Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গণঅভ্যুত্থান থেকে স্বাধীনতা

অলোক আচার্য
২৪ জানুয়ারি ২০২৪ ১৫:৫০

ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!/শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে/দুয়োর বেঁধে রাখ কেন বাঁধবো দোর জানালা/তুলবো কেন খিল? কবি আল মাহমুদের এই কবিতা বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম ঘটনা ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান নিয়ে লেখা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে ৬৯ এর আন্দোলন। একটি পরাধীন জাতির স্বাধীনতা তো এমনি এমনি আসে না। এর পেছনে থাকে কিছু ঘটনাবহুল ইতিহাস। যে ঘটনাগুলো পর্যায়ক্রমে ঘটে। এই ঘটনাগুলোর সাথে থাকে তাজা রক্তের ইতিহাস। অর্থাৎ স্বাধীনতা একটু একটু করে ধরা দেয়। রাতারাতি স্বাধীনতা আসে না। স্বাধীনতা আসলে একটি স্বপ্ন। স্বাধীনতা অর্জনের পথে বেশ কিছু ধাপ পার হতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথেও এ রকম ধাপ পার হতে হয়েছে। প্রতিটি ধাপেই রয়েছে সংগ্রামের ইতিহাস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ঊনসত্তরের গণঅভ্যত্থানএক তাৎপর্যপূর্ণ মাইলফলক। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা, পরবর্তীতে ১১ দফা ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থাানপথ বেয়েই রক্তাক্ত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি অর্জন করে মহান স্বাধীনতা। ১১ দফা দাবির মূলভিত্তি ছিল বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা। এই আন্দোলনগুলো ছিল পাকিস্তানের করা বাঙালিদের উপর নির্মমতার প্রতিবাদ। প্রথমেই আঘাত আসে বাঙালির ভাষার উপর। বাঙালি মেনে নেয়নি সেদিনের পাকিস্তানের সিদ্ধান্ত। প্রতিবাদ হয়েছিল। রক্ত ঝরেছিল। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এরপর ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে তরাণি¦ত করে। এরপর আসে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থান। ১৯৬৬ সালে মুক্তিকামী নিপীড়িত জনগণের পক্ষে জাতির মুক্তি সনদ খ্যাত ৬ দফা এবং পরবর্তীতে ছাত্র সমাজের দেয়া ১১ দফা কর্মসূচির প্রেক্ষাপটে সংঘটিত হয়েছিল এ গণঅভুত্থান। জানুয়ারির ২০ তারিখে আসাদের রক্ত স্বাধীনতার পতাকার রং হয়ে ওঠে।

বিজ্ঞাপন

তার আগে ১৭ জানুয়ারি ছাত্রনেতারা দেশব্যাপী সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক দিলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান ছাত্র আন্দোলন দমনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। অবশেষে ২৪ শে জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থানসংগঠিত হয়। ২৪ জানুয়ারি, ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান দিবস। পাকিস্তানি সামরিক শাসন উৎখাতের লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালের এই দিনে সংগ্রামী জনতা শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়ন ও সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে মিছিল বের করে। ঠিক যেভাবে ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করেছিল ছাত্র-জনতা। মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত হন নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান। জনতার রুদ্ররোষ এবং গণ-অভ্যুত্থানের জোয়ারে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান অভিযুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সবাইকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এটাও ছিল স্বাধীনতার চুড়ান্ত বিজয়ের আগে আরেকটি বিজয়। যা সহজ করেছিল স্বাধীনতার পথ। অত্যাচারীরা বুঝে গিয়েছিল আর বেশিদিন বাঙালির স্বাধীনতাকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। পতন ঘটে আইয়ুবের স্বৈরতন্ত্রের। ১৯৬৯-এর ৪ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা কর্মসূচি গণ-অভ্যুত্থানের পথ সৃষ্টি করেছিল। শহিদ আসাদের আত্মদানের পর ২১, ২২ ও ২৩ জানুয়ারি শোক পালনের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে গণঅভ্যুত্থানসৃষ্টি হয়েছিল প্রতিটি পরাধীন মানুষের চোখে প্রথম স্বপ্ন থাকে একখন্ড স্বাধীন ভূমির, একটি নিজস্ব পতাকার এবং নিজস্ব ভাষার অধিকার। পরাধীনতা একটি অভিশাপ। এই অভিশাপ থেকে সবাই মুক্তি পেতে চায়। পৃথিবীতে বহু জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে যুদ্ধ করেছে এবং আজও করছে। ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করতে বিভিন্ন সময়ে বহু দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাদের যৌবন, কিশোরবেলা ছিল স্বাধীনতার জন্য। তারপর পশ্চিম পাকিস্তানের শ্যৈন দৃষ্টি থেকে মুক্ত করে পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। পেয়েছি লাল, সবুজ পতাকা।

বিজ্ঞাপন

একটি যুদ্ধ, একটি স্বাধীন দেশ পাওয়ার জন্য বহু মানুষের রক্ত, সম্মান, সাহস আর শক্তির সমন্বয় প্রয়োজন হয়। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হয় একটি স্বপ্নের। স্বাধীনতার স্বপ্ন। যে স্বপ্ন একদিন বাঙালি দেখেছিল। সেই স্বপ্ন বাঙালির চোখে এঁকে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৯ সালের বিবিসি বাংলায় প্রকশিত প্রতিবেদনে গণঅভ্যুত্থানইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান । ফলে স্বাধিকার আন্দোলনের গতি তীব্র হয়। পাকিস্তানি শাসকেরা একে নস্যাৎ করতে আগরতলা মামলা করে। মামলার প্রধান আসামি শেখ মুজিবসহ অন্যান্যদের মুক্তি ও পাকিস্তানি সামরিক শাসন উৎখাতের দাবিতে ১৯৬৯ সালের ২৪শে জানুয়ারি সান্ধ্যআইন ভঙ্গ করে সাধারণ মানুষ মিছিল বের করে। সেই মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে প্রাণ হারান কিশোর মতিউর রহমান মল্লিকসহ চারজন। প্রতিটি প্রাণী নিজ স্বাধীনতা অর্জনে বদ্ধ পরিকর থাকে। আবার এক শ্রেণির প্রাণী থাকে যারা অন্যের স্বাধীনতা হরণ করেই শান্তি পায়। এক শ্রেণি শোষণকারী অপরদিকে থাকে শোষিত শ্রেণি। যারা অধিকার আদায়ের লক্ষে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলে। যুগ যুগ ধরে এটা হয়ে আসছে। শোষিত শ্রেণি যখনই অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রাস্তায় নামে, সংগ্রাম করে তখনই তাদের উপর নেমে আসে জুলুমকারীদের খড়গ। কিন্তু একথা ঠিক যে স্বাধীনতা বঞ্চিত মানুষের ক্ষোভ হয় তীব্র এবং তা সব বাধা ভেঙে দেয়। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির মরণপন সংগ্রামের ফলেই এ স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। কিন্তু এটা একদিনে অর্জিত হয়নি। এর পেছনেও আছে রক্তাত্ত ইতিহাস। ৬৯ এর গণঅভুত্থান শুধু একটি আন্দোলনই ছিল না। এদিন কয়েকটি ইতিহাসের সমন্বয় ঘটেছিল। মতিউরের রক্তে কেঁপে ওঠে আইয়ুব খানের শাসন। তার সিংহাসন টালমাটাল হয়। বাংলার স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত হন। অবশ্য তার আগে আসাদের মৃত্যু এই আন্দোলনকে আরও গতি দিয়েছিল। ফলে এই আন্দোলকে দমানোর কোনো উপায় আইয়ুব সরকারের হাতে ছিল না। মোট কথা ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান থেকেই ধাবিত হয়েছিল বাঙালির স্বাধীনতার চূড়ান্ত অর্জন।

লেখক: কলামিষ্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

অলোক আচার্য গণঅভ্যুত্থান থেকে স্বাধীনতা মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর