গ্যাসের কৃত্রিম সংকটের শেষ কোথায়
২১ জানুয়ারি ২০২৪ ১৮:২৩
জ্বালানি তেল ও গ্যাস শিল্প প্রতিষ্ঠানের অন্যতম উপাদান। একটির সংকট দেখা দিলে শিল্প প্রতিষ্ঠানে স্থবিরতা নেমে আসে, উৎপাদন ব্যাহত হয় ফলে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয় শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের। এই ক’দিন দেশ জুড়ে গ্যাসের যে চিত্র শুধু শিল্প প্রতিষ্ঠান নয় দেশের অধিকাংশ স্থানে রান্নার চুলাও জ্বলছে না। রান্না-বান্না হচ্ছে না। শুকনো খাবার খেয়ে দিন পাড় করতে হয়েছে। এ অবস্থায় গ্রাহকরা চায় সংকট নয়, চায় স্থায়ী সমাধান।
দেশের বিভিন্ন দৈনিক প্রত্রিকা প্রকাশিত সংবাদ মাধ্যমের বরাতে জানতে পারি বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়নগঞ্জে গ্যাস স্বল্পতায় অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাজ বন্ধ করে দিতে হয়েছে। শিল্প প্রতিষ্ঠান হচ্ছে দেশের অন্যতম চালিকা শক্তি এটিকে সচল রাখার জন্য যেকোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। গ্যাসসহ অন্যান্য সেক্টর থেকে যে কোনো ধরনের দূর্নীতি চিরতরে নিমূর্ল করতে হবে। সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদ থেকে অবসর নেওয়া কর্মকর্তা অসীম বড়ুয়াকে দীর্ঘ তিন ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে সকালে চা পরোটা সংগ্রহ করতে গিয়ে রীতিমতো হিমসিম খেতে হয়েছে। আর সাড়ে তিন ঘন্টা পর ইনসুর্যান্স কর্মককর্তা বিমল বড়ুয়া ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আরমান আহমেদ নানরুটি হাতে পেয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সৌভাগ্যবান মনে করছেন। গত ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামসহ দেশ জুড়ে গ্যাস বিপর্যয়ের কারণে মারাত্মকভাবে ভুগতে হয়েছে মানুষদের। এমনকি খাবার না পেয়ে অনেক পরিবারকে অভুক্ত কাটাতে হয়েছে। আবার দুপুর বেলায় ভাত তরকারি কিনতে গিয়ে দোকানিদের উচ্চমুল্যের বিরম্বনায় নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে ক্রেতাদের। আবার এ ও দেখা গেছে টাকা দিয়েও ভাত তরকারি কিনতে না পেরে শুকনো খাবার খই, মুড়ি, বিস্কুট, পাউরুটি খেয়ে দিন পাড় করতে। কেউ কেউ কেরোসিন কেনার জন্যও হন্যে হয়ে ঘুড়ছে শত শত দোকানে। সীমাহীন উচ্চ মূল্যে কেরোসিন সংগ্রহ করার পর স্টোবে রান্না করেছে, কেউ কেউ বাড়ির ছাদে ইট দিয়ে লাকরির চুলা বানিয়ে রান্না-বান্নার কাজ শেষ করেছে। গ্যাস সিলিন্ডার কিনতে গিয়ে নাকানিচুবানি খেতে হয়েছে।
গ্যাস দিয়ে চালিত পরিবহণের সংখ্যাও ছিল একবারে নুন্যতম। প্রায় ৮০ শতাংশ গাড়ি গ্যাস কিনতে না পেরে দিনের পুরোসময় বন্ধ রাখতে হয়েছে। আর আল্প সংখ্যক যে গাড়িগুলো চলেছে ভাড়ার সংখ্যায় ছিল দ্বিগুন-তিনগুন।
বিগত অনেকদিন যাবৎ চট্টগ্রামে গ্যাস এই আসে এই যায় এরকম অবস্থায় থাকলেও ১৯ জানুয়ারির মত গ্যাস বিপর্যয় আর কোনো দিন দেখেনি চট্টগ্রামবাসী। ২৪ ঘন্টায় মানুষরা যে কী পরিমান অস্বস্তিকর অবস্থায় দিন পার করেছে একমাত্র ভুক্তিভভুগীরা ব্যতীত অন্যরা উপলব্দি করতে পারবে না। যদিও বা সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রী নসরুল হামিদ গ্যাসের ব্যাপারে কিছুটা দুঃসংবাদ দিলেও কিন্তু এই দুঃখটা যে এত সহসা ঘনিয়ে আসবে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। রাস্তা-ঘাট, দোকানপাট, অলিগলি দিয়ে হাঁটার পথে দেখেছি দু’চার জন মিলিত হলেই যে কথাটা এখন হর হামেশা শোনা যাচ্ছে সেটি হল ‘কৃত্রিম সংকট’। চাল, ডাল, তেল, লবন, পিয়াজ, শুকনো খাবার থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, সবজির বাজারও যখন সিন্ডিকেটের হাতে চলে যায় তখন গ্যাসও যে একই পথের পথিক হবে না এ আস্থা রাখে কি করে। পুরো দেশটাকে যখন এই কৃত্রিমের কবলে পড়তে হয় তাহলে এই সংকট থেকে উদ্ধারে ভুমিকা দেখিনা কেন? খাদ্য মন্ত্রী বললেন, চালের দাম যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে যারা বাড়িয়েছে, সেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে কমাতে। কিন্তু কই, এর তো কোন রকম বাস্তবায়ন দেখলাম না। বরঞ্চ আরো বাড়তে শুরু করেছে। তাহলে এই জাতীয় কথায় বুঝা যাচ্ছে বাংলার জনগণ এখন শুধুমাত্র আশাতেই থাকা ছাড়া এর থেকে বের হওয়ার পথ খোলা নেই। কথার পর ও যখন কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না টিসিবি থেকে কার্ডধারীদের জন্য কিছুটা সুযোগ করে দিল সরকার। কার্ড তো পেয়েছে এক শ্রেণির কিছু মানুষ, আবার তাদের ভাগ বসিয়েছে কিছু সুযোগ সন্ধানি প্রতারক চক্র। স্থানীয় কাউন্সিলরের সাথে যোগ সাজশে অকার্ডধারীরাও বস্তায় বস্তায় চাল, ডাল, তেল নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য ব্যথিত করে। এরকম চিত্র চট্টগ্রামের চেরাগি পাহাড় এলাকায় যেমন দেখেছি অন্যান্য স্থানেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। আবার যারা পাওয়ার যোগ্য তারা পাচ্ছে না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকে আছে তারা কোনোভাবে হাত পাততে পারছে না, তাদের পকেটে টাকা নেই প্রয়োজনের তুলনায় অল্পস্বল্প খাদ্য পন্য কিনে পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে হচ্ছে। খাদ্য পন্য বিতরণের ক্ষেত্রে যে ধরণের এখন বৈষম্য তৈরি হচ্ছে অনেকেই বলছেন একদেশে দুই আইন চলতে পারে না। সবার জন্য খাদ্য পণ্য বিক্রির নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা আশু জরুরি। নতুন সরকারকে শিক্ষা ও খাদ্য পন্যকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এর জন্য যতটুকু চ্যালেঞ্জের প্রয়োজন হোক তার থেকে চুল পরিমানও ছাড় দেয়া যাবে না। মানুষ এখন একটু স্বস্তিতে বাঁচতে চায়। দেশের অধিকাংশ মানুষ পলিটিক্স বুঝেনা। তারা শুধু চায় দু’বেলা দু’মুঠো ভাত আর শান্তিতে থাকার নিশ্চয়তা।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, গ্যাসের নতুন যে রেট, তা দিয়ে ব্যবসায়ীরা ভুগতেছে। নতুন সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, সরকার ব্যবসাবান্ধব হবে। ব্যবসাবান্ধব সরকার ব্যবসায়ীদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধান করবে।
বাংলাদেশ নিটওয়ার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, যখন গ্যাসের মূল্য বাড়ানো হলো তখন কিন্তু বলা হয়েছে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস দেয়া হবে। তিনি বলেন, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি হলো ঠিকই কিন্তু গ্যাসের সমস্যার সমাধান হলো না।
২০৪০ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ের যে ভিশন সরকার গ্রহণ করেছে এই প্রত্যয়কে আমি ধন্যবাদ জানাই তবে তার আগে সরকারকে যেসব ধাপ অতিক্রম করতে হবে তার মধ্যে প্রথম অন্তরায় হচ্ছে দুর্নীতি। এই দুর্নীতির শেকড় উৎপাটন করা না গেলে দেশ অগ্রগামীতা থেকে পিছয়ে পড়বে। তাই স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষে সরকারি-বেসরকারি দেশের সকল প্রতিষ্ঠানের সামনে দুর্নীতি বিরোধী বিষয়ে সাইনবোর্ড, ব্যানার, ফেষ্টুন লাগিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে যে ভূমিকা পালন করেছে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সম্মান উজ্জল হয়েছে, সেভাবে বিশ্ববাসীর সামনে বাংলাদেশকে একটি উঁচুমাত্রায় নিয়ে যাবেন বলে জনগণের বিপুল প্রত্যাশা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই