ ভোটারদের স্বপ্ন
২১ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৫:১১
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ দ্বারপ্রান্তে। সারাদেশ নির্বাচনের উৎসবে মেতে ওঠার অপেক্ষায় রয়েছে। প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দের পর এখন জোরেশোরে চলছে প্রচার-প্রচারণা। যেহেতু অনেক যাচাই বাছাই করে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হয়েছে তাই ধরেই নেয়া যায় এই প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকার জনসাধারণের কাছে জনপ্রিয়। তারা এলাকার উন্নয়ন করতে সক্ষম। ভোটের মাধ্যমে জনগণ তাদের উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচিত করবে। জনগণের ভাগ্য উন্নয়ন ঘটাতে পারবে যারা নিঃসন্দেহে ভোট তার পক্ষেই যাবে। ভোটের মূল হলো জনগণ। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হলো উপযুক্ত ব্যক্তি মনোনয়ন করা। কারণ আগামী পাঁচ বছর তাদের জীবনযাত্রাসহ অনেক কিছুই এইসব নির্বাচিত নেতাদের ওপরই নির্ভর করবে। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহার সবার সামনে তুলে ধরে। এই ইশতেহার হলো ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা। আমাদের দেশের নির্বাচনের তরুণ ভোটার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। এটিই বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা। কারণ এই নির্বাচনে প্রায় তিন কোটি তরুণ ভোটার রয়েছে। এরা শিক্ষিত এবং সচেতন। তরুণ ভোটারদের একটি বড় অংশই দেশের অর্থনীতি এবং অগ্রগতি নিয়ে সচেতন। এরা কোন দিকে যাবে তা তাদের সিদ্ধান্ত। তরুণ ভোটারদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো তাদের ভবিষ্যত। তাদের ভবিষ্যত যে রাজনৈতিক দলের কাছে উজ্জল এবং ভালো মনে করবে ভোট তাদের দিকেই যাবে। তবে এই বিপুল ভোটার যেদিকে তাদের রায় জানাবে তারা সুবিধাজনক স্থানে থাকবে এটা অনুমেয়ই। তাই নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের চাহিদার ওপর গুরুত্বারোপ করার চেষ্টা করবে। সব রাজনৈতিক দলই চেষ্টা করছে তরুণ ভোটারদের তাদের পক্ষে টানতে। কিন্তু তাদের চাহিদা কি বা তরুণদের জন্য কি কি প্রতিকূল অবস্থা বিরাজ করছে সেসব বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোকে ভাবতে হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে তরুণদের জন্য পরিকল্পনা রাখতে হবে। তরুণরা চায় তাদের ভবিষ্যত গড়তে। যে দল সেই স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করবে তরুণদের ভোট ব্যাংক তাদের দিকেই যাবে এটা নিশ্চিত। আওয়ামীলীগ সরকার তরুণদের টানতে তাদের সময়কালীন বিভিন্ন উন্নয়নচিত্র, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানো, দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর অবদান ও দেশকে নিয়ে তার অসমাপ্ত স্বপ্ন এবং পাশাপাশি দেশ বিরোধীদের কথা বিভিন্ন সময় তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের ডিজিটালাইজেশন ছিল গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটি অন্যতম বিষয়। সে লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতে ব্যাপক হারে ডিজিটাল পদ্ধতির সংস্কার করা হয়েছে। অনেক সেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌছে দেয়া সম্ভব হয়েছে। ইন্টারনেটভিত্তিক কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে আজ বহু তরুণ তরুণি ঘরে বসে আয় করছে। সরকারিভাবে এদের প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি দেশের বেকারত্ব, দুর্নীতি এখনও বড় ধরনের সমস্যা হয়ে রয়েছে। এসবের সাথে লড়াই করবে তরুণরা। আগামীর বাংলাদেশ নির্ভর করছে তরুণ সমাজের উপর। তরুণরাই আমাদের প্রধান শক্তি। তাই তরুণদের ভবিষ্যত গুরুত্ব দিয়েই সব কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হবে। দেশের একটি বড় অংশ এই তরুণ ভোটার। যারা দেশের মূল সম্পদ।
১৮ বছর থেকে ২৮ বছর পর্যন্ত এসব তরুণ ভোটার উচ্চ মাধ্যমিক থেকে শুরু করে চাকুরি খোঁজা এর স্তরে থাকে। এই স্তরে এসে প্রথম স্বপ্ন দেখে একটি চাকরি পাওয়া। কারণ নিন্ম বা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে পড়ালেখা শেষ করা তরুণদের কাছে এমন কোন সুযোগ থাকে না বা পরিবার থেকে ব্যবসা করার মত পুজির যোগ্যতা থাকে না। তাই চাকরিই প্রথম পছন্দ থাকে। সেক্ষেত্রে চাকরির বাজাওে সমান সুযোগ থাকাটা এরা প্রত্যাশা করে। বিশ্বব্যাপী চাকরির বাজার বদলে গেছে। এখন তথ্য ও প্রযুক্তির যুগ। বিশ্বে তাদেরই জয়জয়কার যারা প্রযুক্তিতে দক্ষ। সুতরাং একবাক্যে বলা যায় তরুণদের প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন জরুরি। তরুণদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লেখাপড়ার জন্য চলে যায়। তাদের একটি অংশই আবার দেশে ফিরে আসে না। তারা কেন দেশে ফিরছে না বা মেধা কেন দেশে থাকছে না তার কারণ খুঁজে বের করতে এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে মেধাবীদের মূল্যায়ন করতে হবে। দেশের উন্নয়নের প্রধান সম্পদ হলো মেধাবী যুব সমাজ। এক্ষেত্রে সবার জন্য মেধার সমান সুযোগ থাকছে। এটা মেধাবী তরুণদের জন্য স্বস্তীদায়ক। কিন্তু এর পাশাপাশি চাকুরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা অপরিহার্য। স্বচ্ছতা বলতে বোঝায় ঘুষ বা উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ ছাড়া সম্পূর্ণ মেধার ভিত্তিতে চাকুরির প্রত্যাশা। কিন্তু আমাদের দেশে বহুদিন ধরেই চাকরিতে নিয়োগে টাকা এবং ক্ষমতার প্রভাব লক্ষ্যণীয়। যার বাবার টাকা আর মামার জোর আছে সেই কুলীন হয়। তাই একসময় চাকরিপ্রার্থী হতাশ হয়ে পরে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন এবং সে পথে অগ্রগতি বর্তমান সরকার অনেকটাই অর্জন করেছে। তবে দুর্নীতিটা রয়ে গেছে। আর ঠিক এই কারণেই দরকার তরুণদের মধ্যে সৎ ও যোগ্য মানুষ বেছে নেওয়া যাদের হাতে দেশের নেতৃত্ব তুলে দেওয়া যায়। ইশতেহারে তরুণ চিন্তাভাবনাকে প্রাধান্য দিতে হবে। চাকরির নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করার পরিকল্পণা করতে হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে তাই ঘুষ বাণিজ্য মুক্ত চাকরির বিষয়টি প্রতিফলিত হতে হবে। তাছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য ইন্টারনেটের মূল্য এখনো অন্য দেশের তুলনায় বেশি। তাই ইন্টানেটের দাম কমাতে হবে এবং সেবার মান বাড়াতে হবে। বিশ্বের তুলনায় আমরা এখনও ইন্টারনেট সেবায় পিছিয়ে আছি। কাঙ্খিত গতি দরকার এবং দাম কমাতে হবে। যেসব কাজ ইন্টারনেটভিত্তিক সেগুলো করতে যাতে নূন্যতম খরচ হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
দেশের চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষ করেই সাধারণত বিপুলসংখ্যক তরুণ চাকরির বাজারে ঢোকেন। বাংলাদেশে এ ধরনের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যেই বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ১২ শতাংশই এখন বেকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় ও সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিধারী উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার এখন ১২ শতাংশে পৌঁছেছে। সংখ্যার বিচারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বেকার বসে আছেন প্রায় আট লাখ নারী-পুরুষ। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। যা একটি দেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়। যে কারণে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধি করার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ হবে। বেকাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা নির্বাচনী ইশতেহারে তরুণদের চাওয়া। যখন প্রতিটি যুবকের চোখে থাকবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলার স্বপ্ন। প্রযুক্তির কল্যাণে সারা বিশ্ব এখন একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। সেই গ্লোবাল ভিলেজে যেন আমারাও অবদান রাখতে পারি তরুণ সমাজকে সেভাবেই প্রস্তুত করতে হবে।
বাংলাদেশ ২০৪১ সালে একটি স্মার্ট উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার যে স্বপ্ন নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সেই লক্ষ্যে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল বা বঙ্গবন্ধু সেতু এসব বাংলাদেশের উন্নয়নের চিত্র নির্দেশ করে। তবে আমাদের আরও অনেক পথ যেতে হবে। গ্রামে-শহরে সম উন্নয়ন থাকতে হবে। জীবনযাত্রার মান কাছাকাছি আনতে হবে। যুবকরা যেন গ্রামেই তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয় সেই পরিকল্পনা করতে হবে। শহরমুখী ¯্রােত রুখতে হবে। এগিয়ে চলার সেই পথে বহু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। থাকবেই। সেসব ঠেলেই সামনে যেতে হবে। তরুণরাই দেশের ভবিষ্যত। তরুণ সমাজকে নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। স্বাধীনতার এতগুলো বছর পেরিয়ে আমাদের যাত্রা আরও দ্রুত করতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই