ইশতেহারের স্মার্ট বাংলাদেশ ও স্মার্ট ট্যুরিজম
৬ জানুয়ারি ২০২৪ ১৫:৪২
২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সরকার। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য চারটি ভিত্তিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে-স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার, ও স্মার্ট সমাজ।
স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের জন্য এই চারটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রকে প্রাধান্য দিয়ে অগ্রসর হলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সহজতর হবে। সেইসাথে ডিজিটাল বাংলাদেশ পথযাত্রা অতিক্রম করে স্মার্ট বাংলাদেশ রূপান্তরের পথযাত্রা অগ্রসর হবে। স্মার্ট নাগরিক ও স্মার্ট সরকার এর মাধ্যমে সকল সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হলে দেশের মানুষ প্রত্যাশিত ডিজিটাল সেবা পাবে এবং তাদের সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে; স্মার্ট সমাজ ও স্মার্ট অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণ এবং টেকসই ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা প্রয়োজন যা উন্নত বাংলাদেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের যাত্রাপথ আরও ত্বরান্বিত হবে।
মূলত স্মার্ট বাংলাদেশ এর মূল লক্ষ হলো সাশ্রয়ী, টেকসই, জ্ঞানভিত্তিক, সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী ও প্রযুক্তি নির্ভর সেবা প্রাধান্য দেওয়া এককথায় দেশের সকল কাজই হবে স্মার্ট। যেমন স্মার্ট শহর ও স্মার্ট গ্রাম বাস্তবায়নের জন্য স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট পরিবহন, স্মার্ট ইউটিলিটিজ, স্মার্ট নগর প্রশাসন, প্রযুক্তি সুবিধা সম্পূর্ণ জননিরাপত্তা, স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থাপনা, সুলভ মূল্যে ইন্টারনেট সেবা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, ও স্মার্ট পর্যটন এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও প্রমুখ।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে পরিবেশবান্ধব পর্যটন বাস্তবায়নে পেপারলেস সোসাইটি বিনির্মাণে অন্যতম অনুষঙ্গ স্মার্ট ট্যুরিজম। স্মার্ট ট্যুরিজম ও স্মার্ট সিটি উন্নয়নে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা অনেক বেশি মনোযোগী। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে ট্যুরিজম ব্যবসায় ও প্রতিষ্ঠানে অটোমেশন, যন্ত্রনির্ভরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইন্টারনেট অব থিংস, ক্লাউড কম্পিউটিং, বিগ ডাটা, রোবটিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ও ওয়্যারলেস টেকনোলজি ব্যবহার বৃদ্ধির প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করা দরকার। সেই সাথে পর্যটনের নতুন ধারণা পিপিসিপির (পাবলিক-প্রাইভেট কমিউনিটি পার্টনারশিপ) ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
স্মার্ট ট্যুরিজম মূলত প্রযুক্তি নির্ভর পর্যটন সেবা নিশ্চিতকরণ তন্মধ্য; পর্যটন খাত, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, মোবাইল কমিউনিকেশন, ক্লাউড কম্পিউটিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স সার্ভিসেস, এবং ভার্চুয়াল বাস্তবতার উপর অধিক নির্ভরশীল। এটি ভৌত অবকাঠামোগত, সামাজিক সংযোগ, ব্যবহারকারীদের দক্ষতা, স্থায়িত্ব, অভিজ্ঞতা বাড়ানোর জন্য উন্নত প্রযুক্তির সংমিশ্রণ থেকে প্রাপ্ত ডেটা সংগ্রহ এবং ব্যবহার করার উদ্ভাবনী উপায় খুঁজে বের করার জন্য একটি পর্যটন গন্তব্যে সমন্বিত প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে ৷
স্মার্ট ট্যুরিজমের জন্য ব্যবহৃত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সরঞ্জামগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য: থিংস অফ ইন্টারনেট, মোবাইল যোগাযোগ, ক্লাউড কম্পিউটিং, বিগ ডেটা, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, অ্যাগমেন্টেড রিয়েলিটি ও কিউআর কোড।
এটি পর্যটনের ভৌত, তথ্যগত, সামাজিক এবং বাণিজ্যিক অবকাঠামোকে এই ধরনের সরঞ্জামগুলির সাথে একত্রিত করে স্মার্ট পর্যটনের সুযোগ সমৃদ্ধ করে। স্মার্ট ট্যুরিজমের নীতিগুলি মূলত পর্যটন অভিজ্ঞতা বাড়ানো, দক্ষ সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং টেকসই পর্যটন উন্নয়ন দিকগুলির উপর জোর দিয়ে পর্যটন গন্তব্যের প্রতিযোগিতা সর্বাধিক করা। পর্যটন সম্পদের সুষম বণ্টনের সুবিধার্থে তথ্য সংগ্রহ ও বিতরণ করা এবং মাইক্রো এবং ম্যাক্রো স্তরে পর্যটন সেবা সরবরাহগুলোকে একীভূত করার মধ্যে দিয়ে স্মার্ট ট্যুরিজম অগ্রসর হবে।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, মহামারীর আগে ভ্রমণ ও পর্যটন শিল্পের প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ এবং প্ররোচিত প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য।
কোভিড মহামারি সংকট কাটিয়ে পর্যটন শিল্প আবার পূর্বের অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে এই ক্রমাগত উন্নয়ন ধারা ধরে রাখার জন্য উন্নত বিশ্বে এখন পরিকল্পনা অনুযায়ী টেকসই পর্যটন উন্নয়ন ও সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে স্মার্ট ট্যুরিজমকে অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। ডব্লিউটিটিসি (ডঞঞঈ) এর সূত্রমতে আগামী ১০ বছরের পর্যটন পরিস্থিতির পূর্বাভাস দিয়েছে।
সেখানে উঠে এসেছে বিশ্বের প্রধান পর্যটন বাজার ও অর্থনীতি নিয়ে। জিডিপিতে অবদানের ভিত্তিতে মহামারীর পূর্বে বিশ্বের প্রধান পাঁচ পর্যটন অর্থনীতি দেশ ছিল যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও জাপান। ইতোমধ্যে জাপান টপকে গেছে যুক্তরাজ্যকে। বর্তমানে সেরা দশের তালিকায় রয়েছে ফ্রান্স, মেক্সিকো, ইতালি, ভারত ও স্পেনের নামও।
২০৩৩ সালের মধ্যে পর্যটন বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ১৫ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে খাতটির হিস্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ।
করোনা-পরবর্তী অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য অন্যতম মজবুত অর্থনীতির দেশ অস্ট্রেলিয়া ডিজিটাল পর্যটন প্রসারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। সেই সঙ্গে উক্তদেশে বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধিকল্পে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের অন্যতম মাধ্যম ইনস্টাগ্রামে ‘আই লাভ অস্ট্রেলিয়া’ পেজের স্পন্সরের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণ এবং ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্টে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে।
পৃথিবীর অন্যতম স্মার্ট পর্যটন নগরী হেলসিংকি (ফিনল্যান্ড) ইউরোপিয়ান পর্যটকদের পাশাপাশি নর্থ আমেরিকান পর্যটকদের আকর্ষণে স্মার্ট ট্যুরিজমের অন্যতম উপাদান ইন্টারনেট অব থিঙ্কস; আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-নির্ভর রোবট সার্ভিস চালু করেছে। সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্ট আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বেজড রোবট দিয়ে এয়ারপোর্ট ক্লিনিং ও এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি সিস্টেম উন্নয়ন এবং স্মার্ট সেবা প্রদান করছে, যা টেকসই পর্যটন উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
জাপানে হেন-না হোটেল অতিথিদের জন্য খোলা নতুন হোটেল, যেখানে রোবট আপনাকে চেক ইন করবে, আপনার ব্যাগ নেবে এবং আপনাকে আপনার রুমে নিয়ে যাবে। রোবট এবং স্বয়ংক্রিয় পরিষেবাগুলি শক্তি সাশ্রয় করবে, শ্রম খরচ কমিয়ে দেবে, বর্জ্য হ্রাস করবে এবং একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, সৌর-চালিত হোটেলের দিকে নিয়ে যাবে।
বর্তমানে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের উপাদানগুলোর মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, ওয়েবসাইট, বিগ ডেটা ও কনটেন্ট মার্কেটিংয়ের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে বিধায় পর্যটন ব্র্যান্ডিং ও প্রমোশনের ক্ষেত্রে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নর্থ আমেরিকা ও এশিয়া মহাদেশের দেশগুলো সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের (ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব) ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করছে, অতএব উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশে পর্যটন প্রমোশনে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিংয়ের ওপর দেশে গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য পর্যটন শিক্ষা ও দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা উন্নয়নে বিনিয়োগ ও টেকসই অবকাঠামো এবং সবুজ রূপান্তর কার্যক্রম অনস্বীকার্য। এই কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে পর্যটন শিল্পে সত্যিকারের সমৃদ্ধি আসবে।
টেকসই পর্যটন উন্নয়ন অব্যাহত রাখার জন্য জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক পরিবেশ, স্থানীয় ঐতিহ্য ও কৃষ্টির সংরক্ষণ এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে টেকসই পর্যটন বিকাশ প্রয়োজন। স্মার্ট ট্যুরিজম এর মাধ্যমে তৈরি হবে স্কিল বেসড জব, বাড়বে বিদেশি পর্যটক, অর্জিত হবে বৈদেশিক মুদ্রা, পর্যটন খাতে বাড়বে ফ্রিল্যান্সার এবং তৈরি হবে স্মার্ট ইকোনমি যা অবদান রাখবে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে।
বাংলাদেশে প্রায় ১৪০০ পর্যটন গন্তব্য ও দর্শনীয় স্থানকে বিশ্বব্যাপী প্রচার ও প্রসার এর মাধ্যমে বিদেশী পর্যটক আকর্ষণ করা সম্ভব। ৩৬০ প্রমো তৈরির মধ্যে দিয়ে দেশের প্রায় ৩ কোটি পর্যটক দেশের নতুন নতুন পর্যটন ডেস্টিনেশন সম্পর্কে জানতে পারবে এবং পর্যটন আকর্ষণগুলোতে পর্যটকের সংখ্যা আরও বাড়বে।
স্মার্ট পর্যটন প্রচার ও প্রসারের জন্য সারা দেশের আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্যগুলোর ডিজিটাল ডিরেক্টরি তৈরি এবং প্রতিটি পর্যটন কেন্দ্রের এক্সক্লুসিভ ডকুমেন্টারি, ৩৬০ ডিগ্রি ভিজ্যুয়াল গাইডেন্স, ৩৬০ ডিগ্রি ভিআর ট্যুর (ভার্রচ্যুয়াল রিয়েলিটি) এবং পর্যটকের প্রয়োজনীয় সকল তথ্য ও সেবা ব্যবস্থা থাকা দরকার।
পর্যটন আকর্ষণগুলোর ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং এর জন্য ডিজিটাল মার্কেটিং এর উপর গুরুত্ব দেওয়া খুবই প্রয়োজন। ডিজিটাল মার্কেটিং এর টুলসগুলোর মধ্যে ইমেইল মার্কেটিং, তথ্য সম্বলিত নান্দনিক ওয়েবসাইট, সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং, সার্চ ইঞ্জিন মার্কেটিং, এবং কনটেন্ট মার্কেটিং অন্যতম। বিভিন্ন ক্যাটাগরির হোটেলগুলো তাদের হোটেলের দেয়ালে আগমেন্টেড রিয়েলিটি ব্যবহারের মাধ্যমে অতিথিদের সন্তুষ্টির পরিমাণ আরও বাড়তে সক্ষম হবে।
সর্বোপরি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রযুক্তি নির্ভর সেবা প্রদানের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা দরকার। স্মার্ট সেবা প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। অধিক গতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সেবা আরও সুলভ মূল্যে প্রদানের মধ্যে দিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাবে দেশ।
লেখক: চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
অধ্যাপক ড. সন্তোষ কুমার দেব ইশতেহারের স্মার্ট বাংলাদেশ ও স্মার্ট ট্যুরিজম মুক্তমত