Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: বাঙালির জন্য আশীর্বাদতুল্য ঘটনা

ইমরান ইমন
১০ জানুয়ারি ২০২৪ ১৫:০৩

আজ ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ২৪ দিন পর পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেছিলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানের কারাগারে দীর্ঘ ২৯০ দিন বন্দি থাকার পর ১৯৭২ সালের এই দিনে লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন বঙ্গবন্ধু। মহানায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাঙালির কাছে ছিল আশীর্বাদতুল্য। অন্ধকার থেকে নতুন আলোয় যাত্রার স্বপ্ন।

বিজ্ঞাপন

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে পাকিস্তানি হানাদাররা আটক করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। ওই রাতেই বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর শুরু হয় বর্বর হত্যাযজ্ঞ ও অমানবিক নির্যাতন। পাকহানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সেই ঘোষণা ছড়িয়ে দেওয়া হয় দেশব্যাপী। দেশের আপামর জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিসংগ্রামে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। যুদ্ধে বিজয় অর্জন করলেও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় মানুষ উদ্বেগাকুলচিত্তে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির প্রতীক্ষায় থাকে। সমগ্র বাঙালি জাতির প্রশ্ন ছিল বঙ্গবন্ধু কেমন আছেন, কবে মুক্তি পাবেন, কবে দেশে ফিরবেন বা আদৌও ফিরবেন কিনা। সাধারণ মানুষ নয় মাসব্যাপী যুদ্ধের ভয়াবহতা, হত্যাযজ্ঞ ও বিভীষিকার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকেই মনে করেছে শক্তি ও প্রেরণার উৎস হিসেবে, মুক্তি আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে।

বিজ্ঞাপন

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের পর থেকে কীভাবে কাটে বঙ্গবন্ধুর দিন, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং ইতিহাসবিদদের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানকে বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে। তারপর তাকে সরিয়ে আনা হয় মিয়ানওয়ালির কারাগারে। থাকতে দেওয়া হয় ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্ধারিত সেলে। মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে সেখানে ও পাঞ্জাবের উত্তরে লায়ালপুর ও শাহিওয়ালের দুটি কারাগারে কাটাতে হয়। এ সময় পাকিস্তান সামরিক সরকার তার বিরুদ্ধে ১২টি অভিযোগ এনে ‘বিচার’ শুরু করে। ১২টি অভিযোগের ছয়টির রায় ছিল মৃত্যুদণ্ড।

অভিযোগগুলোর অন্যতম একটি ছিল ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা’। টাইমসে লেখা হয়, এই বিচার শেষ হয় চার ডিসেম্বর। ‘ইয়াহিয়া তার সেনা কর্তাদের রাওয়ালপিন্ডি ডেকে পাঠিয়ে গুলি করে দ্রুত শেখ মুজিবকে হত্যার প্রস্তুতির নির্দেশ দিলেন। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় তাকে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হলো।’ ৭ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুকে মিয়ানওয়ালিতে ফিরিয়ে আনা হয়। ১৫ ডিসেম্বর, ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের এক দিন আগে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ইয়াহিয়ার যে পরিকল্পনা ছিল তা বাস্তবায়নের চূড়ান্ত উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৫ ডিসেম্বর জেলখানার দায়িত্বরতদের জানানো হয়, নিয়াজিকে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিরা হত্যা করেছে, তার প্রতিশোধ হিসেবে পরদিন সকালেই মুজিবকে হত্যা করা হবে। সে প্রস্তাবে সবাই এক কথায় রাজি হয়। পরদিন ভোররাত চারটায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা আগে জেল সুপার বঙ্গবন্ধুর সেলের দরজা খুলে ঢোকেন। বঙ্গবন্ধু জানতে চান, ‘আমাকে কি ফাঁসির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?’ তিনি আগেই দেখেছিলেন তার সেলের বাইরে কবর খোঁড়া হয়েছে। তাকে বলা হয়েছিল, তার নিরাপত্তার জন্য পরিখা খনন করা হয়েছে। জেল সুপার জানালেন, তাকে ফাঁসির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। তবু সন্দেহ যায় না বঙ্গবন্ধুর। তার ভাষ্যে, ‘আমি তাকে বললাম, যদি ফাঁসিই দেওয়া হয়, তাহলে আমাকে প্রার্থনার জন্য কয়েক মিনিট সময় দিন।’ সুপার বললেন, ‘না না, একদম সময় নেই। আপনাকে এখনই আমার সঙ্গে আসতে হবে, জলদি।’ বঙ্গবন্ধুকে কয়েক মাইল দূরে এক অজ্ঞাত স্থানে কয়েক দিনের জন্য সরিয়ে নেন জেল সুপার। সেখানে ৯ দিনের মতো কাটান তিনি। জেলের কর্মকর্তারা জেল সুপারকে বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান। এরপর এক পুলিশ অফিসার সেই সুপারকে জানান, বঙ্গবন্ধুকে লুকিয়ে রাখার আর প্রয়োজন নেই, জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯ ডিসেম্বর পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করেছেন, তিনি মুজিবের সঙ্গে কথা বলতে চান। এরপর রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে। সেখানে রাষ্ট্রপতি ভবনে তাকে গৃহবন্দি করা হয়। ২৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন ভুট্টো।

বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকারী নিউইয়র্ক টাইমসের তৎকালীন প্রতিনিধি সিডনি শ্যানবার্গ বলেন, ভুট্টোর মনে হয়েছিল, মুজিবকে হত্যা করা হলে বাংলাদেশে আটকে পড়া প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করা হতে পারে। এ কাজের জন্য সবাই তাকে অর্থাৎ, ভুট্টোকেই দায়ী করবে। তাই তাকে হত্যা করা হয়নি। মুজিব জানালেন, ভুট্টো তাকে পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মধ্যে কোনো রকম একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য জোরাজুরি করেন। মুজিব বলেন, ‘আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি মুক্ত না এখনো বন্দি? আমি যদি মুক্ত হই তাহলে আমাকে যেতে দিন। আর যদি বন্দি হই তাহলে কোনো কথা বলতে প্রস্তুত নই।’ ভুট্টো তাকে জানালেন, তিনি মুক্ত, তবে ফেরত পাঠাতে আরো দিন-কয়েক লাগবে। একপর্যায়ে ভুট্টো দাবি করেন, পাকিস্তানের দুই অংশ তখন পর্যন্ত আইনের চোখে একই রাষ্ট্রের অন্তর্গত। জবাবে বঙ্গবন্ধু তাকে মনে করিয়ে দেন, বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছিল, কিন্তু সে ফলাফল মানা হয়নি। ‘পাকিস্তান যদি এখনো অবিভক্ত দেশ হয় তাহলে আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক শাসক নন, আমি।’ ৭ জানুয়ারি তৃতীয় ও শেষবারের মতো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন ভুট্টো। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেন, ‘আজ রাতেই আমাকে মুক্তি দিতে হবে, এ নিয়ে অযথা বিলম্বের সময় নেই। হয় আমাকে মুক্তি দিন অথবা মেরে ফেলুন।’ ভুট্টো তাকে বলেন, এত দ্রুত সব আয়োজন করা কঠিন। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে পাঠাতে সম্মত হন ভুট্টো।

বাংলাদেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে চাপ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ৬৭ দেশের সরকারপ্রধানকে চিঠি দেন। ৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বিবিসি ওয়ার্ল্ডে প্রচারিত খবরে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই উড়োজাহাজটি লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে।’ বিমান অবতরণের পরপরই ব্রিটিশ বৈদেশিক দপ্তরের কর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। ব্রিটিশ সরকারের সম্মানিত অতিথি হিসেবে লন্ডনের ক্ল্যারিজেস হোটেলে নিয়ে আসা হয় তাকে। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির কথা জেনে হাজার হাজার বাঙালি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে লন্ডনের আকাশ-বাতাস মুখর করে তোলে।

দুপুরের দিকে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এক মুহূর্তের জন্য আমি বাংলাদেশের কথা ভুলিনি। আমি ধরে নিয়েছিলাম ওরা আমাকে হত্যা করবে। আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাব না। কিন্তু আমার জনগণ মুক্তি অর্জন করবে।’ বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছান, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ তখন ছিলেন লন্ডনের বাইরে। বঙ্গবন্ধুর পৌঁছানোর কথা শুনে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী হিথ ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন এবং বঙ্গবন্ধুকে নজিরবিহীন সম্মান দেখান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তার কার্যালয়ের বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ না বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। ৮ জানুয়ারি রাতে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বিষয়টি উত্থাপন করেন।

৯ জানুয়ারি সকালে লন্ডনে বসেই টেলিফোনে ইন্দিরা গান্ধী-বঙ্গবন্ধুর মধ্যে আধা ঘণ্টা আলোচনা হয়। বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানান ইন্দিরা গান্ধী এবং অনুরোধ করেন ঢাকার পথে যেন তিনি দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করেন। বঙ্গবন্ধু আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন এবং দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হন। দিল্লির ‘এক্সপ্রেস’ পত্রিকার বিবরণ অনুযায়ী, ‘কালো-ধূসর ওভারকোট পরে বঙ্গবন্ধু উড়োজাহাজের সিঁড়ি বেয়ে নামলেন। প্রেসিডেন্ট ভি. ভি. গিরি বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করলেন। পাশে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বাগত জানাচ্ছিলেন। তখন ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানানো হয়। শুভেচ্ছাপর্ব শেষে বঙ্গবন্ধু তিন বাহিনীর ১৫০ সদস্যের গার্ড অব অনার পরিদর্শন করেন এবং পরে ভিআইপি প্যান্ডেলে যান। সেখানে তাকে ফুল ছিটিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। দিল্লিতে স্বল্পকালীন বিরতির সময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনার জন্য দীর্ঘ সময় ছিল না। কিন্তু এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধু জানিয়ে দিলেন, তিনি আশা করছেন অদূর ভবিষ্যতেই ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করবে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার সম্মতি জানিয়ে বললেন, ‘যখনই বলা হবে, ভারতীয় বাহিনী তখনই ফেরত যাবে।’ তা ঘটেও ছিল ইন্দিরা গান্ধীর ১৭ মার্চ ঢাকা সফরের আগেই।

১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঢাকা ফিরে আসেন বেলা ১টা ৪১ মিনিটে। বিমানবন্দর ও রাস্তার দুপাশে তখন অপেক্ষমান লাখো জনতা। সবার কণ্ঠে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’ যে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজি রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সেই মাটিতে পা দিয়েই আবেগে কেঁদে ফেলেন। বিমানবন্দরে অস্থায়ী সরকারের সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা সবাই অশ্রুসজল নয়নে বরণ করেন ইতিহাসের মহানায়ককে। তেজগাঁও বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি অবতরণ করার পর খোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে জনসমুদ্রের ভেতর দিয়ে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এসে পৌঁছাতে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে নিজের পরিবারের কাছে না গিয়ে সরাসরি জনগণের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। লাখো মানুষের সামনে তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আমার জীবনের স্বাদ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে।’ আবেগঘন ভাষায় বললেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ বক্তৃতায় তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বললেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে- গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।’

ত্রিশ লক্ষ মানুষের আত্মদান স্মরণ করে বেদনা-ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার বাংলায় আজ বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে।’ পরিশেষে তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধজননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ কবিগুরুর কথা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ সেদিনকার রেসকোর্স ময়দান ছিল লোকে লোকারণ্য। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ২০ মিনিট বক্তব্য দেন, যা ছিল জাতির জন্য দিকনির্দেশনা। বাংলাদেশের আদর্শগত ভিত্তি কী হবে, রাষ্ট্রকাঠামো কী ধরনের হবে, পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যারা দালালি ও সহযোগিতা করেছে তাদের কী হবে, বাংলাদেশকে বহির্বিশ্ব স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য অনুরোধ, মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ, কৃষক, শ্রমিকদের কাজ কী হবে, এসব বিষয়সহ বিভিন্ন দিক নিয়ে নির্দেশনা দিলেন। ডাক দিলেন দেশ গড়ার সংগ্রামে।

১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত ও সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণ করে উন্নয়নের বীজ বপন করেন। তার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ তার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’, একটি সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল দেশ অর্জনের পথ হিসেবে একটি স্বনির্ভর অর্থনীতির লক্ষ্য অর্জন করতে শুরু করে। একটি স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ দেশের সূচনা ঘটে তখন। বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছরে পুনর্বাসন ও জাতি পুনর্গঠনের কঠিন কাজ সম্পন্ন করেন। এতো অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অনেক দেশের স্বীকৃতি, বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘসহ বিশ্বের সব বড় আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ লাভ করতে সক্ষম হয়। তিনি অতি অল্প সময়ের মাঝে একটি শক্তিশালী আধুনিক সংবিধান প্রণয়ন করতে সক্ষম হন। ঐতিহাসিক পানিবণ্টন চুক্তি, ভূমি সীমানা নির্ধারণ এবং ভারতের সঙ্গে শান্তি চুক্তিসহ প্রতিবেশীদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে সক্ষম হন। দেশের স্কুল ও কলেজ পুনঃনির্মাণ করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৪ সালে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৭.৫%-এরও বেশি অর্জনে সফল হয় বঙ্গবন্ধুর সরকার।

বঙ্গবন্ধু “সোনার বাংলা” গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি তার স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকদের নির্মম ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তনয়া বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পিতার স্বপ্ন পূরণে কাজ করে যাচ্ছেন। একসময় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ এখন এশিয়ার ‘উদীয়মান বাঘ’। বাংলাদেশ এখন সম্ভাবনার দেশ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের রোল মডেল এবং নারীর ক্ষমতায়নের দেশ। বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানগুলোর একটি এখন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের তকমা মুছে ফেলে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নাম লিখাতে সক্ষম হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত করে বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলাদেশ’ গড়তে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুকন্যা। উন্নয়নের মডেল বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪৫টি এশিয়া প্যাসিফিক দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে বঙ্গবন্ধুর প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুরর আদর্শ ধারণ হতে পারে আমাদের সব সংকট উত্তরণের পথ।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

ইমরান ইমন বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর