নতুন মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ
২১ জানুয়ারি ২০২৪ ১৭:০৪
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অভিঘাতে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি, তারল্য সংকট , বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে লাগাম টানাসহ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতির প্রভাবে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, খাদ্য সংকটের আশঙ্কা – এসব বহুমুখী চ্যালেঞ্জ সামাল দিয়ে প্রবৃদ্ধির ধারাকে অব্যাহত রেখে সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে এই মুদ্রানীতিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ রেখে ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমাার্ধে (জানুয়ারি-জুন) সংকোচনমূলক নতুন মুদ্রানীতি ঘোষনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক যার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে এর একটি পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে । প্রাথমিক ভাবে নতুন মুদ্রানীতিতে তিনটি বিষয়কে বিবেচনায় আনা হয়েছে যথা: এক নীতি সুদহার ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ শতাংশ করা হযেছে যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করবে, তার সুদহার বাড়বে; দ্বিতীয় রিভার্স রেপো (বর্তমান নাম স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি বা এসডিএফ) নিম্নসীমার সুদহার ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে যার ফলে বাজারে উদ্বৃত্ত টাকা থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক রিভার্স রেপোর মাধ্যমে টাকা তুলে নেয়এবং তৃতীয়ত: নীতি সুদহার করিডরের ঊর্ধ্বসীমা স্পেশাল রেপো বা এসএলএফ’র (স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি) সুদহার ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে যার ফলে সংকটে পড়া ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে কিছুটা ব্যয় কমবে। নীতি সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্নসীমার মধ্যে ব্যবধান ২০০ শতাংশ পয়েন্ট থেকে কমিয়ে ১৫০ শতাংশ পয়েন্টে নামিয়ে আনা হয়েছে। অর্থাৎ নীতি সুদহার আট শতাংশের সঙ্গে সর্বোচ্চ ১৫০ বেসিস পয়েন্ট যোগ করে এসএলএফ সুদহার ও নিচে ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বিয়োগ করে এসডিএফ সুদহার নির্ধারণ করা প্রেক্ষাপটে মুদ্রানীতির প্রধান আলোচ্য বিষয় গুলোর মধ্যে রয়েছে এক: জানুয়ারি-জুন সময়ের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে দেখা যাচ্ছে, ২০২৪ সালের জুন মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ শতাংশ। একই সময়ের জন্য সরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ২ শতাংশ; সরকারি খাতে ছিল ১৮ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে বিদেশী মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি ব্যবহারের চিন্তা করা হচ্ছে; দুই: জানুয়ারি-জুন সময়ের জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণায় বলা হয়েছে আমদানিতে ডলারের দাম ১১০ টাকায় রাখা গেছে যা বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় এখনো কম, এ সময়ে আমদানি কমেছে, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির উদ্যোগ ছিল ফলে রিজার্ভ ২৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারে রাখা গেছে; তিন: ঘোষিত মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার (রেপোরেট) ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮% উন্নীত করে বাজারে মুদ্রা প্রবাহ হ্রাস করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার এ উদ্যোগ কার্যকর হবে; চার: মুদ্রা বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনয়নে, ‘ক্রগিং পেগ’ পদ্ধতি বাজারকে কিছুটা স্থিতিশীল রাখতে সক্ষম হবে, তবে এর জন্য কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করা অপরিহার্য। উপরন্তু বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে রায়ার্স ক্রেডিট, ইউজেন্স এলসি, ডেফার্ড পেমেন্ট এবং এক্সপোর্ট ফ্যাক্টরিং প্রভৃতি বিষয় বিকল্প উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত। দেশে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে তারল্য বৃদ্ধিকল্পে ‘এক্সপোর্টার রিটেনশন কোটা (ইআরকিউ)’ হার পূর্বের ১৫%, ৬০% এবং ৭০%-এর তুলনায় যথাক্রমে ৭.৫%, ৩০% এবং ৩৫% নামিয়ে আনা হয়েছে ,এ ছাড়াও পেমেন্টের ক্ষেত্রে রেগুলেটরি ক্যাপিটালের ৪০% অফশোর ব্যাংকিং অপারেশন্স হতে ধারের সুযোগ দিয়া হয়েছে; চার: এ উদ্যোগ বিদ্যমান বৈদেশিক মুদ্রার পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল করবে, যদিও সীমিত হস্তক্ষেপ এবং সুসংগঠিত নীতিকাঠামোর আওতায় বৈদেশিক মুদ্রার বাজারকে পরিচালিত হওয়ার সুযোগ প্রয়োজন হবে।
একটি নিরপেক্ষ বিশ্লেষনে দেখা যায় যে সংকোচনমূলক নীতি নেয়া হয় চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি তো সরবরাহজনিত মূল্যস্ফীতি যেখানে চাহিদার ভূমিকা অল্প। এ ধরনের মুদ্রানীতির ফলে ছোট, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) ক্ষতিগ্রস্থ হবে। অতএব বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত একটি পলিসি স্টেটমেন্ট দেয়া অর্থাৎ এখন থেকে যে ঋণ অনুমোদন হবে তার বড় অংশ যেন যায় এসএমইতে। কারন বাংলাদেশের সবচেয়ে উৎপাদনশীল খাত ‘ এসএমই, এরা বাজারে পণ্য ও সেবা বাড়াবে যা মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমতে সহায়ক হবে, মানুষের কর্মসংস্থানও হবে এবং আয়ের সংস্থান বাড়লে মানুষের একটু উপকার হবে। শুধু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করলে বড় কিছু হবে না কারন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট এখন নেতিবাচক। রফতানি আয় বাড়ানো ও বৈচিত্র্যকরণের জন্য কিছু পলিসি দরকার ছিল মুদ্রানীতিতে। তৈরি পোশাকের বাইরে অন্যান্য খাতে রফতানি উৎসাহিত করতে প্রণোদনা থাকলে ভালো হতো। শুধু মূল্যস্ফীতি কমানো হবে আর অন্যক্ষেত্রে কিছু করা হবে না, এতে আংশিক সমস্যার সমাধান হবে। বিষয়টা হলো, সার্বিকভাবে সমস্যার গভীরে গিয়ে তা সমাধানের চেষ্টা করা উচিত।
বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থনীতিতে একটা তত্ত্ব আছে যে অর্থনীতিতে মুদ্রার বেশি সরবরাহ হলে মূল্যস্ফীতি হবে যাা সম্পূর্ণরূপে সত্যি না, তবে মুদ্রা যদি বেশি হয়, টাকা পাচার যদি বেশি হয় তাহলে মূল্যস্ফীতি হবে। সুদহার স্রেফ বাড়িয়ে দিয়েই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, বরং সরবরাহ বাড়াতে হবে। এজন্য সিলেক্টিভ বিশেষ করে ক্ষুদ্র কৃষক, পোলট্রি, ফিশারিজ, ক্ষুদ্র কিংবা মাঝারি ব্যবসায়ীদের কম সুদে টাকা সরবরাহ করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিফাইন্যান্সিং বা পুনঃঅর্থায়ন আসতে হবে এবং সেখানে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির প্রয়োজন পড়বে না।, বরং এসব খাতে যদি ঋণপ্রবাহ বাড়ানো যায় তাহলে বাজারে সরবরাহ বাড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এককভাবে মূল্যস্ফীতি কমাতে পারবে না বরং বাণিজ্য, খাদ্য ও কৃষি-এ তিন মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে চেষ্টা করতে হবে। বাজারে সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত না করে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। রেপো রিভার্স রেট বৃদ্ধিতে হয়তো যারা অল্প সুদে টাকা-পয়সা নিয়ে ডাইভার্ট করছে, অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, টাকা ব্যবহার করছে না, তারা কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হবে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদহার বৃদ্ধি আংশিকভাবে সফল নীতি, পুরোপুরি নয়। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে সরকার আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোও সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশ দিচ্ছে। যারা রেমিট্যান্স পাঠায় তারা যে এতে বেশি সুবিধা পায় এমন নয়। দেশ থেকে অর্থ পাচার ঠেকাতে না পারলে অফিশিয়াল চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো বাড়ানো যাবে না। রফতানি করলে বোনাস হিসেবে বেশি টাকা দেয়া হবে—বিভিন্ন সময়ে এ রকম পলিসি নেয়া হয়েছে। কিন্তু বড় কোনো লাভ নেই, বরং ডলার রেটটা যদি বাজারভিত্তিক করা হয় তাহলে কাজে আসবে । আড়াই শতাংশ প্রণোদনা পেয়েও দেখা গেছে হুন্ডির তুলনায় অনেক পেছনে, এতে হুন্ডি কমানো যাচ্ছে না। মাল্টিপল রেট না রেখে একক রেট রাখতে হবে, এটা বাজারে ছেড়ে দেয়া উচিত ছিল। প্রয়োজনে তখন একটা সার্কিট ব্রেকার দেয়া যেতে পারে। ডলারের দাম এর বেশি তোলা যাবে না। দ্বিতীয়ত, রেমিট্যান্স পাঠানো সহজতর করতে হবে। এখন অফিশিয়াল চ্যানেলে টাকা পাঠানো হয়তো হুন্ডির মতো সহজ করা যাবে না। কিন্তু খরচ একটু কমাতে হবে এবং লেনদেনটা দ্রুততর করতে হবে। বাংলাদেশের জন্য এটা সঠিক পলিসি ছিল না। আজকের এ জায়গায় আসার পেছনে পলিসিগত দুর্বলতা প্রধানত দায়ী। সঠিক সময়ে সঠিক পলিসি নিলে এ সমস্যাগুলো হতো না। ছয়-নয় সুদের হার নির্ধারণও একটা ভুল পলিসি। বলা হচ্ছে, বড় ব্যবসায়ীদের চাপে পড়ে এমন সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, সুদ তো ব্যবসায়ীদের একমাত্র ব্যয় নয়। সুদ ছাড়াও তো আরো অনেক ব্যয় আছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পরিবহন ব্যয়ও আছে। ছয়-নয় সুদের এ ভুল সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে যার সময় এসেছে এগুলো শোধরানোর । প্রস্তাবিত মুদ্রানীতিতে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন এনে খেলাপি ঋণের অংক কমানোর বিষয়টি উল্লেখ হয়নি এবং দীর্ঘ মেয়াদে সবার জন্য এক অংকের সুদ নিশ্চিতের ব্যবস্থা থাকা দরকার ছিল। এ ছাড়াও প্র¯াÍবিত মুদ্রানীতিতে পুঁজি বাজার থেকে মূলধন সংগ্রহকে উৎসাহিত করার কোন প্রণোদনা দেখা যায়না । তার অর্থ এই দাড়ায় যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার গতানুগতিক ধারা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারছে না যার জন্য নীতি গত গবেষণার প্রয়োজন। কারণ কেবলমাত্র নীতি ঘোষনাই যথেষ্ট নয়, তার সফল বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে তার উৎকর্ষতা।। আর্থিক খাতের সংস্কার ও তাকে পুনরুজ্জীবিত করা (ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও পুঁজিবাজার) এবং আর্থিক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যাংকগুলোর ভূমিকার ক্ষেত্রে আর্থিক বহির্ভূত উদ্যোগ ও অধিক উদ্ভাবনমূলক আর্থিক পণ্য যেমন তহবিল, উপাদান, বিপণনযোগ্য সিকিউরিটিজকে কার্যকর করে তোলার সময় এসেছে ও এর সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থাপনারও উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সর্বশেষ অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ক্ষেত্রে কভিড-১৯-এর প্রভাবের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর দেয়া উচিত। এক্ষেত্রে বিদ্যমান অসমতা দূর করা উচিত, যা শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দেয়ার ফলে তৈরি হয়েছে। তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা, কৃষক এবং প্রান্তিক জনগণের অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ বৃদ্ধির জন্যও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ
সারাবাংলা/এসবিডিই
ড. মিহির কুমার রায় নতুন মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মুক্তমত