জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান
২৪ জানুয়ারি ২০২৪ ১৫:৩০
পরিপাটি পোষাক পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলকনিতে বুক ফুলিয়ে হাঁটলে নিজেকে মহা মানব কিংবা বিরাট মনীষী মনে হয়। বিশাল অডিটোরিয়াম পরিপূর্ণ জনসম্মুখের মঞ্চে দাঁড়ালে নিজেকে অনেক বড়ো বক্তা মনে হয়। যখন নিজের নাম ঘোষণা করা হয় স্পিকারে তখন অদ্বিতীয় মনে করি আমরা। এয়ারপোর্ট থেকে বিমান উপরে তুলার সময় নিজেকে সাড়ে আটশো কোটি মানুষ থেকে আলাদা মনে করি। জাতির সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া লোকদের আমরা শ্রদ্ধা করি বেশ। দামী গাড়ি নিয়ে অফিসে ঢুকার সময় জুনিয়ররা দাঁড়িয়ে সম্মান করলে বস বস ভাব আসে। এই সমস্ত কিছুর জন্য মা-বাবাও গর্ববোধ করেন।
একবারো কি মনে হয় আমাদের? ছোট্ট বেলায় বাংলায় ‘ক’ তে ‘কলম’, আরবিতে ‘বা’ তে ‘বাবুন’ এবং ইংরেজিতে ‘ইউ’ তে ‘ইউনিভার্সিটি’ পড়ানো শিক্ষক কি করছেন? কোথায় আছেন? কেমন আছেন? সাইকেল চালিয়ে শিক্ষককের সামনে গেলে এসেম্বলিতে সবার সামনে বেতের আঘাত করে শিক্ষা দেওয়া শিক্ষককে কতটুকু মনে রাখি? যে ড্রেসের জন্য শৃংখল জীবন তৈরি করতে অহরহ বকা দিয়েছেন সেই পিটি শিক্ষককের কথা স্বরণ করি? আরবিতে ‘বাবুন’ অর্থ দরজা, সেই ছোট্ট ক্লাসের বাবুনের দরজা থেকে দেশের মস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা দিয়ে ঢুকার যগ্যে করেছেন তাদের খবর রাখি? ‘ক’ তে ‘কলম’ সেই কলমের একটা সাইন যে আজ আমার বহুত বড়ো দামী। কার জন্য হয়েছে আমাদের মনে আছে?
‘তেরা জামিন পেয়ার’ সিনেমা দেখে চোখের জল ফেলি। একজন আমির খান অনেক স্টুডেন্ট থেকে কথা না বলতে পারা স্টুডেন্টকে বিজয়ী করে তুলেন। কিন্তু তার চেয়ে বহু কষ্টে আমাদের মানুষ করা সেই শিক্ষক আজ কোথায়? আমাকে বোবা থেকে কথা বলানো সেই প্রাথমিকের শিক্ষিকা আজ কোথায়? বাড়িতে হাজার সমস্যা থাকার পরেও ক্লাসে এসে হাসিখুশি কথা বলা সেই শিক্ষক কই? নিজের অজস্র কষ্ট ঢেকে আমাদের পিছনে জীবনের অধিক গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করে মানুষের মত মানুষ করেছেন। তিনিই শিক্ষক। সময়ে অসময়ে খালি পেটে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা সাতটি ক্লাস নিয়ে পেটে ক্ষুধা নিয়ে আবার বাড়ি ফেরা মানুষটি শিক্ষক।
নামের পিছনে শিক্ষক নাম আছে তাই সহস্র কাজ ছেড়ে দিতে হয়। অনেক কিছু দেখেও না দেখার বান করতে হয়। নিজের পরিবার পরিজন রেখে অন্যের ছেলেমেয়েদের মানুষ করাকে শিক্ষকতা বলে। সেই ছোটো বেলায় ড্রেসের জন্য মাইর না দিলে আমরা সুশৃঙ্খল হতাম না। বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা দিয়ে ঢুকতে পারতাম না৷ সুললিত আচরণ না শিখাইলে আজ এতো সুন্দর সুন্দর কথা বলার জন্য মঞ্চে উঠতে পারতাম না৷ বেতের বারি না মারলে আজ পিছনে চাবুক পড়তো হয়তো। নয়তো হাতে ও কাঁধে ইট নিয়ে দালানের চূড়ায় উঠতে হতো। কুড়াল নিয়ে বনে ছুটতে হতো। জাল বুনে মহা সমুদ্রে যেতে হতো।
নোবেল পুরস্কার পেয়েছে জেনেও ক্লাসে পাঠদান চালিয়ে যাওয়ায় শিক্ষকতা। একটুও বিচলিত না হয়ে নোবেল বিজয়ী হওয়ার পরেও ক্লাসে মনোযোগ দিয়ে পাঠ শেষ করার নামই শিক্ষক। কতটুকু সুন্দর মনের মানুষ তিনি। তিনিই শিক্ষক। পরের সন্তান মানুষ হলে চোখের কোনা মুছে হাত তালি দেওয়ায় শিক্ষকতা। ছাত্র-ছাত্রীর সাফল্য দেখে বুক ফুলিয়ে বলা সে আমার ছাত্র/সে আমার ছাত্রী! তিনিই শিক্ষক। স্টুডেন্টদের সফলতায় যার মূল উদ্দেশ্য তিনিই শিক্ষক। এই পৃথিবীতে এক মাত্র শিক্ষকই এক শ্রেণী যাঁরা অন্যের সফলতার জন্য প্রচন্ড কষ্ট করেন। তাঁরাই একমাত্র দল যাঁরা নির্লোভে পরের সফলতা কামনা করে।
রিকতা আকতার বানুর কথা মনে আছে? এইতো কিছুদিন আগের ঘটনা। ২০০৮ সালে প্রতিবন্ধী মেয়েকে স্কুলে ভর্তি না করায় নিজেই স্কুল খুলে বসেন। বছর হতেই ৬৩ জন। চারজন শিক্ষক এগিয়ে আসেন তাঁর পাশে। সব কিছু বহন করতেন নিজেই। ৬৩ জন ছাত্রছাত্রীর খরচ কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। ৬৩ জন ছাত্রছাত্রী থেকে ৩০০ জন হয়েছে। স্বেচ্ছাশ্রম দেয়া চার জন শিক্ষক থেকে ২১ জন হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের দুপুরের খাবারের দায়িত্ব সকল শিক্ষক কর্মচারী ভাগ করে নিয়েছেন। তবুও সপ্তাহের এক দিন রিকতা তার স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের খাবার দিতে ভুলেন না। অল্প কথায় এসব মহৎ কাজের কথা লিখে ফেলা যায়। কিন্তু তিনি যে শ্রম আর ত্যাগ স্বীকার করেছেন স্কুলের জন্য পৃথিবীর কোনো ভাষাতেই সেই ত্যাগের শতভাগ বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তিনিই শিক্ষক!
আমার এখনো মনে আছে ২০১৮ সালে আমার শিক্ষক ইসমাইল হুজুরের কথা। হঠাৎ রবের ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছিলেন। যেখানে জানাজার মাঠে জানাজা শেষে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই চোখের জল ফেলছেন। আমরা কেঁদেছিলাম দুধের বাচ্চার মত৷ প্রতিষ্ঠানের প্রধান সহ কেঁদেছিল। এখনো নাম মনে হলেই আঁখির কোনে জল আসে অজান্তেই। একজন শিক্ষকের বিদায়ে গাছের পাতা পর্যন্ত স্তব্ধ হয়েছিলেন সেদিন। কেমন সোনার ছাত্র-ছাত্রী তৈরি করেছিলেন তিনি। কেমন শিক্ষা দিয়েছিলেন? আহা! মানুষ তাজ্জব হয়েছিল একজন শিক্ষকের বিদায়ে হাজার হাজার স্টুডেন্টস কাঁদছে। কেমন মানুষ ছিলেন সেই শিক্ষক! তাইতো শিক্ষকতা পেশা এতো দামী।
ঘুটঘুটে অন্ধকার একটা জায়গাকে আলোকিত করতে পারে একজন শিক্ষক। আলোর মশাল দিয়ে পথ দেখিয়ে দেন সমাজ ও দেশের কল্যাণে। অধিকাংশ মানুষ সফল হওয়ার পরে তাঁদের ভুলে যায়। যাঁরা কনকনে ঠান্ডায় শীতে, রৌদ্রময় তপতপে দুপুরে কিংবা অবিরাম বৃষ্টিতে ভিজে ক্লাসে এসে শিক্ষা দিয়েছিলেন। যাঁরা নিজের পরিবারের পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আর একটা আপন পরিবার মনে করেন। মানুষের মত মানুষ করেন অপরের সন্তানদের। নিজের সন্তানের মতই। দুনিয়াতে বিচরণ করতে সহায়তা করেছেন। জগত চিনতে সাহায্য করেছেন। ভালো থাকুক সেই সমস্ত জাতির শ্রেষ্ঠ মানুষ গুলো। মহান রব সুখে-শান্তিতে রাখুক আমাদের হাতে আলোর মশাল দেওয়া শিক্ষকদের।
লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম
সারাবাংলা/এসবিডিই