পাঠাগারে পাঠক বাড়াতে পারলেই টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হবে
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৩:৪৩
পাঠাগারকে বলা হয় গণমানুষের বিশ্ববিদ্যালয়। বই ও পাঠকের মাঝে সেতু বন্ধন তৈরী করে পাঠাগার। জীবস্বত্বা থেকে মানব সত্বার প্রবেশপথ হচ্ছে গ্রন্থাগার। অন্তহীন জ্ঞানের উৎস হলো বই, আর সেই বইয়ের আবাসস্থল হলো পাঠাগার। বর্তমান সরকারের দৃশ্যমান উন্নয়ন আমাদের উন্নতজাতি হিসেবে পরিচিত করছে না, শুধুমাত্র বইবিমুখতার জন্য। বই আমাদের সহনশীল করে, বিনয়ী, সুন্দর করে।
শুধু পাঠ্যপুস্তক অধ্যয়নে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে না। পাঠ্য বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বহির্জগতের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে জ্ঞান আহরণেরও চেষ্টা করতে হবে। বই আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে দেয়। বই আমাদের সমৃদ্ধ করে, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন আলোকিত মানুষ হতে সহায়তা করে।
মানুষের বই পড়ার আগ্রহ থেকেই গ্রন্থাগারের উৎপত্তি। গ্রন্থাগার একটি জাতির বিকাশ ও উন্নতির মানদণ্ড। পাঠাগার মানুষের বয়স, রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী বই সরবরাহ করে থাকে। গ্রন্থাগারের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে সংহতি, যা দেশ গড়া কিংবা রক্ষার কাজে অমূল্য অবদান।
চিন্তাশীল মানুষের কাছে গ্রন্থাগারের উপযোগিতা অনেক বেশি। গ্রন্থাগার জ্ঞান আহরণের সহজ মাধ্যম। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে গ্রন্থাগারের উপযোগিতা উন্নত দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। কম লেখাপড়া জানা ও গরিব মানুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে গ্রন্থাগার যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনি জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও গ্রন্থাগারের ভূমিকা অভাবনীয়। আধুনিক বিশ্বে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা দিনে দিনে বাড়ছে। গ্রন্থাগার সবার জন্য উন্মুক্ত। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা নেই এখানে, নেই হানাহানি, কলহ; সুতরাং জাতির মর্যাদাবোধের উন্নয়নে প্রত্যেক নাগরিকের উচিত নিয়মিত গ্রন্থাগারে উপস্থিত হয়ে লেখাপড়া করা এবং সমাজ গড়ায় সহায়ক রাজনীতির জ্ঞানার্জন করা। একটি সমাজের রূপরেখা বদলে দিতে পারে একটি সমৃদ্ধ । পাঠাগারে সেই বিষয়সংক্রান্ত অন্যান্য বই পড়লে বিষয়টি সহজবোধ্য হয়ে ওঠে—মানুষের বই পড়ার আগ্রহ থেকেই গ্রন্থাগারের উৎপত্তি।
গ্রন্থাগারের ইতিহাস বেশ পুরনো। প্রথম দিকে মানুষ নিজের ঘরের কোনে, মসজিদ, মন্দির, উপাসনালয়ে এবং রাজকীয় ভবনে গ্রন্থ সংরক্ষণ করতে শুরু করে। রোমে প্রথম গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়। সর্বসাধারণের মধ্যে জ্ঞানবিস্তারের জন্য খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়। শিক্ষার্থী পাঠাগারে প্রবেশ করলে তার সামনে খুলে যায় ভাবনার অপার দুয়ার। পাঠাগারের একেকটি বই তাকে একেক বিষয় সম্পর্কে ধারণা দেয়। এতে তার জন্য পরিধি বিস্তৃত হয়, যা তাকে একজন ভালো শিক্ষার্থী হতে সাহায্য করে। বই পড়ার মাধ্যমে শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে সে বিচরণ করতে পারে, যা তার পরবর্তী জীবনযাত্রাকে সহজ ও পরিশীলিত করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক প্রতিদিনের টিফিন পিরিয়ড বা অন্য অবসর সময়টা আড্ডা ও গল্প-গুজবের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দেয়; কিন্তু একটা লাইব্রেরি থাকলে ছাত্র-শিক্ষক তাদের প্রতিদিনের অবসর সময়টা পড়ালেখায় কাটাতে পারেন।
প্রমথ চৌধুরীর মতে, ‘লাইব্রেরি হচ্ছে এক ধরনের মনের হাসপাতাল’। পুথিগত বিদ্যার ভারে জেরবার ছাত্রসমাজের মানসিক প্রশান্তির জন্য পাঠাগার অপরিহার্য। পাঠাগার শুধু ভালো ছাত্রই নয়, ভালো মানুষও হতে শেখায়। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা ছাড়া জাতীয় চেতনার জাগরণ হয় না। আর তাই গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। পৃথিবীর বহুদেশ পাঠকের চাহিদা পূরণের জন্য গড়ে তুলেছে অগণিত গ্রন্থাগার। শিক্ষার আলো বঞ্চিত কোনো জাতি পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি। শিক্ষার বাতিঘর বলা হয় গ্রন্থাগারকে। গ্রন্থাগার ছাড়া কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র তার নাগরিককে পরিপূর্ণ শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে পারে না। গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা তাই প্রতিটি সমাজে অনিবার্য। বই পড়লে একজন শিক্ষার্থী হয়ে ওঠে আচরণে মার্জিত, চিন্তায় স্বতঃস্ফূর্ত ও কর্মে দৃপ্ত।
বর্তমান সরকারের লক্ষ্য টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা। তবে আমরা পত্র- পত্রিকা ও সংবাদ মাধ্যমে দেখি দায়িত্বশীলদের সীমাহীন দূর্নীতি ও ভূলনীতি। যার মূল্যে রয়েছে দেশপ্রেমের অভাব। সরকারের নানাবিধ মহৎ উদ্দেশ্য বিফলে যাচ্ছে যার ফলে। এর মূল্যে রয়েছে নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়। যার কারণ পাঠাগার সংস্কৃতি না থাকা। পাঠাগারে বই পড়লে মানুষ যেমন সমৃদ্ধ হয়, তেমনি একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। যার মধ্যে দেশপ্রেম, শৃঙ্খলা, দক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিক মর্যাদা ইত্যাদি গুণাবলি গড়ে ওঠে। যা দেশের সামগ্রিক উন্নতি সাধনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। দেশে প্রায় হাজার সচল পাঠাগার রয়েছে, যা ব্যাক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা। তার মধ্যে কিছু কিছু পাঠাগারে সরকারি কিছু বই ও অর্থ অনুদান দেওয়া হয় , যা বিদ্যুৎ বিল পর্যন্ত হয়না কোনো কোনো পাঠাগারে। বর্তমান সরকারের নানামুখী উদ্যোগের ফলে মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি পেতে শুরু করলেও সাম্প্রদায়িকতা, ঘৃণা, অসহনশীলতা বেড়েছে কয়েকগুণ। যার মূলে রয়েছে পাঠাগারগুলোর প্রতি সরকারের উদাসীনতা। ব্যাক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা এসব পাঠাগার গুলোকে সচল করতে পারলে অসাম্প্রদায়িক, মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন, আলোকিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।
এসব পাঠাগারগুলোকে সচল করতে সমৃদ্ধ বই সরবরাহ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে এবং নূন্যতম এক জন করে গ্রন্থাগারিক এর বেতন দিতে পারলেই পাঠাগারের তালা ভাঙবে। বর্তমান সরকারের অবকাঠামোগত উন্নয়নকে টেকসই করতে পাঠাগার গুলোকে সচল করার কোনো বিকল্প নেই। তবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ, উন্নতজাতি ও আলোকিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। দেশে কয়েক হাজার সচল পাঠাগার রয়েছে, এই পাঠাগার গুলোকে ১জন করে গ্রন্থাগারিক নিয়োগ দিয়ে, বই পড়া অভ্যাস তৈরী ও সাংস্কৃতিক হাব তৈরী করতে পারলেই টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হবে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
আল আমিন পাঠাগারে পাঠক বাড়াতে পারলেই টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হবে মুক্তমত