ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ের কিংবদন্তি বিপ্লবী মাষ্টারদা সূর্যসেন
১২ জানুয়ারি ২০২৪ ১৪:০৪
“রেখে যাবার মত একটি জিনিসই আমার আছে, তা হল আমার স্বপ্ন। সারাজীবন প্রচন্ড আবেগ নিয়ে সেই স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করতে জগতের আর সবকিছু ভূলে ক্লান্তিহীন আমি ছুটে চলেছি। জানিনা আরাধ্য কাজ সফল করার পথে কতটা এগিয়ে যেতে পারলাম। জানিনা সেই পথের কোনখানে এসে আমাকে থেমে যেতে বাধ্য করা হল। যদি লক্ষ্যে পৌঁছবার আগে মৃত্যুর শীতল হাত তোমাকেও স্পর্শ করে তবে আরাধ্য কাজের দায়িত্ব তোমার উত্তরসূরিদের হাতে অর্পণ করো। যেমন আমি এগিয়ে গেলাম, এগিয়ে চলো। সামনে এগিয়ে চলো, পিছিয়ে পড়োনা, মুহূর্তের জন্যেও না।”
– মাস্টারদা সূর্যসেন
সমগ্র ভারতবর্ষের মহান স্বাধীনতা ও জনগণের সামগ্রিক মুক্তির জন্য উৎসর্গীকৃত ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ে ভারতের কিংবদন্তি সশস্ত্র বিপ্লবী মাষ্টার দা সূর্যসেনের ৯০তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। মহান এই নেতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা!
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও লুণ্ঠন বিরোধী স্বাধীনতার লড়াইয়ের অংশ হিসেবে ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন-সহ বহুবিধ বিপ্লবের অধিনায়ক তিনি। তাঁর পুরো নাম সূর্যকুমার সেন। সংক্ষেপে সূর্যসেন নামে অধিক পরিচিত। তবে মাষ্টারদা নামে সহযোদ্ধাদের কাছে পরিচিত ছিলেন।
১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে মার্চে, চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার নোওয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাজমণি সেন, মায়ের নাম শশীবালা সেন। তিনি ছিলেন পিতা-মাতার চতুর্থ সন্তান। পাঁচ বছর বয়সে পিতার মৃত্যুর পর, তাঁর বড় কাকা গৌরমণি সেনের কাছে প্রতিপালিত হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে জ্যাঠাতুতো দাদা চন্দ্রনাথ সেন তাঁর অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি প্রথমে চট্টগ্রাম কলেজে ও পরে পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে ভর্তি হন। এবং এই কলেজ থেকে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে বিএ পাস করেন। উল্লেখ্য এই কলেজের শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী যুগান্তর দলের সদস্য ছিলেন। তিনি সূর্যসেনকে বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেন।
চট্টগ্রামে ফিরে তিনি গণিতের শিক্ষক হিসেবে ওরিয়েন্টাল স্কুলে যোগ দেন।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে গান্ধীজী স্বরাজ এনে দেওয়ার জন্য বিপ্লবীদের কাছ থেকে এক বৎসরের সময় চেয়ে নেন। তৎকালীন বিপ্লবীরা অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী না হলেও গান্ধীজীর কথায় অনেকেই সহযোগিতা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই অহিংস আন্দোলন এক বৎসরের ভিতর ভারতের স্বারজ আনতে ব্যর্থ হলে, বিপ্লবীরা আবার সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় তিনি একটি জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। এই বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। এর মধ্য দিয়েই তিনি খ্যাত হন মাস্টারদা নামে। এই বিদ্যালয় পরে তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠেছিল।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই ডিসেম্বর চট্টগ্রাম শহরে একপ্রান্তে বাটালি পাহাড় এলাকায় সরকারি রেলের টাকা লুণ্ঠন করে। এই লুণ্ঠনে অংশগ্রহণ করেন অনন্ত সিং, দেবেন দে ও নির্মল সেন। অম্বিকা চক্রবর্তী ও দলিলুর রহমান রেল ডাকাতির সতের হাজার টাকা নিয়ে অস্ত্র কেনার জন্য কলকাতায় চলে যান। সে সময় সুলুকবাহার এলাকায় ছিল বিপ্লবীদের সদর দপ্তর। ২৪শে ডিসেম্বর এই দফতরে পুলিশ হানা দেয়।
এখান থেকে তাঁরা পালিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হলেও এঁরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এঁরা প্রথমে নগরকানা পাহাড়ে আশ্রয় নেন। পুলিশের হাতে ধরা পড়া প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলে মাস্টারদা, অম্বিকা চক্রবর্তী ও রাজেন দাস তাঁদের পকেটে রাখা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। অন্যান্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও মৃতপ্রায় মাস্টারদা ও অম্বিকা চক্রবর্তী পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। উল্লেখ্য এঁরা পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়েছিলেন, সেগুলোর ভালো থাকার সময় সীমা পেড়িয়ে যাওয়ার কারণে কার্যকারিতা হারিয়েছিল। ফলে এই তীব্র বিষে খেয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন। পরে পুলিশ হাসপাতালে তাঁদের চিকিৎসা করার পর তাঁরা সুস্থ হয়ে ওঠেন। এঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ ডাকাতির মামলা রুজু করেছিল। যতীন্দ্র মোহন এই মামলা পরিচালনা করেন এবং প্রায় ৯ মাস কারাবন্দি থাকার পর মামলা থেকে তাঁরা খালাস পান।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ই সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ায় একটি অস্ত্রলুটের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় মাস্টারদার নাম শোনা যায়। এই কারণে ১ নং বেঙ্গল অর্ডিনেন্স ঘোষণা করে সারা বাংলায় বিপ্লবীদের ব্যাপকহারে গ্রেফতার করা হয়। শুধু এক ২৫ অক্টোবর তারিখেই বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ২০০ বিপ্লবী কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এই সময় গ্রেফতার হন নেতাজী সুভাষ বসু, অনিলবরণ রায় প্রমুখ নেতারাও। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে মাষ্টারদা কলকাতার শোভাবাজারে আশ্রয় নেন। ওই সময় তাঁরা কলকাতার দক্ষিণেশ্বরে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নিতেন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই নভেম্বর সেখানে পুলিশ হানা দেয়। সূর্যসেন গায়ের জামা খুলে খালি গায়ে একটা অপরিষ্কার ময়লা গামছা কাঁধে ফেলে চায়ের কেতলি হাতে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসেন। পুলিশ তাঁকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি সাদাসিদাভাবে বলেন, বাবুলোকদের জন্য চা আনতে যাচ্ছেন। পুলিশের দারোগা কিছুক্ষণ জেরা করার পর সন্দেহ করার মতো কোনো কিছু না পেয়ে তাঁকে ছেড়ে দেন। এর প্রায় একবছর পর ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ৮ অক্টোবর কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটের এক মেস থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় ‘মুরারিপুকুর ষড়যন্ত্র মামলা’। এ মামলায় ১৯২৮ সাল পর্যন্ত দুইবছর তাঁকে মেদিনীপুর প্রেসিডেন্সি জেল, পুনার রায়েরোড়া জেল ও বম্বের রত্নগিরি জেলে কারাবাস করতে হয়।
১৯২৮ সালের শেষের দিকে তাঁর স্ত্রী পুষ্পকুন্তলার অসুস্থতার খবর পেয়ে সূর্যসেন তাকে দেখতে আসার অনুমতি প্রার্থনা করেন। এই আবেদন মঞ্জুর করা হলে তিনি জেল থেকে তিনি ছাড়া পান। কিন্তু তাঁকে নজরবন্দি রাখা হয়। বাড়ি পৌঁছার দিনে তাঁর স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তিনি টাইফয়েডে আক্রান্ত হলেন। তিন মাস শয্যাশায়ী থাকলেন। এই সময় একজন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য পরামর্শ দেন এবং এর বিনিময়ে সংসারের খরচ ব্রিটিশ সরকার চালাবে বলে জানানো হয়। সূর্যসেন এর কোনো উত্তর দেন নি। সূর্যসেনের দাদা চন্দ্রনাথ সেন বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে সময় চেয়ে নেন। এরপর একদিন পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যান এবং কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকেন।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। এই সময় পুর্ণেন্দু দস্তিদারের মাধ্যমে দুই নারী বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্তের সাথে পরিচিত হন। প্রথম দিকে দলে নারী সদস্য নেওয়ার পক্ষে তিনি ছিলেন না। পরে পুর্ণেন্দু দস্তিদারের বিশেষ অনুরোধে এঁদেরকে সদস্য হিসেবে গ্রহণ করেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের জন্য পরিকল্পনা করতে থাকেন। এর চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিলে। মোট ৬৫ জন যোদ্ধা নিয়ে প্রায় রাত দশটার দিকে আক্রমণ করে চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে অবস্থিত অস্ত্রাগার দখল করেন। এই সময় তাঁদের পরনে ছিল সেনাবাহিনীর পোশাক। তাঁরা ব্যবহার করেছিলেন কয়েকটি রিভলবার ও সাধারণ বন্দুক। অস্ত্রাগার ভেঙে তাঁরা মাস্কেট্রি রাইফেল, রিভলবার এবং কার্তুজ লাভ করেন। এই আক্রমণের শুরুতেই তাঁরা টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছিলেন। ফলে আক্রমণের সময় ব্রিটিশ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা শহরের অন্যপ্রান্তের সৈন্যদের কাছে এই আক্রমণের যথার্থ সংবাদ পাঠাতে ব্যর্থ হয়। এই সময় বিপ্লবীরা এত দ্রুত আক্রমণ করে দখল করে নেয় যে, সার্জেন্ট ব্লেকবার্ন, কলোন, সার্জেন্ট মেজর ফেরেল-সহ অনেক অফিসার প্রতিরোধ করার আগেই মৃত্যুবরণ করেন।
হরিগোপাল বল (টেগরা) ও মতি কানুনগো
যুদ্ধের উপযোগী প্রচুর রাইফেল এবং সে সময়ের বিখ্যাত স্বয়ংক্রিয় মেশিন গান (লুইস গান) দখল করলেও তার গুলি থেকে বঞ্চিত হলো। কারণ, বিপ্লবীরা জানতো না, অস্ত্র এবং তার গুলি একস্থানে রাখা হয় না। ফলে এই আক্রমণ সফলতার প্রান্তে এসেও সফল হলো না। বিপ্লবীরা অস্ত্রাগার থেকে যথাসম্ভব নিজেদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করলো এবং পরে অস্ত্রাগারগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিল। এই সময় শহরের অপর প্রান্ত থেকে কিছু ব্রিটিশ সৈন্য বিভ্রান্তি অবস্থার মধ্য থেকেও ডবল মুরিং জেটিতে রক্ষিত একমাত্র লুইস থেকে গুলি বর্ষণ শুরু করেছিল। বিপ্লবীরা জানতো লুইসগানের বিরুদ্ধে তাঁরা যুদ্ধে পারবেন না। এই আক্রমণের সময় রাত্রের অন্ধকারে অনন্ত সিং, গণেশ ঘোষ, আনন্দগুপ্ত, জীবন ঘোষাল মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। বাকি সদস্যদের নিয়ে সূর্যসেন সুলুক পাহাড়ে আশ্রয় নিল।
জিতেন দাস, মধু দত্ত ও পুলিনবিকাশ ঘোষ
১৯শে এপ্রিল সারাদিন এই পাহাড়ে কাটিয়ে পরে ফতেয়াবাদে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে সূর্যসেন সবাইকে নিয়ে জালালাবাদ পাহাড়ে আশ্রয় নেন।
২২ শে এপ্রিল বিকালে ট্রেনযোগে আগত বৃটিশ বাহিনীর জালালাবাদ পাহাড়ে অভিযান শুরু করে। ব্রিটিশ সৈন্যরা জালালবাদ পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে, সূর্যসেন তাঁর দলবল নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন এবং এই যুদ্ধের অধিনায়ক হিসাবে লোকনাথকে নিয়োগ দেন। সৈন্যরা পাহাড় বেয়ে উঠে আসার সময় বিপ্লবীরা আক্রমণ চালায়।
নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেন ও বিধু ভট্টাচার্য
এই আক্রমণে ব্রিটিশ সৈন্যরা পিছিয়ে যায়। পরে পূব দিকের একটি পাহাড়ে ব্রিটিশ সৈন্যরা ভাইকার মেশিনগান স্থাপন করতে সক্ষম হয়। জালালাবাদ যুদ্ধে প্রথম শহীদ হন ১৪ বৎসর বয়সী টেগরা বল। এরপর আগে পরে একে একে বিপ্লবীরা যুদ্ধে প্রাণ হারাতে থাকেন। জালালাবাদের যুদ্ধে শহীদ হন মোট ১১জন বিপ্লবী। এঁরা হলেন টেগরা বল, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেন, বিধু ভট্টাচার্য, মতি কানুনগো, প্রভাশ বল, শশাঙ্ক দত্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাস, মধু দত্ত, জো পুলিন ঘোষ। এই দিনের যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী জালালাবাদ পাহাড় দখল করতে পারে নি। তবে অবশিষ্ট বিপ্লবীদের নিয়ে সূর্যসেন রাতের অন্ধকারে জালালাবাদ পাহাড় ত্যাগ করেন। এই সময় আহত বিনোদবিহারী চৌধুরী ও বিনোদ দত্তকে বহন করে অজ্ঞাত পথে পা বাড়ান। এই যুদ্ধের পরে অবশিষ্ট বিদ্রোহীরা চারিদিক ছড়িয়ে পড়েছিল। পাহাড় থেকে নামার পর অগ্রগামী দলে থাকা লোকনাথ বল ও তাঁর সঙ্গীরা অন্ধকারে হারিয়ে যান। ফলে অগ্রগামী দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, সূর্যসেন কোয়েপাড়ার বিনয় সেনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এই সময় তাঁর সাথে ছিল অপর বিপ্লবী নির্মল সেন।
প্রভাশ বল, শশাঙ্ক দত্ত ও নির্মল লালা
মে মাসের প্রথম দিকে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করেন দলের সদস্যরা। সূর্যসেন প্রথমে এই আক্রমণ করা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে বলেন। কিন্তু দলের অত্যুৎসাহী সদস্যদের চাপে তিনি অনুমতি দেন। অবশেষ ৫ই মে সূর্যসেনের অনুমতি নিয়ে আক্রমণের উদ্দেশ্যে একদল বিপ্লবী যান। কিন্তু চারিদিকে সশস্ত্র সৈন্যের আধিক্য দেখে পরে তারা আর আক্রমণ করেন নি।
কল্পনা দত্ত
১৯৩১ সালের এপ্রিল মাসে এক বিশেষ আদালতে রাজদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত ৩২ জন বন্দির বিচার আরম্ভ হয়। সূর্যসেন মাইন ব্যবহার করে জেলের প্রাচীর উড়িয়ে দিয়ে বন্দীদের মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। একই সাথে তিনি আদালত ভবন ধ্বংস করারও উদ্যোগ নেন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কল্পনা দত্ত। হামলার দিন ধার্য করা হয়েছিল ৩রা জুন। শেষ মুহূর্তে সর্বশেষ মাইনটি বসানোর সময় পুলিশের নজরে পড়ে যাওয়ায় গোটা পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়।
নির্মল সেন
সূর্যসেনের দলের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছিলেন। কিন্তু সূর্যসেন ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেলেন। এই সময় তাঁর গ্রেফতারের জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছিল। এরই ভিতরে ১৩ জুন পটিয়ার ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে বিপ্লবীরা মিলিত হন। এই বাড়িতে তখন ছিলেন সূর্যসেন, নির্মল সেন, প্রীতিলতা এবং অপূর্ব সেন। সেখানে আচম্বিতে গুর্খা সৈন্য নিয়ে হানা দেয় ক্যাপ্টেন ক্যামেরন। এখানকার যুদ্ধে ক্যাপ্টেন ক্যামেরন নিহত হয়। বিপ্লবীদের মধ্যে শহিদ হয়েছিলেন নির্মল সেন। পরে পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন অপূর্ব সেন (ভোলা)।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার-এর ডায়রি থেকে জানা যায়, এই সময় অপূর্ব সেন জ্বরে কাতর ছিলেন। দোতলার একটি ঘরে প্রীতিলতা, অপূর্ব সেন ও নির্মল সেন ছিলেন। সৈন্যদের আগমনের কথা সূর্যসেন এসে সবাইকে জানান। সূর্যসেন প্রীতিলতাকে নিচের তলার মেয়েদের ভিতর পাঠিয়ে দেন। আক্রমণের শুরুতেই ক্যামেরন নির্মল সেনের গুলিতে নিহত হয়। এরপর আরও কিছুক্ষণ উভয় পক্ষের ভিতর গুলি চলে। এক পর্যায়ে নির্মল সেন মৃত্যুবরণ করেন। পরে প্রীতিলতা ও অপূর্ব সেনকে নিয়ে সূর্যসেন সন্তর্পণে এই বাড়ি ত্যাগ করেন। এই সময় সৈন্যদের গুলিতে অপূর্ব সেন মৃত্যবরণ করেন।
জুলাই মাসে সরকার সূর্যসেনকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। তৎকালীন আনন্দবাজার পত্রিকায় এই বিষয়ে একটি খবর প্রকাশিত হয়। খবরটি ছিল-
সূর্য সেনকে ধরিয়া দিতে পারিলে দশ হাজার টাকা পুরস্কার
‘১৯৩০ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কার্যে বিপ্লবী দলের নেতা বলিয়া কথিত সূর্য সেনকে যে ধরিয়া দিতে পারিবে, বা এমন সংবাদ দিতে পারিবে যাহাতে সে ধরা পড়ে, তাহাকে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হইবে বলিয়া ঘোষণা করা হইয়াছে।
গত ১৩ই জুন তারিখে পটিয়ার বিপ্লবীদের সহিত যে সংঘর্ষের ফলে ক্যাপ্টেন ক্যামেরণ নিহত হইয়াছেন, সূর্যসেনই নাকি সেই সংঘর্ষের পারিচালক।’
আনন্দবাজার। ৩রা জুলাই ১৩৩২
এরপর সূর্যসেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা করলেন। এ অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হল প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে আক্রমণ করা হল ইউরোপীয়ান ক্লাব। সফল আক্রমণ শেষে ফেরার পথে এক ইংরেজ অফিসারের গুলিতে প্রীতিলতা আহত হন। ধরা না দেবার প্রত্যয়ে সঙ্গে রাখা সায়ানাইড বিষ পান করে তিনি আত্মাহুতি দিলেন। ভারতের মুক্তিসংগ্রামের প্রথম নারী শহীদের নাম প্রীতিলতা।
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি গৈরালা গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই সময় ইংরেজ সরকার তাঁর মাথার দাম ধার্য করেছিল দশ হাজার টাকা। এখানে ব্রজেন সেন মাস্টারদাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য নিয়ে আসেন। এই গ্রামের বিশ্বাস-বাড়ির গৃহবধু ক্ষিরোদাপ্রভা বিশ্বাসের ঘরে ছিলেন। ব্রজেন সেনের বাসা থেকে কার জন্য খাবার নিয়ে ক্ষিরোদাপ্রভা বিশ্বাসের ঘরে যাচ্ছে, তা জানার জন্য ব্রজেন সেনের ভাই নেত্র সেন বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠে। পরে সূর্যসেনের অবস্থানের কথা জানতে পরে, পুলিশকে খবর দেয়। তারপর রাতের বেলা আলোর সংকেত দেখিয়ে নেত্র সেন সৈন্যদের পথ দেখায়। বিষয়টি ব্রজেন সেন বুঝতে পেরে শেষ মুহূর্তে চেষ্টা করেও সূর্যসেনকে রক্ষা করতে পারেন নি। ক্যাপ্টেন ওয়ামস্লীর নেতৃত্বে একদল গুর্খা সৈন্য সূর্যসেনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারিতে তাঁর ফাঁসি হয়।
মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। মূল লেখাটি ছিল ইংরেজিতে। নিচে বাংলায় তা তুলে ধরা হলো।
আমার শেষ বাণী –আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই তো আমার সাধনার সময়। এই তো আমার বন্ধুরূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার সময়, হারানো দিনগুলোকে নতুন করে স্মরণ করার এই তো সময়।
কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। তোমরা আমরা ভাই-বোনেরা তোমাদের মধুর স্মৃতি বৈচিত্রহীন আমার এই জীবনের একঘেঁয়েমিকে ভেঙে দেয়। উৎসাহ দেয় আমাকে। এই সুন্দর পরম মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আমার জীবনের এক শুভ মুহূর্তে এই স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জীবনভর উৎসাহভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মতো সেই স্বপ্নের পেছনে আমি ছুটেছি। জানি না কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মতো তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি। আমার বন্ধুরা – এগিয়ে চল, এগিয়ে চল – কখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। ঐ দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুণ। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই। ভগবান তোমাদের আশীর্বাদ করুন।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিলের চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহের কথা কোনো দিনই ভুলে যেও না। জালালাবাদ, জুলখা, চন্দননগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময় মনে রেখো। ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যেসব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো।
আমাদের সংগঠনে বিভেদ না আসে– এই আমার একান্ত আবেদন। যারা কারাগারের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে, তাদের সকলকে জানাই আমার আশীর্বাদ। বিদায় নিলাম তোমাদের কাছ থেকে।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক
বন্দেমাতরম
১১ই জানুয়ারি, ১৯৩৪
সকাল ৭টা।
চট্টগ্রাম কারাগার
মহান ও কীর্তিমান মানুষদের নিয়ে সব সময়ই লেখা যায় আমরা এটা বিশ্বাস করি। পরিশেষে, সমাজতন্ত্র অভিমুখী অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সমতা-ন্যায্যতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনেই বিশ্বজনীন মহান এই গুণীর রাজনীতি, জীবন সংগ্রাম, কীর্তি, ইতিহাস, তত্ত্ব ও অনুশীলন সম্পর্কে পাঠ প্রাসঙ্গিক ও জরুরী।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ের কিংবদন্তি সশস্ত্র বিপ্লবী মাষ্টারদা সূর্যসেন মুক্তমত সৈয়দ আমিরুজ্জামান