আপনের চেয়ে পর ভালো, পরের চেয়ে বৃদ্ধাশ্রম
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৫:৩৮
বাবা হাসপাতাল বিছানায়। একমাত্র উচ্চশিক্ষিত ছেলে পাশে নেই। চিকিৎসার জন্য অর্থের প্রয়োজন। সেই অর্থ নেই অসহায় হতদরিদ্র মায়ের কাছে। ছেলেকে মানুষ করতে তারা সব সম্পদও খুইয়েছেন। সক্ষম ছেলের কাছে সাহায্য না পেয়ে টাকার জন্য এখানে ওখানে ছুটছেন মা। একদিন অর্থাভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা হয়নি; তাই অসহায় বাবাটা দুনীয়া ছেড়েছেন।
এমন কষ্টের কথাা বলতে চাই না আর। তবুও বারবার ঘুরে ফিরেই সামনে আসে ওসব। হৃদয়ে এতো বেশি রক্তক্ষরণ হয় যে লিখনীর মাধ্যমে তা না ঝড়ালে প্রলয়ের সম্ভাবনা থাকে। ইদানীং মা-বাবার সাথে ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুর আচরণের দৃষ্টান্ত দেয়া যাবে ভূরি ভূরি। অতিত নিকটে রাজধানী ঢাকা লাগোয়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের যাত্রামুড়া এলাকায় এক শতবর্ষী বৃদ্ধ মাকে রাতের আঁধারে রাস্তায় ফেলে গেছে তার সন্তান। ঐ মা শুধু তার ছেলে তাকে সেখানে ফেলে গেছে এতটুকুই বলতে পারেন। এতোটা বয়স বেড়েছে যে স্মৃতিতে আর নিজের ঠিকানাটা পর্যন্ত নেই। পাঠক একবার ভাবুন বিষয়টা কতটা বেদনার। এমন হাজারো মায়ের বেদনার গল্প আছে এদেশে। ওঁদের কষ্টে আর হাকচিৎকারে দিনদিন বাংলার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। বাতাসও এই কষ্ট বহনের শক্তি হারাচ্ছে। কষ্ট বহন করতে না পারলে “কষ্টের বর্ষন“ হলে দেশটাতো ছাড়খাড় হয়ে যাবে। অভিষপ্ত দেশে নানা বিপর্যয় হচ্ছেও। এমন বেদনা নিয়ে বেঁচে থাকা হাজারো মায়ের গল্প জানি আমি। এর মধ্যে যারা মারা যান এমন সংবাদ পেলে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন’ বলার সাথে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ও বলি। মনে মনে বলি বেঁচে গেলেন বেচারি কিংবা বেচারা। ভাবি দুনিয়াতে দোজখ ভোগ করে বেহেস্তের যাত্রী হয়েছেন তারা। ওনাদের মৃত্যুতে আলহামদুলিল্লাহ বলি একারণে ভাগ্যাহত এসব মানুষের কষ্ট আসলেও সইবার নয়। যে মা-বাবা আমাদের এতো কষ্ট করে মানুষ করল, সেই তাদের এতো কষ্ট; তা সত্যিই সহ্য করার নয়।
আমরা খুব খেয়াল করছি- হাল সময়ে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানদের নিষ্ঠুর আচরণ অনেক বেড়েছে। অনেক পরিবারে এখন বয়স্ক বাবা-মা চরম অবহেলার শিকার। জীবনের সর্বস্ব দিয়ে সন্তান মানুষ করেন ঠিকই কিন্তু তারা মানুষেরমতো মানুষ হতে পারে না। তাই বার্ধক্যে এসে মা-বাবা ঐ সন্তানের কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়ছেন। অথচ সন্তানকে উচ্চ শিক্ষিত আর সক্ষম করে তুলতে কী না করেন তারা।
প্রশ্ন হলো- মা-বাবার প্রতি দিন দিন নিষ্ঠুরতা কেন বাড়ছে? মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন- ভোগবাদী এই সমাজ জীবন বিলাসী সন্তানদের মা-বাবার প্রতি উদাসীন করে তুলেছে। পশ্চিমা দুনিয়ার অনেক দেশেই এমন রেওয়াজ আছে যে সন্তান ১৮ বছর হলে বাবা-মা তাদের দ্বায়ীত্ব ছাড়েন। এমন কি তারা আরা এক সাথে বসবাসও করেন না। ছেলে মেয়েকে আলাদা সংগ্রাম করে নিজেকে গড়তে হয়। বৃদ্ধ বাবা-মাকে সন্তান কাছে রাখতে চায় না। বাবা-মা শত শত বৃদ্ধ হলেও সন্তানদের কাছে পান না। সেখানে এ সংস্কৃতি বেশ পুরনো। এ সংস্কৃতি বাংলাদেশেও কি ভর করছে? পশ্চিমা দুনিয়ায় এমন রেওয়াজ থাকলেও বৃদ্ধ পিতামাতা কিন্তু অবহেলিত নন। সরকার তাদের ভাতা দিচ্ছে। প্রয়োজনে থাকার জায়গা দিচ্ছে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিচ্ছে। সেখানকার বৃদ্ধরা খুব একটা সমস্যায় নেই। সন্তাদের অবহেলার পর আমাদের দেশের বৃদ্ধরা কিন্তু আর ভালো থাকতে পারে না। যেন নদীতে পরে যান তারা। তাদের দেখভালের আর কেউ থাকে না। আমাদের দেশে সন্তানের কাছে বাবা-মার নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা গণমাধ্যমে অহরহ প্রকাশ পাচ্ছে।
এসব নানা কারনে মনে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা ভালো আছেনতো? সন্তানের কষ্টে কারো চোখের জল ঝড়ছে নাতো? বিনা চিকিৎসায় আর অনাহারে নেইতো কেউ? আপনারা কেউ বৃদ্ধাশ্রমে আছেন কি? এমন প্রশ্ন জাগার কারন আছে অনেক। পত্রিকার শিরোনাম যদি এমন হয়- ‘ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার করা অসুস্থ বৃদ্ধ পিতাকে বৃদ্ধাশ্রমে প্রেরণ’; অন্যটির শিরোনাম’ ‘বাসস্ট্যান্ডে ফেলে রাখা বৃদ্ধ মায়ের ছেলের জন্য অপেক্ষায় কাটলো একমাস’। তাহলেতো প্রশ্ন জাগবেই। সংবাদ গুলো আমাদের বিবেক, মূল্যবোধ, পারিবারিক বন্ধন এবং আত্মার সম্পর্ক বিষয়ক এতদিনকার ধ্যান ধারণার ওপর প্রচন্ড আঘাত হানে। এমন সংবাদ সমাজের এক নগ্ন বাস্তবতাকে উন্মোচন করে।
হালযুগে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানদের সন্তানদের দ্বায়ীত্ববোধ কমতে শুরু করেছে। সবাই কেমন যেন ব্যস্থ হয়ে ইঠছি আমরা। স্বার্থপরতো বটেই! তাই অনেক বাবা-মায়ের আশ্রয় হয় এখন বৃদ্ধাশ্রমে। আজকাল বৃদ্ধাশ্রমের সাথে বেশ পরিচিত আমরা। এক দশক আগেও অধিকাংশ মানুষের মধ্যে বৃদ্ধাশ্রমের তেমন ধারণা ছিলো না। এখন দেশের অনেক জায়গায়ই বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে। আর নরক নামীয় এ বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় হচ্ছে অনেক বৃদ্ধ পিতা-মাতার। সেখানে যেতে তাদের বাধ্য করা হয়। অনেকে আবার জন্মদাতা পিতা-মাতার জন্য অতটুকুও ভদ্রতাও দেখান না। ওরা জন্মদাত্রীকে ফেলে আসেন রাস্তঘাটে, নর্দমায়। ঐপশুরা আমাদের অতি শ্রদ্ধেয় মুরব্বিদের কখনোবা ডাস্টবিনে ফেলে আসতেও দ্বিধা করেন না। এমন ঘটনা কতটা অমানবিক, কতটা বিবেকবর্জিত এবং আপত্তিকর, সেটা সহজেই বুঝা যায়।
এই অমানবিক বিষয়গুলোকে আমাদের সামনে আনা উচিৎ। সমাজ, রাষ্ট্র এবং পরিবারের অপরাপর লেখকদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত। এ নিয়ে আন্দোলন হতে পারে। পরিবারের লোকজন এ আন্দোলনে শামিল হবেন, প্রতিবেশীরা যোগ দেবেন। রাষ্ট্রেরও এ ব্যাপারে দায় আছে। রাষ্ট্র এমন অমানবিক বিষয়কে আইনের আওতায় আনতে পারে। নিয়োজিত ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন করে কু-সন্তান কিংবা কু-পুত্রবধুদের তাৎক্ষণিক ৬ মাস কিংবা ততোধিক সময়ের জন্য সাজা দিতে পারে না। বিষয়গুলো জনসমক্ষে নিয়ে আসা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে আমাদেরও কর্তব্য আছে। পরিবারের অন্য সদস্য, প্রতিবেশীরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে তার কর্মস্থলে গিয়ে প্রতিবাদ জানাতে পারেন। লিখিত অভিযোগ দিতে পারেন। মোদ্দা কথা হলো, সকলকে সকলের জায়গা থেকে ওদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে, প্রতিরোধ গড়তে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় নিজেরা নিজেদের থেকে ভালো হয়ে গেলে। ভাবনায় আনতে হবে, আমরা আমাদের পিতা-মাতার কারণেই পৃথিবীতে আসতে পেরেছি। তারাই আমাদের আলোর মুখ দেখিয়েছেন। তারাই আমাদের আগুন, পানি, রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা করেছেন। শিক্ষা দিয়েছেন, দিনদিন বড় করে তুলেছেন। মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন; যদিও আমরা অনেকে মানুষ না হয়ে অমানুষই হয়েছি।
আমরা অমানুষ হয়ে যাচ্ছি বলেই আমাদের মা-বাবারা আমাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এখানে আরেকটি ঘটনা সামনে না আনলেই নয়। হৃদয়বিদারক এ খবরটি আমাদের কোন এক জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ‘নাটোরে শতবর্ষী অন্ধ মাকে রাস্তায় ফেলে দিলো সন্তানরা’ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, নাটোরের ওই অন্ধ মা শতবর্ষী এবং পাঁচ সন্তানের জননী। সন্তানরা একদিন তাকে রাতে রাস্তায় ফেলে দেয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসী তাকে তার বড় ছেলের বাড়িতে রেখে আসে। বৃদ্ধার ছেলে মেয়ে নাতবৌরা অন্ধ বৃদ্ধাকে রাতে থাকতে দেন গোয়ালঘরে। বৃদ্ধার তিন ছেলের আধা পাকা বাড়ি ও প্রয়োজনীয় জমিজমা থাকলেও তারা কেউ মায়ের দায়িত্ব নেননি। পরে তারজায়গা হয় বৃদ্ধাশ্রমে।
‘আপনের চেয়ে পর ভালো, পরের চেয়ে বৃদ্ধাশ্রম।’ কঠিন এক সত্য। আর এ সত্যকে মেনেই অনেক বৃদ্ধ মা-বাবা আশ্রয় নেন বৃদ্ধাশ্রমে। সন্তানের কাছে যাদের বেশি কিছু চাওয়ার নেই; শেষ বয়সে আদরের সন্তানের পাশে থেকে সুখ-দুঃখ ভাগ করবার ইচ্ছা এতটুকুই যা চাওয়ার। আর এ নিয়েই প্রতিটি পিতা-মাতা প্রহর গুনতে থাকেন দিবা-রজনী। কিন্তু অনেকেরই সেই সন্তানের কাছে আশ্রয় না হয়ে; আশ্রয় হয় আপনজনহীন বৃদ্ধাশ্রমে। শেষ বয়সে ঘরের কোণেও জনমদুখী মা-বাবার এতটুকুও জায়গা মিলে না। ওদের ছুঁড়ে দেয়া হয় প্রবীণ নিবাসনামীয় নরকে। তবুও প্রতিবাদ দানা বাঁধে না; মন অভিশাপ দেয় না। নাড়ী ছেঁড়া ধন ওরা। তাই চুপ থাকেন, একেবারে চুপ। তবে এ নিষ্ঠুরতা তাদের কেবলই কাঁদায়। এ কেমন নিয়তি? ভাবি আমরা কতটাই না আধুনিক স্বার্থপর!
এ লেখায় আরো কিছু পুরনো ঘটনা সামনে না আনলে পাঠকের পুরোপুরি চেখের জল ঝড়বে না হয়তো। “বৃদ্ধাশ্রম থেকে সন্তানের কাছে মায়ের চিঠি” ফেসবুকে এ শিরোনাম দেখে এ লেখার মন্তব্যে আমি এভাবে লিখেছিলাম- “এই ছেলে তোকে কি বলে ডাকি বলতো? কুকুর, বিড়াল, শুকর? না এ নামে তোকে ডাকলে পশুজাতীর যে আর মান ইজ্জত রইবে না। ডাকা ডাকি বাদ দিই। বরং তোর মায়ের মতই তোর জন্য দোয়া করি- “তুই বেঁচে থাক বছরের পর বছর অনন্তকাল”। খোদার কাছে প্রার্থনা এই যে, তিনি যেন তোর অমানুষী মনে উপলব্ধি সৃষ্টি না করে তোর কাছে আজ্রাইল না পাঠান। চিঠি পড়ে তোর মায়ে কষ্ট আমি পুরটা উপলব্ধি করতে পারছি না। এতো বেশী কষ্ট উপলব্ধি করি কি করে? তোর জন্য ফরিয়াদ করি, খোদা যেন তোকে তোর মায়ের মত সমকষ্ট দিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করান। এর বেশী কষ্ট তোর জন্য বোধ করি প্রয়োজন পড়বে না। তোর মা কষ্ট যেমনটা পেয়েছেন ঠিক তেমন কষ্টই তোকে দিক খোদা। ভালো থাকিস.. ”। ফেসবুকে আমার এ মন্তব্যের পর এর সমর্থনে শতাধিক মন্তব্য পেয়েছি যা পরলে অনেকেরই চোখে জল আসবে।
বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো ঐ মা তার ছেলেকে লিখেছেন-“খোকা তুই কেমন আছিসরে? বউমা আর আমাদের ছোটো দাদুভাই সবাই ভালো আছেতো? জানি তোদের তিন জনের ছোট সংসারে প্রত্যেকেরই খুব কাজ। তবুও তোদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ। একদিন একটু সময় করে এই বুড়ি মাকে দেখতে আয় না! কিরে, আসবি না? ওঃ বুঝতে পেরেছি! এখনো আমার উপর থেকে অভিমান যায়নি বুঝি! আমাকে যেদিন বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলি, সেদিন ঝগড়া করেছিলাম বৃদ্ধাশ্রম থেকে আমাকে নিতে আসা লোকজনদের সঙ্গে। জানি শেষ দিনটাতে একটু বেশি রকমেরই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম, তাছাড়া আর কিইবা আমি করব বল, সময় মতো ওরা এসে আমার জিনিসপত্র সব জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে নিল, তারপর বারবার তাগাদা দিতে লাগল। বাবা কারণ আমি তোর সঙ্গে দেখা করে আসার জন্য তাদের কাছে সময় চেয়েছিলাম, তারা সময় দিলেও শেষ পযর্ঞ্চন্ত তুই আসিসনি। তুই কাজে এত ব্যস্ত থাকিস তখন আমার মনে ছিলনা। পরে মনে পড়েছিল, তাই তোর সঙ্গে দেখা না করেই চলে এসেছি। তুই রাগ করিসনি তো? আর সেদিন আমার সেই জেদ দেখে বউমা তো রেগেই আগুন। তাছাড়া তার তো রাগবারই কথা! আমাকে নিয়ে যেতে যারা এসেছিলো, অল কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা যা তড়িঘড়ি শুরু করে দিলৃতা দেখবার জন্য পাশের বাড়ি থেকে কেউ কেউ উঁকি দিতে লাগলো। এতো বউমার একটু লজ্জাবোধ হবেই। সেদিন তোদের যে অপমান করে এসেছি তোরা সেসব ভুলে যাস কেমন করে! আমার কথা ভাবিস না। আমি খুব ভালো আছি! আর কেনই-বা ভালো থাকবনা বল? তোরা তো আমার ভালো থাকবারই বন্দোবস্ত করে দিয়েছিস। তবে একটা কথা, আমার কথা যদি তোর কখনো-কোনোদিন মনে পড়ে; তখন যেন নিজেকে তুই শেষ করে দিস না। তুই এখনো একশ বছর বেঁচে থাক।”
বৃদ্ধাশ্রম অবহেলিত বৃদ্ধদের জন্য শেষ আশ্রয়। তাদের সারা জীবনের অবদানের যথার্থ স্বীকৃতি, শেষ সময়ের সম্মান ও নিরাপত্তা দেয়া হয় এসব বৃদ্ধাশ্রমে। এখানে তারা নির্ভাবনায়, সম্মানের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে বাকি দিনগুলো কাটাতে পারেন। প্রয়োজনে অনেক বৃদ্ধাশ্রমে চিকিৎসারও সুন্দর ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু সকল প্রাপ্তির মাঝেও এখানে যা পাওয়া যায় না তা হলো নিজের পরিবারের সান্নিধ্য। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ তার সনত্মান, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে একত্রে থাকতে চান। তাদের সঙ্গে জীবনের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চান। সারাজীবনের কর্মব্যস্ত সময়ের পর অবসরে তাদের একমাত্র অবলম্বন এই আনন্দটুকুই। বলা যায় এর জন্যই মানুষ সমগ্র জীবন অপেক্ষা করে থাকে। বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় পাওয়া যায়, সঙ্গীসাথী পাওয়া যায়, বিনোদন পাওয়া যায়, কিন্ত শেষ জীবনের এই পরম আরাধ্য আনন্দটুকু পাওয়া যায় না যার জন্য তারা এই সময়টাতে প্রবল মানসিক যন্ত্রণা আর ভারাক্রানত্ম হৃদয়ে আবেগাপস্নুত হয়ে ওঠেন।নেহায়েত অনন্যপায় হয়ে, ইচ্ছার বাইরে যারা বাবা- মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠান, তাদের কথা ভিন্ন। কিন্তু যারা নিজের পর্যাপ্ত সম্পদ ও সময় সুযোগ থাকার পরও শুধু অবহেলা করে পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে ভুলে যান, তাদের স্মরণ রাখা দরকার, এমন সময় তাদের জীবনেও আসতে পারে। যে বাবা-মা একসময় নিজে না খেয়েও সনত্মানকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন, তারা আজ কোথায় কেমন আছেন সেই খবর নেয়ার সময় যাঁর নেই তার নিজের সনত্মানও হয়ত একদিন তার সঙ্গে এমনই আচরণ করবে। বিভিন্ন উৎসবে, যেমন ঈদের দিনেও যখন তারা তাদের সনত্মানদের কাছে পান না, সনত্মানের কাছ থেকে একটি ফোনও পান না, তখন অনেকেই নীরবে অশ্রম্নপাত করেন আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। এমনকি সেই সনত্মানকে অভিশাপ দিয়ে কামনা করেন, তার সন্তান তার সঙ্গে যে আচরণ করল, ভবিষ্যতে তার ছেলের সনত্মানও যেন একই আচরণ করে।
একদিন যে সন্তানের জন্য বাবা-মা ছিলেন স্নেহময়, যে সন্তান একটু আঘাত পেলেই বাবা হয়ে উঠতেন চিন্তিত। যে সন্তানকে নিজে হাত দিয়ে খাইয়ে দিয়েছেন, কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন এবং কখনই নিজের অসুবিধার কথা সন্তানদের বুঝতে দেননি। আজকাল সমাজে এমন কিছু সন্তান দেখা যায়, যারা কি না মা-বাবার এতোসব আদর-যত্নের কথা ভুলে মা-বাবাকে ঠেলে দেয় অজানা গন্তব্যে। বৃদ্ধ ও অসহায় বলে তাদের ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রমে। ঘরের মধ্যে সবার থাকার জায়গা হলেও এখানে বৃদ্ধ মা-বাবার জায়গা হয় না। আসলে একজন মা-বাবা তার সন্তানদের জন্য যা করেন, তা তাদের পক্ষে সারা জীবনেও শোধ করা সম্ভব নয়। বুড়ো বয়সে এসে তারা চায় একটু শান্তি, ভালোবাসা ও স্নেহ। এ বয়সে একটু আদর-যত্ন পেলেই তারা খুশি হন। মা-বাবা চান সন্তানরা যেন তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনে। আমাদের মনে রাখা উচিত আজ যিনি সন্তান, তিনিই আগামী দিনের পিতা কিংবা মা। বৃদ্ধ বয়সে এসে মা-বাবারা যেহেতু শিশুদের মতো কোমলমতি হয়ে যায়, তাই তাদের জন্য সুন্দর জীবনযাত্রার পরিবেশ তৈরি করাই সন্তানের কর্তব্য। আর যেন কখনো কোনো পতা-মাতার ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তাদের জন্য তৈরি করতে হবে একটা নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী।
আসলে মা-বাবা তার সন্তানদের জন্য যা করেন, তা তাদের পক্ষে সারা জীবনেও শোধ করা সম্ভব নয়। বুড়ো বয়সে এসে তারা চান একটু শান্তি, ভালোবাসা ও স্নেহ। এ বয়সে একটু আদর-যত্ন পেলেই তারা খুশি হন। মা-বাবা চান সন্তানরা যেন তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনে। আমাদের মনে রাখা উচিত, আজ যিনি সন্তান, তিনিই আগামী দিনের পিতা কিংবা মা। বৃদ্ধ বয়সে এসে মা-বাবারা যেহেতু শিশুদের মতো কোমলমতি হয়ে যায়, তাই তাদের জন্য সুন্দর জীবনযাত্রার পরিবেশ তৈরি করাই সন্তানের কর্তব্য। আর যেন কখনো কোনো পিতা-মাতার ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তাদের জন্য তৈরি করতে হবে একটা নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী।
লেখক: মহাসচিব- কলামিস্ট ফোরাম অফ বাংলাদেশ, চেয়ারপার্সন (পরিবেশ)- লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল (৩১৫ এ-১)
সারাবাংলা/এসবিডিই
আপনের চেয়ে পর ভালো- পরের চেয়ে বৃদ্ধাশ্রম মীর আব্দুল আলীম মুক্তমত