রবীন্দ্রনাথের গতিবিধি ও কার্যকলাপের ওপর পুলিশের নজরদারি
২৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৬:২৭
ভারতবর্ষে বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাসে দেখা যায়, স্বদেশি যুগ থেকে কলকাতার ঠাকুর পরিবারের অনেক সদস্যই বিপ্লবীদের সমর্থন করেছেন, তবে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ইংরেজ সরকারের ভয় ছিল বেশি। শুনলে অবাক লাগে, যৌবনের সূচনা থেকে পুলিশের গোপন খাতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম ছিল। কবির গতিবিধি ও কার্যকলাপের ওপর পুলিশের নজরদারি ছিল ভীষণরকম। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ নজরদারিতে থাকার নানা কারণও ছিল। ‘যুগান্তর’ এবং ‘বন্দে মাতরম’ পত্রিকাদুটি অনেকদিন ধরেই ব্রিটিশ বিরোধী প্রবন্ধ ছাপিয়ে আসছিল। যুগান্তরের সম্পাদক ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এবং বন্দে মাতরমের অঘোষিত সম্পাদক ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ। ১৯০৭ সালের ১১ই মে পূর্ববঙ্গ ও আসামে রাজনৈতিক সভা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে অর্ডিন্যান্স জারি করা হলে পত্রিকাদুটির সমালোচনা আরও তীব্র হয়। সরকারি কর্মচারীরা যেমন মনে করলেন, চণ্ডনীতির দ্বারা মানুষের মনোবল ভেঙে দেবেন, মানুষের সংকল্পও তেমন দৃঢ় হয়ে উঠছিল। সেই সংকল্পেরই প্রকাশ ঘটালেন কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ তার কবিতার মাধ্যমে —
“আমায় বেত মেরে কি মা ভুলাবি,
আমি কি মার সেই ছেলে?
দেখে রক্তারক্তি বাড়বে শক্তি
কে পলাবে মা ফেলে?”
১৬ই জুন যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত ‘নাই ভয়’ ও ‘লাঠ্যৌষধি’ শীর্ষক দুটি প্রবন্ধের জন্য ভূপেন্দ্রনাথকে কলকাতার আলিপুর প্রেসিডেন্সি বিচারালয়ের মুখ্য বিচারক ডগলাস কিংসফোর্ড ২৪শে জুলাই এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন। পরের দিন অরবিন্দ লেখেন ‘One More For The Altar’ শীর্ষক প্রবন্ধখানি। ইতিপূর্বে ২৭শে জুন তার লেখা ‘India For The Indians’ সরকারের দৃষ্টিতে রাজদ্রোহমূলক বলে পরিগণিত হল। ১৬ আগস্ট অরবিন্দ গ্রেফতার হলে আড়াই হাজার টাকার জামিনে মুক্ত হন। কয়েকদিন পরে কবি লিখলেন ‘নমস্কার’ কবিতাটি, যার কয়েকটি লাইন ছিল —
“বন্ধন পীড়ন দুঃখ অসম্মান মাঝে
হেরিয়া তোমার মূর্ত্তি, কর্ণে মোর বাজে
আত্মার বন্ধনহীন আনন্দের গান,
মহাতীর্থ যাত্রীর সঙ্গীত, চিরপ্রাণ
আশার উল্লাস, গম্ভীর নির্ভয় বাণী
উদার মৃত্যুর। ভারতের বীণা-পাণি,
হে কবি, তোমার মুখে রাখি দৃষ্টি তার
তারে তারে দিয়েছেন বিপুল ঝংকার, —
নাহি তাহে দুঃখ তান, নাহি ক্ষুদ্র লাজ,
নাহি দৈন্য, নাহি ত্রাস। তাই শুনি আজ
কোথা হতে ঝঞ্ঝা-সাথে সিন্ধুর গর্জ্জন,
অন্ধবেগে নির্ঝরের উন্মত্ত নর্তন
পাষাণ পিঞ্জর টুটি, — বজ্র গর্জ্জরব
ভেরিমন্দ্রে মেঘপুঞ্জ জাগায় ভৈরব।
এ উদাত্ত সঙ্গীতের তরঙ্গ মাঝার
অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহ নমস্কার।”
রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়-এর লেখা থেকে জানা যায়, সরকারের দৃষ্টিতে কবি একজন ‘দাগী’ ছিলেন। এই প্রসঙ্গে পুলিশ ফাইল থেকে একটি ঘটনা বিবৃত করেছেন পঞ্চানন ঘোষাল, যাতে তিনি লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ ১৯০৩ সালে হঠাৎই শ্রমিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন — রেলওয়ে ওয়ার্কাস ইউনিয়নের সভাপতি হন তিনি। এরপর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে তার সক্রিয় ভুমিকা ব্রিটিশ গভর্ণমেন্টের আদৌ পছন্দ হয় নি। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় থেকে বিশেষত ‘নমস্কার’ কবিতাটি লেখবার পর শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্য আশ্রমও পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ১৯০৬ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথের নাম জোড়াসাঁকো থানার সারভেলান্স রেজিস্টারে নথিভুক্ত হয়। সেই থেকে তার গতিবিধি এবং বাড়িতে উপস্থিতি-অনুপস্থিতির উপর গোপনে নজর রাখা হত। কোনো এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান উর্ধ্বতন কর্মী রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কে একটি হিস্ট্রিশিট তৈরি করেছিলেন যার একাংশে লেখা ছিল, “রবীন্দ্রনাথ একজন জমিদার হওয়া সত্ত্বেও প্রজাদরদী। উপরন্তু উনি ধনী ব্যক্তি হয়েও বোলপুরে একটি ছোট স্কুলে মাষ্টারী করেন। দীর্ঘ শ্মশ্রুমণ্ডিত দীর্ঘকায় অতি গৌরবর্ণ আলখাল্লা পরা এই লোকটিকে হঠাৎ দেখলে যিশুখ্রীষ্ট বলে ভ্রম হয়। ওতে বিভ্রান্ত হয়ে বহু য়ুরোপীয় পণ্ডিতের ওর বাটিতে যাতায়াত। একটি ব্রিটিশ বন্ধু পরিবারে জন্মে ওঁর ব্রিটিশ বিরোধিতা দুঃখজনক।” রবীন্দ্রনাথের গতিবিধির উপর নজর রাখতে ২৭সে জুলাই ১৯০৯ তারিখে কলকাতার স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল এফ. সি ডালি একটি নির্দেশ জারি করেছিলেন। রবি জীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল রথীন্দ্রনাথকে লেখা রাজলক্ষ্মী দেবীর চিঠি উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন, অন্ততঃ দুইবার ব্রিটিশ পুলিশের চর ছদ্মবেশে শান্তিনিকেতনে এসেছিল বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের খোঁজখবর নিতে। পুলিশের সন্দেহভাজন কালীমোহন ঘোষ, নেপালচন্দ্র রায় ও হীরালাল সেনকে বিদ্যালয়ের শিক্ষকপদে নিয়োগ করা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের পছন্দ হয় নি। পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন মিঃ শার্প একটি গোপন সার্কুলারে জানালেন, “It has come to my knowledge that an institution known as the Santiniketan or Brahmacharyasrama at Bolpur in the Birbhum district of Bengal, is a place altogether unsuitable for the education of the sons of Government servants. As I have information that some Government servants in this province have sent their children there, I think it is necessary to ask you to warn any well-disposed Government servant whom you may know or believe to have sons at this institution or to be about to send sons to it, to withdraw them or refrain from sending them as the xase may be ; any connection with this institution in question is likely to prejudice the future of the boys who remains pupils of it after the issue of the present warning.”
৯ই নভেম্বর ১৯১১, রবীন্দ্রনাথ ‘মর্ডান রিভিউ’ ও ‘প্রবাসী’র সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, “আমাদের বিদ্যালয়ের পরেও এতদিন পরে গোপনে রাজদণ্ডপাত হইয়াছে। হঠাৎ পূর্ব্ববঙ্গের রাজকৰ্ম্মচারীদের ছেলেরা বিদ্যালয় হইতে সরিতে আরম্ভ করিতেছে। এমন কি, টেলিগ্রাফযোগে তাহাদিগকে সরানো হইতেছে। আমাদের শান্তিনিকেতন আশ্রমের উদ্দেশ্যের প্রতিই একান্তভাবে লক্ষা রাখিয়া আমি ঘোরতর উত্তেজনার সময়ে ও বিদ্যালয়ে কোনোপ্রকার অশান্তিকর আলোচনা ঘটিতে দিই না। বস্তুত আমি ছাত্রদের মন সেদিক হইতে একেবারে ফিরাইয়া দিয়াছি – সেজন্য আমাকে নিন্দা সহ্য করিতে হইয়াছে। কিন্তু ইহা স্পষ্ট দেখা যাইতেছে ধৰ্ম্মপ্রচার হউক অথবা অন্য যে কোনো হিতকৰ্ম্মই হউক — কোনো কিছু গড়িয়া তুলিতে গেলেই দেশের রাজার নিকট হইতে বাধা পাইতে হইবে। এ সম্বন্ধে মুখামুখি একটা বোঝাপড়ায় নামা যাইবে সে রাস্তাও বন্ধ — মেঘনাদের মত মেঘের মধ্যে অদৃশ্য থাকিয়া যখন রাজশক্তি অস্ত্রপাত করে তখন তাহার জবাব দিবারও যো নাই নিজেকে বাঁচাইবারও পথ বন্ধ।”
পঞ্চানন ঘোষাল আরও জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পরও উর্ধ্বতন কতৃপক্ষের অজ্ঞাতে ওনার উপস্থিতি-অনুপস্থিতির ডাটা লিপিবদ্ধ হত জোড়াসাঁকো থানাতে। “একদিন এক জমাদার গোপন তদনান্তে ইনচার্জ কর্মীকে রিপোর্ট লেখাচ্ছিল — দশ নং দাগী হাজির নেহি। ওই সময় একজন রিটায়ার্ড ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সেখানে ডাইরী লেখাতে উপস্থিত ছিলেন। ওটি উনি শুনে স্যার যদুনাথ সরকারকে জানালে উনি তিনি ওটি প্রবাসীতে প্রকাশ করলে আলোড়ন ওঠে। উর্ধ্বতন কর্মচারীরা তাদের অজ্ঞাতে ঐ প্রাচীন প্রথা থানান্তরে তখনও প্রতিপালিত জেনে অবাক হন ও তাদের নির্দেশে তখুনি তার নাম ওই থানা রেজিস্ট্রারি হতে ‘স্ট্রাক অফ’ করা হয়েছিল।”
তথ্যসূত্র:
১) কংগ্রেস ও বাঙ্গালা, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ
২) পূরবী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৩) পুলিশ কাহিনী প্রথম খণ্ড, পঞ্চানন ঘোষাল
৪) রবিজীবনী ষষ্ঠ খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল
৫) চিঠিপত্র দ্বাদশ খণ্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
মুক্তমত রবীন্দ্রনাথের গতিবিধি ও কার্যকলাপের ওপর পুলিশের নজরদারি সৈয়দ আমিরুজ্জামান