মাহী: হেমন্তের এক ঝরা ফুল
১৮ জানুয়ারি ২০২৪ ১৭:৩০
টুং টাং ঝন ঝন ঝড়ের ঝাপটায় জানালার কাচ ভাঙার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল মাহীর। আকাশ জাঁকিয়ে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির ঘ্রাণ নিতে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বৃষ্টির ফোঁটা আছড়ে পড়ছে নিম গাছের পাতার ওপর। বৃষ্টিস্নাত সকাল খুবই সুন্দর হয়। মাহীদের বাংলোর পাশে আমগাছে বেশ কয়েকটি সিঁদুর পরা আম বাতাসে দুলছে। টুপটাপ দু-একটা আম ঝরে পড়ল বাংলোর আঙিনায়। মাহী কাজিনদের সাথে জড়ো হাওয়া আম কুড়ায়। পরদিন ইশকুলে যাওয়ার সময় তার বন্ধু ফায়রুজ, আশরাফ ও রাজের জন্য পাকা আম নিয়ে যায়। মাহীদের ফল বাগানের পেয়ারা, আম, কুল, লাউ সবজিসহ নানা কিছু নিয়ে যায় মাঝে মাঝে শিক্ষকদেরও উপহার দেয়। নানার কাছে শুনেছে গাছের ফল একা খেতে নেই। প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবদের দিলে আল্লাহ গাছের ফলন বাড়িয়ে দেন। বারান্দার ফুলে টবে পানি দিতে দিতে মাহী আনমনে কী যেন ভাবতে থাকে। নীপবনে ফুল ফুটতে শুরু করেছে। বারান্দায় খাঁচায় খরগোশ দুটি মনের আনন্দে খেলছে। ৫ অক্টোবর মাহির জন্মদিনে ছোট বোন সুষ্মীর দেওয়া ইরানি বিড়ালটি মাহীর পিছে মিঞ মিঞ করে ঘুরঘুর করছে। মাহী মাঝে মাঝে বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে আদর করে। পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। দূর থেকে ভেসে আসছে বাবুই পাখির কিচিরমিচির। সাথে ঝুঁটিওয়ালার বুলবুলির ডাক। এত সুন্দর পাখির ডাক মাহী আগে কখনো শোনেনি।
বুলবুলি পাখিটা তার বন্ধু পাখিটার ঠোঁটে ঠোকর দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে যে গানের মিষ্টি সুর তুলে গান করছে মনে হচ্ছে যেন সুবলং পাহাড় থেকে ঝরে পড়া পাহাড়ি ঝরনা বয়ে পাথরের ঘষা লেগে যে নরম মধুর শব্দ হয় ঠিক সেরকম। বুলবুলির গান শুনতে শুনতে রংপেনসিল নিয়ে ছবি আঁকতে বসল। দুরন্ত কৈশোর বেলার একটি অসাধারণ ছবি এঁকে ফেলল। পরদিন ছিল সুষ্মীর জন্মদিন। ভাইবোন দুজনে ছিলে একে অপরের বন্ধুর মতো। মাহী তাঁর ছোটো বোন সুষ্মীকে সবসময় চোখে চোখে রাখে। মাহীর আঁকা ছবিটি সুষ্মীর জন্মদিনে উপহার দিল। ইশকুল থেকে ফেরার পথে সুষ্মীর জন্য ডেইরি মিল্ক, কিটকেট চকলেট, গরম গরম ডাল পুরি নিয়ে ফিরত। সুষ্মী মাহিকে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় একবার সালাম দিবে, প্রবেশ করার সময় সালাম দিবে। মাঝে মাঝে মাহিও সুষ্মীকে সালাম দেয়। বাসায় ফিরলে দুজনে ব্যালকনিতে বসে গল্প করতে করতে খাবার খেত। সুষ্মী মাহিকে সুন্দর উপহারের জন্য ধন্যবাদ দিত। মা শিখিয়েছেন, ছোটো-বড়ো সবাইকে সালাম দিবে এবং কেউ কিছু উপহার দিলে ধন্যবাদ দেওয়া এবং কোনো ভুল করলে বিনয়ের সাথে দুঃখিত বলতে। বড়োদের সামনে উচ্চ বাক্য বিনিময় না করতে।
মাহী ছিল প্রকৃতিপ্রেমী প্রাণবন্ত চঞ্চল প্রকৃতির এক দুরন্ত কিশোর। মাহী বাড়িতে বাবা-মায়ের সাথে সময় কাটাতে পারত না তখন সে খুব অভিমান করত। দাদি-মা নানা-নানুর কাজিনদের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করত। একান্নবর্তী পরিবারে বসবাস করার মজাই আলাদা। শিশুদের মানসিক বিকাশ হয়। মাহির দাদু একটা কথা সবসময় বলতেন, পিতামাতাদের উচিত শিশুদেরকে বেশি বেশি করে সময় দেওয়া। কিশোর বয়সে মনের যত্ন নেওয়া।
মা চাঁদ সুলতানা ম্যাম সরকারি ইশকুলের প্রধান শিক্ষিকা, বাবা আইয়ুব বাবুল ভাই শিশু সংগঠক ও পটিয়া পৌরসভার মেয়র। মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয় একজন জনপ্রতিনিধি। যিনি সবসময় মানুষের জন্য ভালোবাসার হাত প্রসারিত করে দিতে ব্যস্ত। উড়ে বেড়ান, ঘুরে বেড়ান কার কী সমস্যা আছে খুঁজে খুঁজে সমাধান করেন। কে অসুস্থ কার পিতা/মাতা মারা গেল জানাজায় গিয়ে শরিক হোন। দারুণ সামাজিক সাদামনের একজন মানুষ। মানুষের সেবা করা মানুষকে ভালোবেসে কাছের করে নেওয়াই ছিল তার নেশা। তিন বিশ্বাস করেন, মানুষকে ভালোবাসতে পারাটা হচ্ছে তার কাছে বড়ো সম্মানের। ভালোবাসা মানে নার্সিং করা তিনি এই কাজটি খুব সহজে করতে পারতেন। এসব করতে করতে তিনি নিজেকে ভাঙা দরজার কলকবজার মতো করে ফেলেছেন। মাহী কখন যে বাবার বুকের উপর মাথা রেখে শুয়েছিল মনে নেই। মাহী বছরে অন্তত একবার বাবার হাত ধরে সমুদ্রের জলরাশিরতে পা ভেজানো এবং বান্দরবানের পাহাড় চুড়োয় ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করত।
মাহী ইশকুলবেলা যেটুকু আদর পেয়েছে বলতে গেলে মা জননীর। সারাক্ষণ মায়ের আঁচল জড়িয়ে থাকত। বাসায় ছুটির দিনে গল্পের বই পড়ে, কিশোর গল্প, শেকসপিয়র ও হুমায়ূন আহমেদের লেখা তার খুব প্রিয়। মাহির স্বপ্ন ছিল বড়ো হয়ে ব্যারিস্টার হবে। শৈশবে বাবার কাছে সাঁতার শিখেছিল। ইশকুলবেলায় রোভার স্কাউট ও বিএনসিসি ও শাপলা কুঁড়ির সক্রিয় সদস্য ছিল। ক্রিকেট ছিল তার প্রিয় খেলা। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট টুর্নামেন্টে ম্যাচ খেলতে দূরদূরান্তে চলে যেত। বাসায় চিন্তা অস্থির থাকত মা চাঁদ সুলতানা ম্যাম। বাসায় ফিরলে আম্মু আম্মু বলে মিষ্টি সুরে ডাক দিত, আম্মুর গলা জড়িয়ে বলত, “আম্মু জানো আজকে আমি তিন তিনটা উইকেট পেয়েছি রানও করেছি সর্বোচ্চ। এই মেডেলটা ম্যান অব দ্য ম্যাচ পেয়েছি। নাও এটা তোমার গলায় পরিয়ে দিব বলে মাকে জড়িয় ধরত।”
মাহীর সবচেয়ে বড়ো গুণ ছিল সেও তার বাবার মতো মানুষকে ভালোবাসত। এজন্য তাকে সবাই পছন্দ করত। বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হলে সবার আগে সে গিয়ে মেহমানদারি করবে। নিষ্পেষিত ও বৃদ্ধ মানুষ ও শিশুদের আগে খাবার পরিবেশন করত। মাহী ভালো সাইকেলিং করত। একবার তো সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় ইনজুরড হয়েছিল। তিনটি সেলাই দিতে হয়েছিল মাথায়।
করোনাকালীন মাহির বাবা-মা শত ব্যস্ততার মধ্যে দুজনে করোনা টিকা নিয়েছিলেন ছেলেমেয়ের ব্যাপারেও সচেতন ছিলেন। তাই মাহিকেও নিয়ে গেলেন টিকা দিতে। ডাক্তার জানালেন বয়স ১৮ বছরের নিচে টিকা দেওয়া যাবে না বলে মাহিকে টিকা দিলেন না। কে জানত মাহী একদিন করোনা আক্রান্ত হবে। জানুয়ারি মাসে হঠাৎ একদিন মাহি করোনা আক্রান্ত হলো। তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলো, ১৭ জানুয়ারি রাতের বেলা শ্বাসকষ্ট হতে লাগল। হাই ফ্লো অক্সিজেন না থাকার কারণে মাহিকে জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় নিয়ে আসার পরামর্শ দিলেন ডাক্তার। বাবা-মায়ের সাথে মাহি অ্যাম্বুলেন্সে, মা সুরা ইয়াসিন পড়ে পড়ে মাহীর মাথায় ফুঁ দিচ্ছেন। বাবা বারবার মাহিকে ডাকছেন, মাহী বাবা তুমি ভালো হয়ে যাবে। মাহি বাবার হাত শক্ত করে ধরে আছে। বাবা বলছিলেন, মাহি আরেকটু পড়ে আমরা ঢাকা পৌঁছে যাব। ইনশাল্লাহ বাবা তুমি ভালো হয়ে যাবে। অ্যাম্বুলেন্স তখন কুমিল্লায় পৌঁছেছে ঘড়িতে তখন রাত ১২টা বেজে ১০ মিনিট। রাতের নীরবতাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে চলেছে অ্যাম্বুলেন্সের হুইস্লের শব্দ, আকাশের চাঁদটা কেমন জানি মেঘের আড়ালে প্রবেশ করতে ব্যস্ত। ধূসর শহরে কু কু করে হুতুম প্যাঁচা ডাকছে। দু-একটা জোনাকি মিটি মিটি করে আলো ছড়াতে ব্যস্ত। হঠাৎ মাহী জোরে একটা হ্যাঁচকি দিলো। মাহির হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। হাতের পালসও বন্ধ। অক্সিজেন বন্ধ হয়ে গেল। মাহি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেল না ফেরার দেশে। বাবা-মায়ের চিৎকারে গাড়ি থেমে গেলে। মাহী আর কখনো আম্মু আম্মু বলে মিষ্টি সুরে ডাকবে না। বাবার হাত ধরে কখনো ইশকুলে যাওয়া হবে না। ডাক্তারের অবহেলায় টিকা না দেওয়ার কারণে মাহীর চলে যাওয়া কিছুতে মেনে নিতে পারছে না মাহীর বাবা-মা ও একমাত্র ছোটো বোন সুষ্মী। বড়ো আদুরের ছোট্ট বোনটি তার ভাই মারা যাওয়ার পর থেকে কখনো ডেইরি মিল্ক, কিটকেট, চকলেট, পুরি মুখে দেয়নি। দেখতে দেখতে মাহির চলে যাওয়া ২টি বছর গত হলো। মা ইশকুলে যাওয়ার পথে মাহির সাড়ে তিন হাত কুঁড়েঘরটি উঁকি দিয়ে একবার দেখেন। যাওয়ার সময় বড়ো একটা শ্বাস ফেলেন, মাঝে মাঝে শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদেন। কতটুকু অশ্রু গড়ালে হৃদয় হবে সিক্ত! মাহীর বাবা এসে মাহীর মায়ের হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদেন। তাঁদের পিছু পিছু সুষ্মীও আসে। সেও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে, মাহি ভাইয়া আমার জন্য এখন আর কেউ চকলেট আনে না। তোমার পোষা খরগোশগুলো তোমাকে খুঁজে ফিরে। মাহীর সমাধিতে সবুজ দূর্বা ঘাসে ভরে গেছে। তার উপর শিশিরভেজা হেমন্তে ঝরে পড়া শিউলির বিছানা।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই