গবেষণা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চায় এশিয়াটিক সোসাইটি
৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৭:১১
দেখতে দেখতে প্রতিষ্ঠার সাতটি দশক পারি দিলো গবেষণা ও বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার অবিস্মরণীয় প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি’। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং কিংবা গবেষণার মান নিয়ে যখন তুমুল সমালোচনা হয়, তখন এশিয়াটিক সোসাইটির মতো প্রতিষ্ঠান মৌলিক গবেষণা আর জ্ঞানচর্চায় সগৌরবে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর ৩ জানুয়ারী সোসাইটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হয়। এদিন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে গবেষক ও বুদ্ধিজীবীদের মিলনমেলা বসে। সোসাইটির তত্ত্বাবধানে সারাবছরই মাসিক লেকচার, বিশেষ লেকচার, সেমিনার ও কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার পিছনে রয়েছে ঘটনাবহুল ইতিহাস। প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ্যা বিশারদ ও কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি স্যার উইলিয়ম জোনস ও তার কতিপয় বন্ধুদের চিন্তার ফসল আজকের এশিয়াটিক সোসাইটি। জোনস ও তার বন্ধুরা মিলে ১৭৮৪ সালের ১৫ জানুয়ারি কলকাতায় ‘দি এশিয়াটিক সোসাইটি’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন। সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিলো এশিয়ার মানুষের জীবন-কর্ম এবং প্রকৃতি বিষয়ে গবেষণায় আত্মনিয়োগে গবেষকদের উৎসাহিত করা।
দেশ বিভাগের পর কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির আদলে ঢাকায় একটি গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান তৈরির প্রয়াস নেয়া হয়। এখানে এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার পিছনের প্রধান কারিগর ছিলেন ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটর ড. আহমদ হাসান দানী (১৯২০-২০০৯ খ্রি.)। এসময় বেশ কিছু খ্যাতিমান পণ্ডিতবর্গের সহায়তা তিনি পেয়েছিলেন যাদের অধিকাংশই ছিলেন ড. আহমদ হাসান দানীর সহকর্মী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পরবর্তীতে ড. দানী ১৯৫২ সালের ৩ জানুয়ারী ‘পাকিস্তান এশিয়াটিক সোসাইটি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সক্ষম হন। তবে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পরের বছর প্রতিষ্ঠানটির নাম বদলে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি’। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি মূলত জোনস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পূর্বোক্ত সংস্থাটির আদলে গঠিত একটি সংগঠন। প্রথম দিকে ঢাকা জাদুঘর থেকে এশিয়াটিক সোসাইটির কার্যক্রম পরিচালিত হতো। পরবর্তীতে ১৯৮০ সাল থেকে বর্তমান ঠিকানা থেকে সোসাইটির কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি। সোসাইটি পরিচালিত হয় একটি কাউন্সিলের মাধ্যমে। উক্ত কাউন্সিলের ১৭ জন সোসাইটির সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন এবং দুই জন ফেলো কাউন্সিল কর্তৃক মনোনীত হন। অর্থাৎ মোট ১৯ সদস্যবিশিষ্ট কাউন্সিলের মাধ্যমে এশিয়াটিক সোসাইটি পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি বহুমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির মূল কাজের অন্যতম হলো গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করা। এছাড়া প্রতিবছর ৩ জানুয়ারী সোসাইটি দেশি-বিদেশি খ্যাতনামা গবেষককে “ফাউন্ডেশন ডে বক্তৃতা “দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। সোসাইটি খ্যাতনামা পণ্ডিত ও গবেষকদের তাদের গবেষণাকর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ সম্মানসূচক ফেলো নির্বাচিত করে থাকে। এ পর্যন্ত মোট ৪৬ জন দেশি-বিদেশি পণ্ডিত সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন। তাছাড়া বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সোসাইটি কর্তৃক সম্মানসূচক সদস্যপদ (Honourary Membership) পেয়ে থাকেন। গবেষকদের জন্য সোসাইটির গ্রন্থাগার একবারেই উন্মুক্ত। এছাড়া তাদের প্রয়োজনে আবাসনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগারে ২৩ হাজারের মতো গ্রন্থ, জার্নাল, পাণ্ডুলিপি এবং অন্যান্য গবেষণা সামগ্রী রয়েছে। দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের জন্য এটি শিক্ষাবিদ এবং গবেষকদের জন্য আগ্রহের একটি জায়গা। গ্রন্থাগারটি স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির সাথে একটি ‘জার্নাল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম’ চালু করেছে।
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির একটি প্রকাশনা বিভাগ রয়েছে। সোসাইটি গবেষকদের তাদের গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করতে উৎসাহ দিয়ে থাকে। এযাবৎকালে সোসাইটি বহু সমৃদ্ধ গ্রন্থ প্রকাশ করে পাঠক ও গবেষকদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে সর্ববৃহৎ কাজের ফসল গুলো হচ্ছে জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া (১৪ খণ্ড), বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা (১২ খণ্ড), বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ (২৮ খণ্ড), Celebration of 400 years of Capital Dhaka: 1608-2008 (18 vols.), বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ (১০ খণ্ড) । উল্লেখ করা প্রয়োজন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে সোসাইটি প্রকাশ করেছে Bangladesh: 50 Years of Transformation Since Liberation নামক একটি সংকলন গ্রন্থ। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির ৩টি ষাণ্মাসিক গবেষণা জার্নাল আছে। এগুলো হচ্ছে The Journal of the Asiatic Society of Bangladesh (Humanities.), Journal of the Asiatic Society of Bangladesh (Sciences) এবং বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি পত্রিকা। এছাড়া সোসাইটি একটি ত্রৈমাসিক নিউজলেটার প্রকাশ করে থাকে। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির চলমান কার্যক্রম সম্পর্কে সদস্যদের অবহিত করাই ত্রৈমাসিক নিউজলেটার বের করার মূল উদ্দেশ্য। বলে রাখা ভালো সোসাইটি থেকে প্রকাশিত গ্রন্থাদি এর সদস্যবৃন্দ অর্ধেক মূল্যে সংগ্রহ করতে পারেন।
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ১৯৮৪ সাল থেকে তার এনডোমেন্ট প্রোগ্রাম শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় অনেক মহতী ব্যক্তিবর্গ এই প্রোগ্রামকে সাফল্যমন্ডিত করতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। গবেষণাকে এগিয়ে নিতে তারা সোসাইটিতে অনেক ট্রাস্ট ফান্ড প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে সোসাইটিতে ৪৬টি ট্রাস্ট ফান্ড গড়ে উঠেছে। ট্রাস্ট ফান্ডগুলোর আহ্বায়ক সোসাইটির সম্পাদক। এই ট্রাস্টফান্ড গুলোর মাধ্যমে স্মারক বক্তৃতার আয়োজন, গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা, গবেষণা মঞ্জুরি এবং গবেষণায় অসামান্য অবদানের জন্য গবেষকদের সম্মাননা পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয়।
সোসাইটির বিশেষ আকর্ষণ হেরিটেজ মিউজিয়াম জাদুঘর। ঢাকার নায়েব-নাজিমদের স্মৃতিবিজড়িত নিমতলী প্রাসাদের প্রবেশদ্বারকে সংরক্ষণ করে তাতে জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে। উল্লেখ রাখা আবশ্যক যে মূল প্রাসাদ ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমান জাদুঘরে ১৭০০ থেকে ১৯০০ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কালের ইতিহাস ও ঐতিহ্য স্থান পেয়েছে। সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য জাদুঘরটি প্রতি বৃহস্পতি ও শুক্রবার খোলা রাখা হয়। হেরিটেজ মিউজিয়ামের নিজস্ব একটি ওয়েবসাইট আছে। এই ওয়েবসাইট ব্যবহার করে বিশ্বের যে কোনো স্থান থেকে মিউজিয়াম ভিজিট করার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর জন্য সোসাইটির ৩৫০০ বর্গফুট আয়তনের একটি স্থায়ী আর্ট গ্যালারি তৈরি করেছে। এই আর্ট গ্যালারির কাজ হচ্ছে দেশি-বিদেশি শিল্পীদের শিল্পকর্ম সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শন করা।
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ৩ জানুয়ারীতে ৭২তম বর্ষে পা রাখছে। শুভদিনে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা,শুভানুধ্যায়ী এবং সকল সদস্যদের জানাই আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। এশিয়াটিক সোসাইটির মতো প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত। ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ২০৪১ সালকে সামনে রেখে সরকার কর্তৃক গৃহীত নতুন চ্যালেঞ্জ এখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের। স্মার্ট বাংলাদেশ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য বাংলাদেশকে প্রস্তুত করছে। আমি বিশ্বাস করি,এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রস্তুুতের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাবে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।
লেখক: সম্পাদক, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ও উপ-উপাচার্য, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
গবেষণা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চায় এশিয়াটিক সোসাইটি ড. মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির মুক্তমত