Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সোভিয়েত বিপ্লবের মহানায়ক লেনিন আজও প্রাসঙ্গিক

সৈয়দ আমিরুজ্জামান
২১ জানুয়ারি ২০২৪ ১৭:৩০

লেনিন ভেঙেছে রুশে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,
অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন প্রথম প্রতিবাদ।

আজকেও রুশিয়ার গ্রামে ও নগরে
হাজার লেনিন যুদ্ধ করে,
মুক্তির সীমান্ত ঘিরে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে।

বিদ্যুৎ-ইশারা চোখে, আজকেও অযুত লেনিন
ক্রমশ সংক্ষিপ্ত করে বিশ্বব্যাপী প্রতীক্ষিত দিন,
বিপর্যস্ত ধনতন্ত্র, কণ্ঠরুদ্ধ, বুকে আর্তনাদ;
–আসে শত্রুজয়ের সংবাদ।

সযত্ন মুখোশধরী ধনিকেরও বন্ধ আস্ফালন,
কাঁপে হৃৎযন্ত্র তার, চোখে মুখে চিহ্নিত মরণ।

বিপ্লব হয়েছে শুরু, পদানত জনতার ব্যগ্র গাত্রোত্থানে,
দেশে দেশে বিস্ফোরণ অতর্কিতে অগ্ন্যুৎপাত হানে।

দিকে দিকে কোণে কোণে লেনিনের পদধ্বনি
আজো যায় শোনা,
দলিত হাজার কণ্ঠে বিপ্লবের আজো সম্বর্ধনা।

পৃথিবীর প্রতি ঘরে ঘরে,
লেনিন সমৃদ্ধ হয় সম্ভাবিত উর্বর জঠরে।

আশ্চর্য উদ্দাম বেগে বিপ্লবের প্রত্যেক আকাশে
লেনিনের সূর্যদীপ্তি রক্তের তরঙ্গে ভেসে আসে;
ইতালী, জার্মান, জাপান, ইংলন্ড, আমেরিকা, চীন,
যেখানে মুক্তির যুদ্ধ সেখানেই কমরেড লেনিন।

অন্ধকার ভারতবর্ষ: বুভুক্ষায় পথে মৃতদেহ
অনৈক্যের চোরাবালি; পরস্পর অযথা সন্দেহ;
দরজায় চিহ্নিত নিত্য শত্রুর উদ্ধত পদাঘাত,
অদৃষ্ট র্ভৎসনা-ক্লান্ত কাটে দিন, বিমর্ষ রাত
বিদেশী শৃঙ্খলে পিষ্ট, শ্বাস তার ক্রমাগত ক্ষীণ-
এখানেও আয়োজন পূর্ণ করে নিঃশব্দে লেনিন।

লেনিন ভেঙেছে বিশ্বে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,
অন্যায়ের মুখোমুখি লেনিন জানায় প্রতিবাদ।

মৃত্যুর সমুদ্র শেষ; পালে লাগে উদ্দাম বাতাস
মুক্তির শ্যামল তীর চোখে পড়ে, আন্দোলিত ঘাস।

লেনিন ভুমিষ্ঠ রক্তে, ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ,
বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই লেনিন।
– (লেনিন, সুকান্ত ভট্টাচার্য)

বিজ্ঞাপন

মহান সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লবের মহানায়ক, বিশ্বের শ্রমিকশ্রেণির দিশারী মহামতি কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের শততম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি মস্কোতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

কমিউনিস্ট মতাদর্শের শ্রমিক শ্রেণীর অার্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কমরেড লেনিন আজও প্রাসঙ্গিক ও অপরিহার্য। মহান মার্কসবাদী কিংবদন্তী এই বিপ্লবী নেতার মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন!।

২২ এপ্রিল হলো কমরেড লেনিনের জন্মদিন। এই দিনটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণ লেনিন দিবস হিশেবে পালন করে থাকে।

১৮৭০ সালের ২২ এপ্রিল কমরেড লেনিন রাশিয়ার ভলগা নদীর তীরবর্তী সিমবিস্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি মস্কোতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশাস্ত্রের উপর লেখাপড়া করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সময়েই তিনি জার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। এই ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কারণে জার সরকার তাকে সাইবেরিয়াতে নির্বাসনে পাঠায়। লেনিন যে সময়ে রাশিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন সেই সময়ে রাশিয়ায় নৈরাজ্যবাদী বাকুনিনপন্থীদের ব্যাপক প্রভাব ছিল। এই বাকুনিনপন্থীরা ব্যক্তি সন্ত্রাসে বিশ্বাস করতো। তাদের ধারণা ছিল রাশিয়ার জনগণের সমগ্র দুর্দশার জন্য দায়ী হলো রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিচালনায় নিযুক্ত মুষ্টিমেয় কয়েকজন শীর্ষ কর্তা ব্যক্তি। তাই এই শীর্ষ কর্তাদের যে কোন পন্থায় অপসারণ করতে পারলেই জনগণের মুক্তির লড়াইয়ে বিজয় অর্জিত হবে। সেই প্রেক্ষিতেই তারা রাশিয়ার জারকে খুন করে। আর এই খুনের দায়ে লেনিনের বড় ভাইয়ের ফাঁসি হয়। কমরেড লেনিন সেই থেকে শিক্ষা নিয়ে নৈরাজ্যবাদ, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে মার্কসবাদের পথ অনুসরণ করেন এবং রুশ দেশে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে অক্টোবর বিপ্লব সম্পন্ন করে পৃথিবীর বুকে প্রথম শোষণমুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্ররূপ সোভিয়েতে রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেন। তিনি শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রেণী সংগ্রামের বিকাশের গতিধারায় বিপ্লবী সংগ্রামের ভিতর দিয়ে পশ্চাৎপদ সমাজ ব্যবস্থা তথা জারতন্ত্রের উচ্ছেদ করে শ্রমিক শ্রেণীসহ অন্যান্য শোষিত জনগণের মুক্তির সংগ্রামকে অগ্রসর করতে ব্রতী হন।

বিজ্ঞাপন

মানব জাতির ইতিহাসে উৎপাদন শক্তি বিকাশের প্রক্রিয়ায় আদিম সাম্যবাদী সমাজের ভাঙনের পর সৃষ্টি হয় শ্রেণী বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র। এই শ্রেণী বিভক্ত সমাজ সৃষ্টির সাথে সাথে সমাজে দেখা দেয় শ্রেণী শোষণ ও শ্রেণী সংগ্রাম। শোষিত নিপীড়িত শ্রেণী তার ওপর চেপে বসা শোষণ থেকে মুক্তির জন্য শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ ঘোষণা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। কিন্তু শোষিত জনগণ শ্রেণী শোষণ থেকে মুক্তি অর্জন করতে পারেনি। ইতিহাসের গতিধারায় বুর্জোয়া ব্যবস্থা বিকাশের সাথে সাথে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিপরীতে শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। বুর্জোয়া শ্রেণী বিভিন্ন দেশে সামন্তদের হটিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে। সৃষ্টি হয় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার। বুর্জোয়া ব্যবস্থার যত বিকাশ ঘটতে থাকে শ্রমিক শ্রেণীরও ততই বিকাশ ঘটে। বুর্জোয়া শ্রেণীর বিপরীতে শ্রমিক শ্রেণী ছাড়া বুর্জোয়া ব্যবস্থা তার অস্তিত্বের শর্ত হারায়। বুর্জোয়া ব্যবস্থায় গোটা উৎপাদন প্রক্রিয়া হলো সামাজিক, কিন্তু মালিকানা হলো ব্যক্তিগত। বুর্জোয়া ব্যবস্থায় জমি, বাড়ি, কলকারখানা সকল সম্পদের মালিক হচ্ছে বুর্জোয়া শ্রেণী। কিন্তু তারা উৎপাদন করে না, উৎপাদনের কাজ চালায় হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণী। কিন্তু এই উৎপাদিত সামগ্রির মালিক হয় বুর্জোয়া শ্রেণী। ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিপরীত শ্রেণী হিসাবে শ্রমিক শ্রেণী আবির্ভূত হয়। শ্রমিক শ্রেণী এমন একটি শ্রেণী যা বুর্জোয়া সমাজের কবর খননকারী। কিন্তু বুর্জোয়া সমাজে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিপরীত শ্রেণী শ্রমিক শ্রেণীর অস্তিত্ব ছাড়া বুর্জোয়া উৎপাদন ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না। পুঁজিবাদী সমাজে এই পরস্পর বিরোধী স্বার্থযুক্ত দুই শ্রেণীর মধ্যে শুরু হয় তীব্র শ্রেণী সংগ্রাম।

মার্কসবাদের তিনটি অপরিহার্য অংশ হলো (১) মার্কসীয় দর্শন- দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ; (২) সর্বহারা শ্রেণীর শ্রেণী সংগ্রামের মতবাদ; (৩) রাজনৈতিক অর্থনীতি। তৎকালীন ইউরোপের সবচেয়ে অগ্রসর তিনটি দিক জার্মান দর্শন, ফ্রান্সের শ্রেণী সংগ্রাম ও ইংল্যান্ডের বিকাশমান বুর্জোয়া অর্থশাস্ত্রের সারসঙ্কলন করে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন মার্কসবাদ। বুর্জোয়া ব্যবস্থার এই বিকাশের যুগে শ্রমিক শ্রেণীর শ্রেণী সংগ্রামের মতবাদ প্রচার করেন মহান মনীষী কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস। মহান মনীষী মার্কস দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের আবিষ্কারক। দর্শনের ক্ষেত্রে তিনি হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি ও ফয়েরবাখের বস্তুবাদকে গ্রহণ করে সৃষ্টি করে বিশ্বের বুকে সম্পূর্ণ নতুন দর্শন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। মার্কস ও এঙ্গেলস হেগেলের দ্বান্দ্বিকতার যুক্তিসঙ্গত সারভাগ গ্রহণ করেন এবং ভাববাদী জঞ্জাল বর্জন করেন। সেই সাথে ফয়েরবাখের বস্তুবাদের অন্তর্নিহিত সারভাগ গ্রহণ করেন এবং বর্জন করেন তার অধিবিদ্যক পদ্ধতিকে। মার্কস ও এঙ্গেলস ফয়েরবাখের বস্তুবাদী ভিত্তি এবং হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে উন্নত করে সমন্বিত করে এক গুণগত উন্নয়ন ঘটিয়ে সৃষ্টি করেন সর্বহারা শ্রেণীর মুক্তির দর্শন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। মহান মনীষী মার্কস দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের আলোকে সমাজ ব্যবস্থার বিবর্তনের ধারা বিশ্লেষণ করে দেখান যে, সভ্যতার ইতিহাস হলো শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। মহামনীষী মার্কস পুঁজিবাদী শোষণের মর্মবস্তুকে আবিষ্কার করেন। তিনি আবিষ্কার করেন উদ্বৃত্তের মূল্যতত্ত্ব। মহামনীষী মার্কস তার অবদান সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে ১৮৫২ সালের ৫ মার্চ লন্ডন থেকে ইয়ো. ভেইদেমেয়ারের কাছে লিখিত এক চিঠিতে তিনি নিজেই বলেছেন, “এখন আমার প্রসঙ্গে ধরলে, বর্তমান সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্ব আবিষ্কারের বা তার মধ্যে সংগ্রাম আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমার নয়। আমার বহু পূর্বে বুর্জোয়া ঐতিহাসিকেরা এই শ্রেণী সংগ্রামের ঐতিহাসিক বিকাশের ধারা এবং বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদেরা বিভিন্ন শ্রেণীর অর্থনৈতিক শরীরস্থান বর্ণনা করেছেন। আমি নতুন যা করেছি তা হচ্ছে এইটা প্রমাণ করা যে, (১) উৎপাদন বিকাশের বিশেষ ঐতিহাসিক স্তরের সঙ্গেই শুধু শ্রেণীসমূহের অস্তিত্ব জড়িত; (২) শ্রেণী সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে প্রলেতারীয় একনায়কত্ব; (৩) এই একনায়কত্বটা সমস্ত শ্রেণীর বিলুপ্তি ও শ্রেণীহীন সমাজে উত্তরণের পর্যায় মাত্র।” [মার্কস এঙ্গেলস রচনা সঙ্কলন- দ্বিতীয় খন্ড, দ্বিতীয় অংশ, পাতা ১৩৮, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো]।

লেনিন শুধু মার্কস এঙ্গেলসের শিক্ষাকে কার্যকরী করেননি। তিনি ছিলেন এই শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষাকারী। তিনি সাম্রাজ্যবাদী যুগে বিকাশের নতুন পর্যায়ের সাথে, পুঁজিবাদের নতুন পর্যায়ের সাথে মার্কস ও এঙ্গেলসের শিক্ষাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে একে আরও বিকশিত করেন। এর অর্থ হলো শ্রেণী সংগ্রামের নতুন অবস্থাধীনে মার্কসবাদকে আরও বিকশিত করতে গিয়ে পুঁজিবাদের বিকাশের যুগে মার্কস ও এঙ্গেলস কর্তৃক যা সৃষ্ট হয়েছিল তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগে মার্কসবাদের জ্ঞানভান্ডারে নতুন নতুন অবদান যুক্ত করেন।

মার্কস ও এঙ্গেলস তাদের মতবাদ প্রচার করেন প্রাক সাম্রাজ্যবাদের যুগে, পুঁজিবাদের বিকাশের যুগে। যখন পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের যুগে প্রবেশ করেনি। অর্থাৎ বিকশিত সাম্রাজ্যবাদের যখন জন্ম হয়নি, শ্রমিক শ্রেণী যখন বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, শ্রমিক বিপ্লব যখন কার্যক্ষেত্রে আশু ও অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠেনি সেই প্রাক বিপ্লব যুগে মার্কস ও এঙ্গেলস তাদের কার্যকলাপ চালান। মার্কস ও এঙ্গেলসের সুযোগ্য শিষ্য লেনিন তার কাজ চালিয়েছেন বিকশিত সাম্রাজ্যবাদের যুগে, শ্রমিক বিপ্লব যখন আশু করণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস যখন শ্রেণী সংগ্রামের মতবাদ প্রচার করেন, তখন বিশ্বব্যাপী শ্রমিক শ্রেণীর সাথে বুর্জোয়া শ্রেণীর দ্বন্দ্বই ছিল মৌলিক দ্বন্দ্ব। আর লেনিন যখন তার কার্যকলাপ চালান তখন পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী যুগে প্রবেশ করেছে। পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী যুগে প্রবেশের সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী তিনটি মৌলিক দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল হয়। (ক) পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশে বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব; (খ) ঔপনিবেশিক দেশের নিপীড়িত জাতি ও জনগণের সাথে সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব; (গ) এক সাম্রাজ্যবাদী দেশের সাথে আর এক সাম্রাজ্যবাদী দেশের দ্বন্দ্ব। কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি ১৯১৭ সালে রুশ দেশে শ্রমিক বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল ও সাম্যবাদের লক্ষ্যে শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার পর আরও একটি মৌলিক দ্বন্দ্ব যুক্ত হয়। তা হলো (ঘ) সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব। আবার ১৯৯১ সালে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বব্যাপী কোন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র না থাকায় সমাজতন্ত্রের সাথে পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব- এই দ্বন্দ্বের কোন অস্তিত্ব বর্তমানে নেই।

মার্কসবাদ- লেনিনবাদের অন্যতম অনুসারি কমরেড স্তালিন লেনিনবাদের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘লেনিনবাদ হলো সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগের মার্কসবাদ। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, লেনিনবাদ হলো সাধারণভাবে শ্রমিক বিপ্লবের মতবাদ ও রণকৌশল এবং বিশেষভাবে এ হলো শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের মতবাদ ও রণকৌশল। বিকশিত সাম্রাজ্যবাদের যখন জন্ম হয়নি, সর্বহারা শ্রেণী যখন বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে শ্রমিক বিপ্লব যখন কার্যক্ষেত্রে আশু এবং অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠেনি সেই প্রাক বিপ্লব যুগে (এখানে আমরা শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের কথাই বলছি) মার্কস আর এঙ্গেলস তাদের কার্যকলাপ চালাতেন। আর মার্কস-এঙ্গেলসের শিষ্য লেনিন তাঁর কাজ চালিয়েছেন বিকশিত সাম্রাজ্যবাদের যুগে, শ্রমিক বিপ্লবের বিকাশের যুগে- যখন শ্রমিক বিপ্লব একটি দেশে ইতিমধ্যে জয়যুক্ত হয়েছে, বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে চূর্ণ করে, শ্রমিক শ্রেণীর গণতন্ত্রের সোভিয়েততন্ত্রের যুগের সূত্রপাত করেছে। এই কারণেই লেনিনবাদ হলো মার্কসবাদের আরও বিকশিত রূপ।’ [লেনিনবাদের ভিত্তি- কমরেড স্তালিন]।

মার্কস ও এঙ্গেলস প্রাক সাম্রাজ্যবাদের যুগে পুঁজি গ্রন্থে পুঁজিবাদের মূল ভিত্তিগুলোর বিশ্লেষণ প্রদান করেন। আর কমরেড লেনিন পুঁজি গ্রন্থের মূল নীতিমালার ভিত্তিতে পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর সাম্রাজ্যবাদ গ্রন্থে- সাম্রাজ্যবাদের এক মার্কসবাদী বিশ্লেষণ উপস্থিত করেন। কমরেড লেনিন সাম্রাজ্যবাদকে সংজ্ঞায়িত করেন। কমরেড লেনিন বলেন যে, পুঁজিতন্ত্রের একচেটিয়া স্তরই হলো সাম্রাজ্যবাদ।’ তিনি সাম্রাজ্যবাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদের ৩টি চরিত্র ও ৫টি বৈশিষ্ঠ্য আলোচনা করেন। তাঁর আলোচিত সাম্রাজ্যবাদের এই ৩টি চরিত্র হলো (১) সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে একচেটিয়া পুঁজিবাদ; (২) সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে ক্ষয়িষ্ণু বা পরজীবী পুঁজিবাদ; (৩) সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে মুমূর্ষু বা মৃতপ্রায় পুঁজিবাদ। লেনিন সাম্রাজ্যবাদের ৫টি মূলগত বৈশিষ্ঠ্য তুলে ধরেন। এই বৈশিষ্ঠ্যগুলি হলো- (১) উৎপাদন ও মূলধনের কেন্দ্রীভবন এমন উঁচু স্তরে উন্নীত হয়েছে যে, তা থেকে একচেটিয়া কারবারের উদ্ভব ঘটেছে আর এই সমস্ত একচেটিয়া কারবারই অর্থনৈতিক জীবনের অধিনিয়ন্তার ভূমিকা গ্রহণ করেছে; (২) ব্যাঙ্ক পুঁজির সাথে শিল্প পুঁজির সহমিলন ঘটেছে আর এই মহাজনি মূলধনের ভিত্তিতে মহাজনি মোড়লতন্ত্রের অভ্যুদয় ঘটেছে; (৩) পণ্য রপ্তানি থেকে স্বতন্ত্র যে মূলধন রপ্তানি তা অসাধারণ গুরুত্ব অর্জন করেছে; (৪) আন্তর্জাতিক একচেটিয়া পুঁজিবাদী সমাহারের আবির্ভাব ঘটেছে। আর এই সমস্ত সমাহার পৃথিবীকে নিজেদের মধ্যে বেঁটে নিতে শুরু করেছে; (৫) বৃহত্তম পুঁজিতান্ত্রিক শক্তিবর্গের মধ্যে সমগ্র বিশ্বের ভূখন্ড ভাগবাঁটোয়ারা পরিসমাপ্ত হয়েছে।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার মার্কসীয় মৌলিক ভাবনার বাস্তবে রূপায়ন করেন। এক্ষেত্রে মার্কসবাদের জ্ঞান ভান্ডারে লেনিনের নতুন অবদান হলো- (১) তিনি সোভিয়েত ব্যবস্থাকে সর্বহারা শ্রেণীর শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রীয় রূপ হিসাবে আবিষ্কার করেন। এপ্রেক্ষিতে তিনি প্যারি কমিউন ও রুশ বিপ্লবের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান। (২) তিনি সর্বহারা শ্রেণীর মিত্রের সমস্যার দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের ব্যাখ্যা প্রদান করেন। সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বকে সংজ্ঞায়িত করেন পরিচালক হিসাবে সর্বহারা শ্রেণী আর পরিচালিত হিসাবে অসর্বহারা শ্রেণীসমূহের শোষিত জনগণের মধ্যেকার শ্রেণী মৈত্রীর বিশেষ রূপ হিসাবে। (৩) তিনি এই বাস্তব ঘটনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন যে, সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব হলো শ্রেণী বিভক্ত সমাজে গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ রূপ। সর্বহারা গণতন্ত্রের এই রূপ পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থকেই অভিব্যক্ত করে।

তিনি প্রমাণ করেন, পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী পরিবেষ্টিত একটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে সাফল্যের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক বির্নিমাণ ও শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রযাত্রা সম্ভব। মার্কসবাদের মৌলিক নীতিমালার ভিত্তিতে তিনি সোভিয়েত রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে বিশেষ সাফল্য স্থাপন করেন। এক্ষেত্রে মার্কসবাদের জ্ঞানভান্ডারে তার নতুন অবদান হলো- (১) তিনি প্রমাণ করেন যে, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক পরিবেষ্টিত সর্বহারা একনায়কত্বাধীন একটি দেশে পরিপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। (২) তিনি আবিষ্কার করেন অর্থনীতির কর্মনীতির সুনির্দিষ্ট গাইডগুলো, যার দ্বারা সর্বহারা শ্রেণী অর্থনীতির মূল অবস্থানগুলোর অধিকারী হওয়ার সুবাদে সমাজতান্ত্রিক শিল্পকে কৃষির সাথে সংযুক্ত করে সমগ্র জাতীয় অর্থনীতি সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে পরিচালিত হতে পারে। (৩) তিনি আবিষ্কার করেন সমবায়ের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মানের গতিপথে কৃষক সমাজের মূল অংশকে ক্রমান্বয়ে পরিচালনা করার ও টেনে নিয়ে আসার সুনির্দিষ্ট পন্থার, যে সমবায় হলো সর্বহারা একনায়কত্বের হাতে ক্ষুদে কৃষক অর্থনীতির রূপান্তর সাধনের ও সমাজতন্ত্রের ভাবধারায় কৃষক সমাজের মূল অংশকে পুনর্শিক্ষিত করে গড়ে তোলার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার।

তিনি মার্কস-এঙ্গেলসের মৌলিক গাইড লাইনের আলোকে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার অবসান ও সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা নিপীড়িত জাতি ও জনগণের জাতীয় মুক্তি অর্জনের আকাঙ্খা বাস্তবায়নের সমস্যার সমাধান করেন। এই ক্ষেত্রে মার্কসবাদী জ্ঞানভান্ডারে তার নতুন অবদান হলো- (১) লেনিন সাম্রাজ্যবাদের যুগে জাতীয় ও ঔপনিবেশিক বিপ্লব সম্পর্কিত ধারণাগুলোকে একটি একক সামঞ্জস্যপূর্ণ পদ্ধতির মতামতে একত্রীভূত করেন। (২) তিনি জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্নকে সাম্রাজ্যবাদ উচ্ছেদের প্রশ্নের সাথে সম্পর্কযুক্ত করেন। (৩) তিনি জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্নকে আন্তর্জাতিক সর্বহারা বিপ্লবের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ঘোষণা করেন।

লেনিনের এই সব গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে ধারণ করে আজও বিশ্বের দেশে দেশে সংগ্রামী শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণ শ্রেণী সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে অগ্রসর করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। লেনিনবাদ বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণী ও নিপীড়িত জাতি জনগণের মুক্তির সংগ্রামে পথ নির্দেশিকা হিসাবে কাজ করে চলেছে। পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে সমাজতন্ত্র তথা সর্বহারা একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই ও নয়া ঔপনিবেশিক দেশের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তির লড়াই এক ও অভিন্ন লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক তথা সামগ্রিক সঙ্কটের উদ্ভব ঘটেছে বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণ তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার দুর্বলতম গ্রন্থী ছিন্ন করার ফল হিসাবে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশের শ্রমিক শ্রেণী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও নয়া ঔপনিবেশিক দেশের শ্রমিক শ্রেণী এবং জনগণ সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই কাজে শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণ তখনই সাফল্য অর্জন করতে পারবে যখন লেনিনবাদের মৌলিক অবদানসমূহকে ধারণ করে তা সাফল্যের সাথে প্রয়োগ করতে পারবে। বিশ্বের দেশে দেশে কমিউনিস্ট মতাদর্শে শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণ আজ সেই মহান বিপ্লবী ব্রত পালনের লক্ষ্যেই অগ্রসর হচ্ছে।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

মুক্তমত সৈয়দ আমিরুজ্জামান সোভিয়েত বিপ্লবের মহানায়ক লেনিন আজও প্রাসঙ্গিক

বিজ্ঞাপন

ইত্যাদি এবার মোংলায়
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ১৯:৩৪

বরবাদের আইটেম গানে নুসরাত
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ১৯:২৬

আরো

সম্পর্কিত খবর