মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনমানে কি প্রভাব ফেলছে?
২৪ জানুয়ারি ২০২৪ ১৭:০৫
সাম্প্রতিক সামষ্টিক অর্থনীতির পর্যালোচনায় ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের হার নিয়ে খুবই আলোচনা হয়- যা এর আগে তেমনটি দেখা যায়নি। গত ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পেশ করার হয়েছে যেখানে মূল্যস্ফীতির হার ধরা হয়েছে ৬.৫ শতাংশ এবং গত বছরের বাজেট বক্তৃতায় মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছিল ৭.৫ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশের মূল্যস্ফীতি ৬.২২ শতাংশ অথচ বাজার বলছে দ্রব্যমুল্যের যে পরিস্থিতি ক্রমাগত ভাবে বেড়ে চলেছে তাতে মূল্যস্ফীতি এখন ১২ শতাংশ এর কাছাকাছি রয়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে গত এক বছরের মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী এবং ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে গত মে মাসে (৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ)। একই মাসে গত বছরে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। আগস্ট মাসে খাদ্যপণ্য মূল্যবৃদ্ধির রেকর্ড গড়েছে। চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, সবজি, মসলা ও তামাকজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে। ২০২০ সালে খাদ্য খাতে ১০০ টাকার পণ্যে ৫ টাকা ৫৬ পয়সা বৃদ্ধি হয়েছিল। একই পণ্যে ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে বেড়েছে ১২ টাকা ৫৪ পয়সা। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিতে অসহায় অবস্থায় পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ। গত ১৫ বছরে ক্ষুধা জয়ের ক্ষেত্রে অনন্য সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। মানুষের জীবনমান নিঃসন্দেহে বেড়েছে। তবে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতির যে ভয়াল দৈত্য দেশের মানুষের ওপর চেপে বসেছে তাতে ক্ষুধার জ্বালা না বাড়লেও জীবনমান কমছে। খাদ্যপণ্যের পেছনে গিয়ে অর্থ ব্যয় করতে গিয়ে অন্যান্য খাতের চাহিদা অপূরণ থাকছে। এমনকি চিকিৎসা ব্যয়ের ক্ষেত্রেও কৃচ্ছ্রসাধন চলছে। এ সংকটের সমাধান মূল্যস্ফীতিতে লাগাম টানা। সরকারের সুনামও যার সঙ্গে জড়িত। শহর ও গ্রামের মধ্যে তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, গ্রামে এর ধকল বেশি। গ্রামাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ। অন্যদিকে শহরের সার্বিক মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এটা হচ্ছে আমাদের সার্বিক মূল্যস্ফীতির চিত্র।
অন্যদিকে প্রান্তিক আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সবার আগে আমলে নিতে হয়। গ্রাম ও শহর মিলিয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। আলাদাভাবে দেখলে গ্রামাঞ্চলের খাদ্য মূল্যস্ফীতি শহরের থেকে বেশি। মূল্যস্ফীতি সরকারি হিসাবে যা এল তা অনেক বেশি। বাস্তবতা হয়তো আরো ভিন্ন। উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে, সরকারের একটা প্রবণতা থাকে মূল্যস্ফীতির ফিগার একটু কমিয়ে দেখানো। একাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে বাংলাদেশেও হয়তো তাই হয়েছে। প্রকৃত মূল্যস্ফীতি হয়তো তার চেয়েও বেশি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গণনা করার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশে একই ধরনের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। গ্রাম ও শহরে দুই স্থানেই খাদ্যের বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে। অবশ্য এ সময়ে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ব্যাপারে পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেছেন মুরগী ও ডিমের মূল্য এ বৃদ্ধির এর জন্য দায়ী।
সরকার যে মূল্যস্ফীতির উপাত্ত প্রকাশ করেছে প্রকৃত চিত্র তা হলেও কিন্তু প্রান্তিক আয়ের মানুষের জন্যে তা ভয়ানক। মূল্যস্ফীতির হার মাঝেমধ্যে একটু কমতেই পারে। কিন্তু এর পুঞ্জীভূত বিরূপ প্রভাব সর্বদা বহমান। গড় দাম কিংবা দামস্তর একবার বাড়লে তা তো নেমে আসবে না যদি না মূল্যস্ফীতি ঋণাত্মক হয়। আনুপাতিক হারে আয় না বাড়লে ভোগের ওপর এর বিরূপ প্রভাব বিদ্যমান থাকবেই। আর উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলতে থাকলে জীবনযাপন কঠিন থেকে কঠিনতর হবে, এটাই স্বাভাবিক। মূল্যস্ফীতির যে চাপ তা সবার ওপরই পড়ে এবং সেটা বুঝতে কোনো বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। কোনো দেশে যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকে তা সবাইকে প্রভাবিত করে। তার পরও উচ্চ ও মধ্যম আয়ের মানুষেরা চাপ থাকলেও মানিয়ে নেয়। কিন্তু যারা নিম্ন আয়ের মানুষ এমনিতেই তাদের নুন আনতে পানতা ফুরায়, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির মানে হলো সামগ্রিকভাবে অতিরিক্ত চাপ। জীবন ধারণের জন্য যে ন্যূনতম ভোগ প্রয়োজন তাদের জন্য তা ধরে রাখা কঠিন। মূল্যস্ফীতি সহসাই যে নেমে আসবে সে রকম আশাব্যঞ্জক কিছু সামনে দেখছি না।
অনেকেই মুদ্রাস্ফীতির কারনকে অনেক ভাবেই বিশ্লেষন করেছেন যেমন বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি; দেশজ উৎপাদনে ঘাটতি; পণ্য সরবরাহে ঘাটতি; মুদ্রার বিনিময় হার; শুল্ক ও বিশেষ শুল্ক হার; অশুল্ক বাধাগুলোর প্রভাব; মুদ্রা সরবরাহ; বাণিজ্যঘাটতি; বাজেটঘাটতি; বিদেশের সাথে আর্থিক লেনদেনে ভারসাম্যহীনতা; সুদের হার; ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের অতিমাত্রায় ঋণ গ্রহণ; পণ্যের একচেটিয়া মূল্য নির্ধারণ; শ্রমিক ইউনিয়নের মজুরি বাড়ানোর চাপ; শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর মধ্যে খাতওয়ারি মজুরি বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা; শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা; মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতিতে অসামাঞ্জস্য; সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে জীবনমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিযোগিতার মতো কারণগুলো। মূল্যস্ফীতির কারণ যেমন একটি নয়, তেমনি এর প্রতিকারও একটি সূচকের তারতম্য করার মাধ্যমে সম্ভব নয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, বাজারে পণ্যের মজুদ ও মুদ্রার পরিমাণের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হয়। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় ব্যাংক যখন অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপে, তখন মূল্যস্ফীতি ঘটে।
অর্থনীতি তথ্য বলছে মূল্যস্ফীতির হার যদি দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে সেটি সঠিক হয়না অর্থ্যাৎ স্বাভাবিকভাবে বর্তমানে দেশে জিডিপির চেয়ে মূল্যস্ফীতির হারের প্রবণতা বেশি। এমতাবস্তয় ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরের বাজেটে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতির ৬.৫ শতাংশের মধ্যে ধরা হয়েছে, যা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেেেক মধ্যে।সম্প্রতি বিআইডিএস এর গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে গরিব মানুষের অর্ধেকের বেশি ‘নতুন দরিদ্র’। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সপ্তম ধাপের (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) ফলাফল অনুযায়ী, এ মুহূর্তে বাংলাদেশী খানাগুলোর প্রায় অর্ধেকই খাদ্যের উচ্চমূল্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে। জরিপে দেখা যায়, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে সবচেয়ে বড় আর্থিক ধাক্কা হিসেবে চিহ্নিত করেছে ৪৮ শতাংশ খানা। এই যে মূল্যস্ফীতি, তা সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক উত্থানকে বাধাগ্রস্থ করছে। মূল্যস্ফীতি মধ্যবিত্তকে নামাচ্ছে নিম্ন-মধ্যবিত্তে, আর নিম্ন-মধ্যবিত্তকে নিয়ে যাচ্ছে নিম্নবিত্তে। এতে স্থানীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ব্যাপকসংখ্যক দরিদ্র জনগোষ্ঠীসহ উদীয়মান অর্থনীতির ক্ষেত্রে এটি মনে রাখা জরুরি, যখন একটি দেশ প্রধানত চাহিদাচালিত মূল্যস্ফীতির সম্মুখীন হয় এবং বোডর্ জুড়ে দাম বেড়ে যায় তখন বিনিয়ম হারের সংশোধন প্রভাবটিকে এর সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে পারে। যদি একটি দেশের সব পণ্য ও পরিষেবার দাম এক শতাংশ বৃদ্ধি পায় এবং মুদ্রার মানের এক শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটে তাহলে অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে এর স্পিলওভার প্রভাব হবে সামান্য। কিন্তু পণ্য ও পরিষেবা জুড়ে বর্তমানের অসম ও তির্যক মূল্যস্ফীতি এবং ক্রমবর্ধমান মূল্য শুধু একটি বিনিময় হার সংশোধনের মাধ্যমে একটি দেশে সীমাবদ্ধ করা যায় না। স্পিলওভার প্রভাব তখন অনিবার্য। আর বর্তমানে ঠিক তাই ঘটছে। আজকের দিনের মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে তুলনামূলকভাবে অকার্যকর মনে হওয়ার আরেকটি কারণ হলো বিশ্বায়নের অগ্রগতি।
সপ্তদশ শতাব্দীতে সুইডেনের রিক্সব্যাংক (১৬৬৮) ও ব্যাংক অব ইংল্যান্ড (১৬৯৪) যখন বিশ্বের প্রথম কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে ছিল, বিষয়টি তখন থেকে বোঝা যায় যে একক অর্থনীতিতে একাধিক অর্থ সৃষ্টিকারী কর্তৃপক্ষ থাকা উচিত নয়। এ নীতি অনুসারে তত্কালীন প্রধান অর্থনীতিগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে শুরুকরে। তবে অপ্রত্যাশিতভাবে এখন ব্যবস্থাটিকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। বিশ্বায়নের এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি পণ্য, পরিসেবা ও এক দেশ থেকে অন্য দেশে পুঁজিপ্রবাহের মাধ্যমে বিশ্ব ক্রমে একক অর্থনীতিতে পরিণত হে কিন্তু বিশ্বজুড়ে রয়েছে বর্তমানে ১৫০টির বেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সপ্তদশ শতাব্দীর নীতিনির্ধারকরা ঠিক যে পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন, আমরা সেখানে ফিরে যাচ্ছি। এর মানে এটি মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনার জন্য সমস্যাজনক। কোনো দেশ যদি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি রোধের চেষ্টা করে তাহলে সেখানে বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে অর্থপ্রবাহ বাড়বে এবং রফতানি হ্রাস পাবে। এভাবে প্রতিটি দেশ স্বভাবতই আর্থিক কড়াকড়ি আরোপে কম উৎসাহিত হবে। বরং তারা চাইবে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিতে।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমাার্ধে (জানুয়ারি-জুন) সংকোচনমূলক নতুন মুদ্রানীতি ঘোষনা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক যার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে এর একটি পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে । প্রাথমিক ভাবে নতুন মুদ্রানীতিতে তিনটি বিষয়কে বিবেচনায় আনা হয়েছে যথা: এক নীতি সুদহার ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ শতাংশ করা হযেছে যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করবে, তার সুদহার বাড়বে; দ্বিতীয় রিভার্স রেপো (বর্তমান নাম স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি বা এসডিএফ) নিম্নসীমার সুদহার ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে যার ফলে বাজারে উদ্বৃত্ত টাকা থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক রিভার্স রেপোর মাধ্যমে টাকা তুলে নেয়এবং তৃতীয়ত: নীতি সুদহার করিডরের ঊর্ধ্বসীমা স্পেশাল রেপো বা এসএলএফ’র (স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি) সুদহার ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে যার ফলে সংকটে পড়া ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে কিছুটা ব্যয় কমবে। নীতি সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ও নি¤œসীমার মধ্যে ব্যবধান ২০০ শতাংশ পয়েন্ট থেকে কমিয়ে ১৫০ শতাংশ পয়েন্টে নামিয়ে আনা হয়েছে। অর্থাৎ নীতি সুদহার আট শতাংশের সঙ্গে সর্বোচ্চ ১৫০ বেসিস পয়েন্ট যোগ করে এসএলএফ সুদহার ও নিচে ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বিয়োগ করে এসডিএফ সুদহার নির্ধারণ করা হবে। তারল্যের প্রয়োজনে বাণিজ্যিক ব্যাংক যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদ হারে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়, তাকে বলে ব্যাংক রেট। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ প্রশমন, বিনিময় হারের চাপ নিয়ন্ত্রণ, সরকারের কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রয়াজনীয় অর্থের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করার বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে মুদ্রানীতিতে। তবে চার শতাংশের ব্যাংক রেটে পরিবর্তন আনা হয়নি।জানুয়ারি-জুন সময়ের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে দেখা যাচ্ছে, ২০২৪ সালের জুন মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ শতাংশ। একই সময়ের জন্য সরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ২ শতাংশ; সরকারি খাতে ছিল ১৮ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে বিদেশী মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি ব্যবহারের চিন্তা করা হচ্ছে বলে জানানো হয়।
স্থানীয় অর্থনীতি এখন এমর একটা পর্যায়ে রয়েছে যেখানে ছোট দোকান ও কৃষিজমির মালিক কিংবা শিল্প ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বল্পদক্ষ কর্মী। তাদের জীবন সহজ না হলেও ঘরে তাদের পর্যাপ্ত খাবার থাকে। তারা আয়ের অর্ধেক অর্থ মৌলিক প্রয়োজনের জন্য ব্যয় করে। অন্যান্য অনেক কেনাকাটা সেকেন্ডহ্যান্ড বা অনানুষ্ঠানিক বা খোলা বাজার থেকে কেনাকাটা করেন। কিন্তু এ গোষ্ঠীর উত্তরণের স্বপ্ন খেয়ে ফেলছে মূল্যস্ফীতি। বরং তাদের অবস্থা আরো নাজুক হচ্ছে। আয়ের এখন পুরোটাই তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য কিনতে খরচ করতে হচ্ছে। একই সঙ্গে যারা মধ্যবিত্ত পর্যায়ে ছিল, তারাও পড়তির দিকে। তাদের অনেকেই আয়-ব্যয়ের মধ্যে সমন্বয় করতে না পেরে দরিদ্রের খাতায় নাম লেখাচ্ছে।স্থানীয় পণ্যের উচ্চমূল্য এবং মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে খুব দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা এটি মনে রাখতে হবে যে মূল্যস্ফীতির চাপ আরো কিছু সময় থাকবে। এটি সারা পৃথিবীতেই অনুভূত হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারকে দুটি বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।প্রথমত, বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে। এর জন্য দেশের ভেতরে উৎপাদিত পণ্য এবং আমদানীকৃত পণ্যের সংগ্রহ বাড়াতে হবে; দ্বিতীয়ত, দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের সহায়তা দিতে হবে যাতে তারা বাজার থেকে পণ্য কিনতে পারে। তাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে। এছাড়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিতে হবে, যাতে তাদের ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে এ কার্যক্রমগুলোর জন্য প্রচুর অর্থ প্রয়োজন যার যোগান কে দেবে ? তাই সরকারকে কয়েকটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে যেমন, আমাদের রাজস্ব আহরণের পরিমাণ খুবই কমযা বর্তমানে কর-জিডিপি হার মাত্র ৭.৭ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নিম্নতম। অভ্যন্তরীণ সম্পদ সঞ্চালন না বাড়ালে উন্নয়ন কার্যক্রমে এবং সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে পারব না; তারপর বিষয়টি হলো সুশাসন অর্থ্যাৎ সরকারি অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে, অপ্রয়োজনীয় খরচ, প্রকল্প বাস্তবায়নে অপচয় রোধ ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে, সরকার এরই মধ্যে ব্যয় কমানোর ব্যাপারে কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। সেগুলো ভালো উদ্যোগ। কিন্তু আরো সাশ্রয়ের সুযোগ রয়েছে;আরেকটি বিষয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেহেতু আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে এবং রফতানি আয় সে তুলনায় বাড়ছেনা, রেমিট্যান্স প্রবাহও বাড়ছে ন , চলতি হিসাবে বিরাট ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। এটি চলতে থাকলে তা বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে চাপ সৃষ্টি করবে। এতে টাকার মান আরো কমবে এবং মূল্যস্ফীতিও বাড়বে।সুতরাং মূল্যস্ফীতি কমানোর বিষয়টি অনেক পদক্ষেপের সঙ্গে জড়িত। এটি পূর্ণাঙ্গ নীতি পদক্ষেপের মাধ্যমে মোকাবেলা করতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব সেটি করতে হবে। কেননা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপ অব্যাহত থাকলে তা সমাজে আরো বৈষম্য বাড়াবে, যেটি মোটেই কাম্য নয়।আর স্থানীয় অর্থনীতি হবে ক্ষতিগ্রস্থ । ভোক্তা অধিকার সংস্থা, টিসিবি, পণ্য বিপণন ব্যবস্থাপনা, চাহিদা সরবরাহ নেটওয়ার্ক এবং সর্বোপরি আমদানি-রপ্তানি ব্যবস্থাপনায় কঠোর নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা আনয়ন পূর্বক এ সমস্যা সমাধানে তৎপর হতে হবে। অধিকন্তু বিভিন্ন বাজার কমিটি দ্রব্যসামগ্রীর গুণাগুণ যাচাই কমিটি, মালামাল সংরক্ষণ ও গুদামজাত ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং সর্বোপরি মহানগর ও পৌর এলাকাস্থিত বাজারগুলোতে তাদের নিজস্ব পরিদর্শন টিমের আন্তরিকতার সঙ্গে তদারকি কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। আর সকলের সমন্বিত কার্যক্রমে এ দূরবস্থার নিরসন সম্ভব হবে।সব কিছুর দাম বাড়ায় সংসার খরচ বেড়ে গেছে। যে কারণে আয়ের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে নিত্যপণ্যের পেছনে। চাহিদার সঙ্গে দাম যাতে না বাড়ে, সে জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো দৃশ্যত কিছু বিশেষ ব্যবস্থাও নিয়ে থাকে। তবে আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, এসব ব্যবস্থা বাজার নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে পণ্য বিপণন, বাজার মনিটরিং ইত্যাদি যেসব পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে এগুলো যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য পরিবহন নির্বিঘ্ঘন রাখতে বিশেষ করে কৃষিপণ্যের সরবরাহে যাতে কোনো বাধার সৃষ্টি হতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে সংশ্লিষ্টদের।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক জ্যাষ্ট সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি, ঢাকা
সারাবাংলা/এসবিডিই
ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনমানে কি প্রভাব ফেলছে?