১০ জানুয়ারি: এক ঐতিহাসিক ক্ষণ
১০ জানুয়ারি ২০২৪ ১৪:২১
১০ জানুয়ারী বাংলাদেশের জন্য এক অতি আনন্দময় ক্ষণ। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা পাকিস্তানের কারাগারে ২৯০ দিন বন্দি থাকার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কাল রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে পরদিন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যায়। তার দেখানো স্বপ্নে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ওদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে অমানবিক নিপীড়নের শিকার হন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বহু ঘটনাক্রম পার দিয়ে, বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আজ বাংলাদেশ বিশ্বের উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। এদেশের জন্ম, জন্ম পূর্ববতী ইতিহাস এবং সেই ইতিহাসের সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে মিশে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। যে মানুষটি না থাকলে এদেশ পাকিস্থান বাহিনীর সাথে মোকাবেলা করার মত সাহস পেত না, স্বপ্ন দেখতো না একটি নতুন পতাকার। এদেশের মুক্তিকামী মানুষকে তিনি দেখিয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্ন। বিশ্বের বড় বড় নেতারা বঙ্গবন্ধুর সাহসিকতা, দৃঢ় নেতৃত্ব এবং দেশপ্রেমের প্রশংসা করেছেন। একটি নতুন পতাকা আর সার্ভভৌমত্বের স্বপ্ন। মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন পাকিস্থানীদের নির্মম অত্যাচার আর শোষণের হাত থেকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জন্য এদেশের মানুষের জন্য পাকিস্থানের কারাগারে নির্মম নির্যাতন সহ্য করেছেন। পাকিস্থানের কারাগারে প্রতিটি মুহূর্তে তাকে মৃত্যুর প্রহর গুণতে হয়েছে। তার আহবানে সাড়া দিয়ে যখন লাখ লাখ বাঙালি রণাঙ্গণে যুদ্ধরত, ঘর ছেড়ে দামাল ছেলের দল যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুর মুখোমুখি দাড়িয়ে তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্থানের কারাগারের অন্ধকারে বন্দী হয়ে নির্যাতন সহ্য করছেন। তার চোখে তখন স্বাধীন বাংলাদশের স্বপ্ন। তার বুকে তখন এদেশের মানুষরে প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও বিশ্বাস। তিনি বিশ্বাস করতেন এদেশ স্বাধীন হবেই।
১০ জানুয়ারী ১৯৭২ বাংলার মানুষের স্বাধীনতার উদযাপনের পরিপূর্ণ একটি দিন। এদিন বেলা ১ টা ৪১ মিনিটে সদ্য স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তান আন্তর্জাতিক এয়ার লাইন্সের একটি বিশেষ জেট বিমানে ৬টা ৩৬ মিনিটে হিথরো বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধু এসে পৌঁছেছেন। এর তিন ঘণ্টা পরে বঙ্গবন্ধু সেন্ট্রাল লন্ডনের উদ্দেশ্যে বিমানবন্দর ত্যাগ করলেন। হিথরো বিমান বন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের বললেন, ‘আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে, আমি বেঁচে আছি, আমি সুস্থ রয়েছি।’ লন্ডন বিমান বন্দরে এসে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বললেন- ‘স্বাধীনতার লক্ষে পৌঁছতে বাংলাদেশের জনগণের মতো এত উচ্চমূল্য, এত বেশি প্রাণদান আর ভয়াবহ দুর্ভোগ আর কোনো দেশের মানুষকে পোহাতে হয়নি। …এই মুহূর্তে আমি আমার দেশবাসীর কাছে ফিরে যেতে চাই। আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে পারছি না। …আমার দেশবাসী আমাকে প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা করেছেন। অথচ আমাকে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ একটি নির্জন পরিত্যক্ত সেলে আটকে রেখেছিল তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দিয়ে। ফলে আমাকে সর্বদা ফাঁসির কাষ্ঠের জন্য প্রহর গুনতে হয়েছিল।…প্রেসিডেন্ট ভুট্টো আমাকে পাকিস্তানের সঙ্গে যে কোনো একটি সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারটা বিবেচনা করতে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু আমি তাকে বলেছি আমার দেশবাসীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে আমি কোনো কিছু বলতে পারব না।’…
পাকিস্থানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্ত স্বদেশ ভূমিতে ফিরে আসার ঘটনা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের আরেক আশির্বাদ এবং বিজয়ের পূর্ণতা। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ অনুপস্থিত থাকায় সে বিজয় অসম্পূর্ণই বলা যায়।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী তিনি তার সেই মুক্ত দেশকে গড়ে তোলার দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। সেই ভাষণের একটি অংশে তিনি বলেন, ’ আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই, এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়। এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না যদি আমার বাংলার মা বোনেরা কাপড় না পায়, এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের মা-বোনেরা ইজ্জত ও কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণতা হবে না যদি এ দেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণী আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।’
লেখক: কলামিষ্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই