ইসরাইল কিভাবে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে উঠছে
২২ জানুয়ারি ২০২৪ ১৫:৪৫
আমরা সবাই জানি বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় সাড়ে ছয় গুণ ছোট ইসরাইল অত্যন্ত ক্ষমতাধর একটি দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে অবস্থান করছে। তবে তাদেরও এক সময় বেশ কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। ইসরাইলের অর্থনৈতিক অবস্থার উত্থান নিয়েই থাকবে আজকের আলোচনা।
১৯৮৫ সালে ইসরাইলের ঋণ-জিডিপি হার ছিল ১৫৭ শতাংশ আর ১৯৮৪ সালে তাদের মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৪৫০ শতাংশ। ১৯৮৫ সালে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সরকারের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়, যার প্রেক্ষাপটে প্রথম ধাপে দেদারসে টাকা ছাপানো বন্ধ করে এবং ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রা শেকেলের অবনমন ঘটিয়ে মুদ্রাস্ফীতিকে ১৯৮৬ সালে ২৩ শতাংশে নামিয়ে নিয়ে আসে। ফলে ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে জনপ্রতি জিডিপি বৃদ্ধি পায় প্রায় ২১ শতাংশ। ১৯৮৬ সালে যে ইসরাইলের জনপ্রতি জিডিপি ছিল ৮ হাজার ডলারের মতো, সেই ইসরাইলের জনপ্রতি জিডিপি ২০২২ সালে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৫৫ হাজার ডলারের কাছাকাছি।
১৯৯৩ সালে তারা বেসরকারি খাতে মূলধন জোগাড় করার জন্য ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের ১২ মিলিয়ন ডলার যোগাড় করার বিপরীতে সরকার থেকে আরও ৮ মিলিয়ন ডলার যোগান দিত; অর্থাৎ, ৪০ শতাংশ ইকুইটি সরকার প্রদান করত। পরবর্তীতে সেটা ইসরাইলের বিভিন্ন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হতো এবং সরকারের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে মুনাফা বুঝে নেওয়ার পাশাপাশি ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টরা সরকারের দেওয়া ৪০ শতাংশ ইকুইটি তাদের বিনিয়োগ থেকে অর্জিত লাভ থেকে সরকারের কাছ থেকে কিনে নিত। আর এভাবেই তারা তাদের ঘরোয়া স্টার্টআপ এবং টেক কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করতে থাকে এবং পরবর্তীতে প্রচুর পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগও আসতে শুরু করে। বর্তমানে ইসরাইলে ৭০টি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি রয়েছে, যার মধ্যে ১৪টি বিদেশি কোম্পানি।
বিভিন্ন বিদেশি বিনিয়োগ তারা রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের কাজে ব্যবহার করেছে। ১৯৯৬ সালে দেখা গেছে, তারা তাদের জিডিপির প্রায় ২.৬ শতাংশ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট খাতে ব্যয় করেছে, অথচ সেই সময় একই খাতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও চীন যথাক্রমে ব্যয় করেছিল মাত্র ২.৪ শতাংশ, ১.৭ শতাংশ এবং ০.৫৭ শতাংশ। আর ২০২১ সালে ইসরাইল এই খাতে তার জিডিপির প্রায় ৫.৬ শতাংশ ব্যয় করে, যা ছিল সারা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে ছিল দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান, যারা ব্যয় করেছিল তাদের জিডিপির ৪.৯ শতাংশ ও ৩.৮ শতাংশ।
ইসরাইল সরকার ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে ‘প্রযুক্তি ইনকিউবেটর প্রোগ্রাম’ প্রতিষ্ঠা করে। এখন সারা দেশে ২৫টিরও বেশি ইনকিউবেটর রয়েছে, যার সবগুলোই বেসরকারিকরণ করা হয়েছে। ইনকিউবেটরগুলোতে দুই বছরের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকল্প ব্যয়ের ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত সরকারি তহবিল সরবরাহ করে বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। এই ইনকিউবেটরগুলো থেকে এখন পর্যন্ত ১,১০০টিরও বেশি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, যার মধ্যে ৪৫ শতাংশ সফলভাবে বিভিন্ন বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত বিনিয়োগ লাভ করতে পেরেছে।
আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই ইসরাইল তাদের সরকারি ব্যয় কমিয়ে আনার অংশ হিসেবে প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয় কমিয়ে আনে ৫-৬ শতাংশে, যেটা আশির দশকে ছিল প্রায় ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করা বিপুল অর্থ তারা শিল্পায়ন বা গবেষণা খাতে সরিয়ে নিয়ে আসে। তারই ধারাবাহিকতায় এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি বিশ্বের সেরা ৫০০টি টেক জায়ান্ট কোম্পানির ৮০টি কোম্পানির গবেষণাগার ইসরাইলে অবস্থিত। মাইক্রোসফট, মটোরোলা, গুগল, অ্যাপল, ফেসবুক, ইন্টেল, এইচপি, সিমেন্স, জিই, আইবিএম, ফিলিপস, লুসেন্ট, সিসকো, ইএমসি, তোশিবা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
আইবিএমের প্রথম পার্সোনাল কম্পিউটারে ইসরাইলের হাইফা গবেষণাগার দ্বারা আবিষ্কৃত ইন্টেলের যে চিপ ১৯৮১ সালে ব্যবহৃত হয় তার ধারাবাহিকতায় আইসি (ইন্টিগ্রেটেড চিপ) খাতে রপ্তানি করে ইসরাইল বর্তমানে আয় করছে প্রায় ৫.০৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে হাইটেক খাতে তাদের রফতানি ছিল সমগ্র মানুফ্যাকচারিং খাতের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। আর সমগ্র বিশ্বের সাইবার সিকিউরিটি রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশও ইসরাইলিদের দখলে রয়েছে। আর হবেই বা না কেন, মাত্র ৯০ লাখের কিছু বেশি জনসংখ্যার দেশটিতে তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত কোম্পানির সংখ্যা প্রায় ২০,০০০টি।
বিদেশি বিনিয়োগ এবং কর রেয়াত দেওয়ার সুযোগ নিয়ে ইসরাইলে বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার স্টার্টআপ কাজ করছে। এক সময় ইসরাইলকে ‘উদ্যোক্তাদের রাজধানী’ হিসেবে ডাকা হতো। শুধু কি তাই, ইসরাইলে সারা বিশ্বের মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী রয়েছে। তাছাড়া ইসরাইলি তরুণদের বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার কারণে প্রযুক্তিগত শিক্ষাগ্রহণ করে উচ্চ দায়িত্ববোধ এবং সাফল্যের অভিযোজন অর্জন করে সৃজনশীল, দক্ষ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী কর্মী বাহিনীতে পরিণত করছে।
সবচেয়ে শিক্ষিত দেশের তালিকায় ইসরাইলের অবস্থান পঞ্চম স্থানে আর মাথাপিছু উচ্চশিক্ষা ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে তারা আছে তৃতীয় স্থানে। উদ্ভাবনী শক্তির দেশ হিসেবে তারা রয়েছে ষষ্ঠ স্থানে। সেই হিসেবে এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কতটুকু শক্তিশালী তা মোটামুটি আন্দাজ করা যায়, কেননা সেখানে গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষার পাশাপাশি বাণিজ্যের (এমবিএ/বিবিএ) বিষয়গুলোতে বিশেষ জোর দেওয়া হয়। সেখানে মাত্র ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও প্রতিটি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি করা যায়। ইসরাইলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক মৌলিক বিষয়গুলো শেখার গুরুত্বের উপর জোর দেয়। তারপরে তাদের বিশেষ ডিগ্রি অর্জন বা আরও উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের বিশেষ সমস্যা সমাধানের মতো প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হয়। এসব প্রতিযোগিতামূলক ধাপ পেরিয়ে অবশেষে তাদের কর্মসংস্থানে নিযুক্ত হতে হয়, সেটা ব্যবসা বা চাকরি যাই হোক না কেন। ব্যবসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম মুনাফা অর্জনমূলক মডেল দাঁড় করাতে পারলে ব্যাংক থেকে বিনা সুদে অথবা কম সুদে মূলধনের ব্যবস্থা করা হয়।
ফল ও কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিতেও ইসরাইল অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে। ২০২১ সালে এই খাতে তারা রপ্তানি করেছে প্রায় ২.৪৫ বিলিয়ন ডলার। ইসরাইল দেশটিতে প্রায় ৫০ শতাংশ মরুভূমি থাকার কারণে মাত্র ২০ শতাংশ কৃষিযোগ্য জমি রয়েছে এবং স্বাদু পানির অভাব রয়েছে। তার পরেও ১৯৮৫ সাল থেকেই তারা কৃষি খাতে ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ করেছে। বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে তারা মরুভূমিতে ফসল ফলানো, জেনেটিক মিউটেশনের মাধ্যমে সমুদ্রের লবণাক্ত পানিকে সেচ কাজে ব্যবহার, উচ্চ ফলনশীল এবং লবণাক্ত পানিতে বেড়ে উঠবে এমন বীজ তারা আবিষ্কার করেছে। স্প্রিংকলার সেচের পরিবর্তে ‘ড্রিপ’ সেচের মাধ্যমে তারা ফসলের গায়ে এবং গোঁড়ায় ফোঁটায় ফোঁটায় পানি দিয়ে পানি অপচয় রোধ করে, ফলে কৃষি ক্ষেত্রে তারা মাত্র ৫৬ শতাংশ পানি ব্যবহার করে ফসল ফলাতে সক্ষম হচ্ছে। ভূ-নিম্নস্থ নালার মাধ্যমে বা স্প্রিংকলার সেচের তুলনায় ড্রিপ পদ্ধতিতে পানি ব্যবহৃত হচ্ছে ৫০ শতাংশ কম, কারণ এতে পানির বাষ্পায়ন কমে পানির অপচয় কম হয় এবং ২০-৯০ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে পারে।
পানির অপচয় মেটাতে তারা তাদের ৮৬ শতাংশ নোংরা পানি রি-সাইক্লিংয়ের মাধ্যমে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তুলছে আর এই পানি সেচ কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বায়োপেস্টিসাইড ও জৈবসার ব্যবহার করে ৭৬ শতাংশ কেমিক্যাল জাতীয় সারের ব্যবহার কমিয়ে আনছে ইসরাইল। এই পদ্ধতি ব্যবহার করার কারণে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ইসরাইলের সার রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে ১০৭.৪ শতাংশ। রোবোটিক্স, সেন্সর, বিগ ডাটা প্রভৃতি প্রযুক্তি ব্যবহার করে কোন গাছের কী পরিমাণ খাদ্য, পানি এবং জীবাণুনাশক ঔষধ প্রয়োগের প্রয়োজন তার সবকিছু সঠিক হিসাব অনুযায়ী ব্যবহার করে সম্পদের অপচয় রোধ করছে।
তবে এসবের বাইরে ডায়মন্ডের মতো মূল্যবান ধাতু রপ্তানি করে ইসরাইল ২০২২ সালে আয় করেছে ৯.৫ বিলিয়ন ডলার। অনেকটা এসএমই শিল্পের আদলে বেলজিয়াম থেকে আগত উদ্যোক্তা অভিবাসীদের মাধ্যমে ১৯৩০ সাল থেকে ইসরাইলে এই শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন ঐতিহ্যবাহী ইউরোপীয় কেন্দ্রগুলো জার্মানদের দখলে চলে যায়, তখন ইসরাইল পলিশ করা হীরার একটি প্রধান উৎস হয়ে ওঠে। হীরা শিল্প ইউরোপের ইহুদীদের ইতিহাসের সাথে জড়িত। মধ্যযুগীয় সময়ে যখন ইহুদীদের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হবার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তখন হীরা ব্যবসা ইহুদিদের একটি জনপ্রিয় পেশা হয়ে ওঠে। এই শিল্প থেকে এক সময় সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় হতো। তবে বর্তমানে মাত্র ০.৭ বিলিয়ন ডলার ব্যবধান কম থাকায় বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি সরঞ্জাম শিল্পের কাছে প্রথম স্থান হারিয়েছে। হীরা শিল্পকে কেন্দ্র করেই প্রতিবছর প্রায় ৩.৩ লাখ দর্শক এবং বিদেশি ক্রেতা ইসরাইল ভ্রমণ করে থাকেন।
এবার তাকানো যাক তাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থার দিকে। যুদ্ধের কারণে সত্তর-আশির দশকের দিকে ইসরাইলের ব্যাংকগুলো দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। অথচ ২০২২ সালে ফোর্বসের সেরা কোম্পানির তালিকায় ইসরাইলের ছিল ১৩টি কোম্পানি, যার মধ্যে ব্যাংক এবং ইনস্যুরেন্সের সংখ্যা ছিল ৯টি (ব্যাংক ৫টি এবং ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ৪টি)। ফোর্বসের তালিকায় থাকা ইসরাইলের সেরা ৩টি ব্যাংক হলো: ব্যাংক লিউমি, ব্যাংক হাপোয়ালিম এবং মিজরাহি-তেফাহোত ব্যাংক। যাদের মূল্যমান ২০২২ সালে ছিল যথাক্রমে ১৫.৮৭, ১২.৮৮ এবং ৯.৭৫ বিলিয়ন ডলার। তবে বাজার মূলধন অনুযায়ী এই মুহূর্তে ইসরাইলের সবচেয়ে বড় কোম্পানির নাম হচ্ছে ‘মবিলিয়ে’, ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত গাড়ি শিল্পের এই কোম্পানিটির মূল্যমান নভেম্বর-২০২৩ দাঁড়িয়েছিল ৩৩.০৬ বিলিয়ন ডলার।
লেখক: ব্যাংকার