২০২৪: আসন্ন মুদ্রানীতি কেমন হওয়া উচিত
১৩ জানুয়ারি ২০২৪ ১৫:২৬
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের আগামী ১৫ জানুয়ারি, ২০২৪ চলমান প্রান্তিকের মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এবার মুদ্রানীতিতে আগেরকার মুদ্রানীতির চাইতে নতুন কিছু পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে বিশেষ: বৈম্বিক ও স্থানীয় অথনৈতিক অবস্থার কারনে। এবারের মুদ্রানীতিকে আগেকার মত ব্যাপক করার স্বার্থে অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার, উদ্যোক্তা, সাংবাদিক ও ব্যবসায়ীদের কাছে মতামত সংগ্রহ করার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অনেকেই প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় মতামত প্রকাশ করছেন। শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা এ মুদ্রানীতি প্রণয়ন কমিটিতে ছিলেন। এবারের কমিটিতে বাইরে থেকে আরো তিনজনকে রাখা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মুদ্রানীতি প্রণয়ন কমিটিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গভর্নরসহ মুদ্রানীতি বিভাগের ডেপুটি গভর্নর, প্রধান অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক থাকছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরে থেকে কমিটিতে থাকছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক এবং পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) একজন প্রতিনিধি।
এবারের মুদ্রানীতি প্রনয়নে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ আছে যেমন উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিনিময় হার এবং রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। ২০২৪ সালের মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসছে মূল্যস্ফীতি যা বিদায়ী ২০২৩ সালেও ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে বছরজুড়ে ঊর্ধ্বমুখী ছিল। বছরের শেষের দিকে অক্টোবরে এসে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে ওঠে, যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। বছরের বেশির ভাগ সময়ই সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে ওঠে, যা এর আগের ১৩৪ মাস বা ১১ বছর ২ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। অক্টোবরেও সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।এ অবস্থা বিবেচনায় ২০২২ সালের ১০০ টাকার পণ্য কিনতে ২০২৩ সালে ভোক্তার ব্যয় করতে হয়েছে ১০৯ টাকা। ভেবে দেখা দরকার, সেই অনুপাতে মজুরি বেড়েছে কত টাকা। মানুষের জীবনযাপন ব্যয়কে ২০২২ সালের মতো রাখতে চাইলেও ২০২৩ সালে কমপক্ষে ৯ ভাগ মজুরি বৃদ্ধি দরকার ছিল। কিন্তু বাস্তবে কি তা হয়েছে ? আগামী ছয় মাসের মধ্যে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।এবং এর জন্য মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি এবং সামাজিক সুরক্ষা নীতি – এই তিনটিকে একসঙ্গে সমন্বয় করে কাজে লাগাতে হবে। প্রয়োজনে আমদানি শুল্ক কমাতে হবে যাতে পণ্য আমদানি ব্যয় কমে। এর পরে আসে রিজার্ভ ও ডলারের বিনিময় হার এতে দেখা যায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৪০ কোটি ডলার ঋণের ওপর ভর করে বৈদেশিক মুদ্রার বছরের শেষদিকে রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে। এই দুই সংস্থার ঋণ পাওয়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারে। তবে খরচ করার মতো রিজার্ভ (বিপিএম৬) আছে ২১ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। ডলারের বিনিময় হারে দেখা যায় চলতি বছরে আগের মতো ডলারের দাম ধরে না রেখে ধীরে ধীরে তা বাজারভিত্তিক করার দিকে নেওয়া হয়েছে। এতে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ১১০ টাকা হলেও ব্যাংকগুলো নিজেরাই ডলার কিনছে ১২২-১২৩ টাকা দামে। ফলে এর চেয়ে বেশি দামে আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের। ডলারের দাম তিন দফায় কমানো হয়েছে। এখন ডলার বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা দামে। মাঝে অস্থিরতায় খোলাবাজারে ডলারের দাম ওঠে ১২৭ টাকায়, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ দর। প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ।২০২২ সালে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়প্রাপ্তিতে নেতিবাচক ধারা থাকলেও এ বছরে প্রবৃদ্ধি অর্জনের পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির মতে, দেশের প্রবাসী আয়ে এখন ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এ বছরের শেষে আনুষ্ঠানিক তথা বৈধ চ্যানেলে বাংলাদেশের মোট প্রবাসী আয়ের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ২৩ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার যদিও হুন্ডির সঙ্কট রয়েছে । ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেড়েছে ৫৫ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার হয়েছে যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়। এর আগে, ২০২১-২২ অর্থবছরের রপ্তানি আয় ছিল ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৬২ বিলিয়ন ডলার। এতে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১১ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক হলো আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যার ব একটি রুটিন কাজ হচ্ছে মুদ্রানীতি প্রণয়ন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকা মূল অস্ত্র হচ্ছে মুদ্রানীতির কার্যকর ব্যবহার অর্থাৎ অর্থনীতির সাধারণ নিয়মে নীতি সুদহার বাড়িয়ে বা কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কাজটি করতে হয়, কিন্তু আমাদের কাছে অনেক দিন এটি অকার্যকর ছিল। এ কাজটি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি বিভাগ। প্রতিটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হচ্ছে এটি। বাংলাদেশে বছরে দু-বার মুদ্রানীতি ঘোষনা করা হয় অতছ আই.এম.এফ এর সুপারিশ হলো দুমাস অন্তর মুদ্রানীতি তৈরী করা /বাস্তবায়ন করা । এবারের মুদ্রানীতিতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ আছে। দেশে মুদ্রাস্ফীতি অনেক বেড়ে আছে, অন্যদিকে রিজার্ভ দিন দিন কমছে;, তারল্য নিয়ে একটি বাড়তি উদ্বেগ রয়ে গেছে, করোনার জন্য কিছু নীতিগত সিদ্ধাšেন্ত কারণে খেলাপি ঋণ বিগত বছরে কম ছিল, কিন্তু এবার খেলাপি ঋণ বেড়ে ১ লাখ ৫০হাজার কোটি টাকার ওপরে পৌঁছে গেছে। নতুন সুদহার স্মার্ট চালু হওয়ার পর থেকে মাসে মাসে সুদের হার বেড়ে চলছে এবং সর্বশেষ ডিসেম্বরে স্মার্ট সুদের হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১৪ ভাগ, তাতে করে ব্যবসায়িক ঋণের সুদের হার ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশে পৌঁছবে। এর ফলে দিন দিন ঋণ অনেক দামি হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসার খরচ বৃদ্ধি পাবে। এসব সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সামগ্রিক অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি ঠিক রাখতে গিয়ে মুদ্রানীতি একটু ব্যতিক্রমধর্মী হওয়ার দাবি রাখে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি রোধ, রিজার্ভ বাড়ানো এবাবের মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত কিন্তু সেটা কি ভাবে হতে পারে তা নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে । বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাইয়ের পর থেকেই সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির অবস্থানে রয়েছে। সুদের হারও কিছুটা বাজারভিত্তিক করা হয়েছ। গত অক্টোবরের পর থেকে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা দেওয়া বন্ধ হয়েছে। মানে টাকা ছাপানোটা বন্ধ হয়েছে। এসব পদক্ষেপ মূল্যস্ফীতি না বাড়েতে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু এগুলো যথেষ্ট নয়। কারণ দেশে মূল্যস্ফীতির পেছনে আরও বড় দুটি কারণ রয়েছে। যার একটি হচ্ছে ডলার সংকট,অপরটি বাজার ব্যবস্থাপনা । ডলার সংকটের ফলে আমদানি, ভোগ্যপণ্যের জোগান ও উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, এমন পরিস্থিতি মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। খাদ্য মূল্যস্ফীতিই এখন বেশি তা শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে কমানো মোটেই যৌক্তিক নয়। খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে বাজার ব্যবস্থাপনার বড় ভূমিকা থাকে। সময়ে সময়ে দেখা যায়, ১০০ টাকা দামের পণ্যের দাম লাফ দিয়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। একবার বেড়ে গেলে উচ্চ পর্যায় থেকে হয়তো পরে কিছুটা কমে আসে; কিন্তু যে পর্যায়ে ছিল সে পর্যায়ে আর নামে না। ভোজ্যতেল, ডিম, পেঁয়াজসহ অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে এমনটি দেখা গেছে। সাপ-াই চেইনে থাকা বড় বড় ব্যবসায়ীর বাজারের ওপর যে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তার অপব্যবহারের কারণে বাজার এভাবে অস্থিতিশীল হয়ে যায়। তাই বাজার ব্যবস্থাপনা যদি উন্নত করা না যায়, তাহলে শুধু খুচরা পর্যায়ে মূল্য বেঁধে দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। খুচরা পর্যায়ে যারা আছে তারা তো বাজার কারসাজির এই খেলার মধ্যে নেই। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে ডলার সংকট কাটানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে, ব্যাংকিং সিস্টেমের মাধ্যমে ডলার না আসা ও হুন্ডি বড় বাধা । ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ৫৫ বিলিয়ন ডলার; কিন্তু ব্যাংকিং সিস্টেমের মাধ্যমে এসেছে ৪৩ বিলিয়ন ডলার। বাকি ১২ বিলিয়ন ডলার কোথায় গেল ? একইভাবে রেমিট্যিান্সের মাধ্যমে ব্যাংকিং সিস্টেমে যে ডলার আসার কথা তাও আসছে না। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে ডলারের দরের পার্থক্য এত বেশি হয়ে গেছে, মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলেই রেমিট্যান্স বেশি পাঠাতে চাইছে। এখানে পরিবর্তন দরকার হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আর্থিক খাতে ভঙ্গুরতা। আর্থিক খাতে সম্পদগুলো দুর্দশাগ্রস্থ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ সাল শেষে আর্থিক খাতে ২৪ শতাংশ সম্পদ ছিল দুর্দশাগ্রস্থ। এর গোড়ার কারণ খেলাপি ঋণ। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের যথেষ্ট মূলধন নেই। অনেক প্রতিষ্ঠান খেলাপি ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত প্রভিশন না রাখা সত্ত্বেও মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। যেগুলো দুর্বল প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রচুর অনিয়ম চলছে– সেগুলোকে যদি একটা শৃঙ্খলার মধ্যে না আনা যায়, তাহলে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা কঠিন হয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে কিছু কাজ অবশ্য করা হয়েছে।
২০২৪ সালে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আনার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির ওপর নির্ভর না করে বাজার ব্যবস্থাপনাকে উন্নত করতে হবে। বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে ডলার সংকট থেকে। এ জন্য ডলারের দরের বাফেদা-এবিবি মডেল বাদ দিতে হবে। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় পথ পরিবর্তনের প্রয়োজন। চলতি বছর অর্থনীতিতে যেসব সংকট রয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই ২০২৩ সাল থেকে এসেছে। গত বছর এই সংকট মোকাবিলায় আমরা যে পথে হেঁটেছি তাতে সুফল মেলেনি। নীতিনির্ধারকদের অনেকে মনে করেন, পথটা ভুল ছিল না– গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, পথটাই বদলাতে হবে। কারণ এখন যে পথ আছে সেটা গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাবে না, একটা খাদের দিকে নিয়ে যাবে। নিরাপদ থাকতে হলে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার পথ পরিবর্তন করতে হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই
২০২৪: আসন্ন মুদ্রানীতি কেমন হওয়া উচিত ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত