জন্ম-মৃত্য নিয়েই জীবন। তবুও কিছু মৃত্যু যেন অমলিন হয়ে থাকে। কিছু মৃত্যু সময়ের সাথে বিলিন হয়ে যায়। কিছু মানুষ পাশে থেকেও মনে থাকে না, আবার কিছু মানুষের সাথে কোন দিন সাক্ষাৎ না হলেও মন থেকে ভোলা যায় না। তারা যেন সব সময়ের জন্য মনের কোঠরে মূর্তিমান হয়ে থাকে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দেখাহীন, কথাহীন তেমনি একটি ব্যক্তিত্ব আমার কাছে। যার সাথে কোন দিন পরিচয় না হলেও তার ব্যক্তিত্বে সে হয়ে ওঠে প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। আমি রাজনীতি করি না তবুও সে কেন প্রিয় হলো নিজেও অনুধাবন করতে পারি না। তবে প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, তোফায়ের আহমেদ, প্রয়াত আব্দুল জলিল, প্রয়াত আঃ রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু এ্ই গুণী কয়জনকে আওয়ামীলীগে না দেখলে নিজেই হতাশ হয়। এরা যেন আওয়ামীলীগের বটবৃক্ষ। এটা নিতান্তই আমার মত। হাওর থেকে উঠে এসে তিনি যে এত বড় মাপের নেতা হয়েছেন এটা ভাবলে সত্যি ঈর্ষা হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী।
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য, সত্তরের প্রাদেশিক পরিষদের কনিষ্ঠতম সদস্য এবং স্বাধীন দেশের প্রথম সংসদের সদস্য, আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মৃত্যুবরণ করেন ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭। তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামে ৫ মে ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। প্রবীণ এ পার্লামেন্টারিয়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। পরে ঢাকা সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি সম্পন্ন করে আইন পেশায় নিযুক্ত হন।
রাজনৈতিক জীবনে ছাত্রজীবনের প্রথমেই তিনি বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। হাওরাঞ্চলের ‘জাল যার জলা তার’ আন্দোলনে দীর্ঘদিন তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি সুনামগঞ্জ-২ আসন থেকে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মোট সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে সত্তরের নির্বাচনেও তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত সুরঞ্জিত ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের নির্বাচনে ন্যাপ থেকে জয়ী হয়ে আলোচনার জন্ম দেন। এছাড়া স্বাধীন দেশের প্রথম সাংসদসহ চার দশকের প্রায় সব সংসদেই নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। বর্তমান সংসদে তিনি ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি। একাত্তরে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ৫ নম্বর সেক্টরের সাব কমান্ডার হিসেবে।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯৭৩ সালে স্বাধীন দেশের প্রথম সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন ন্যাপ থেকে। নব্বই দশকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আওয়মী লীগে যোগ দেন। এর আগে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও একতা পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রেলমন্ত্রী নিযুক্ত হন। যদিও সহকারীর অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর তিনি পদত্যাগ করেন। তবে প্রধানমন্ত্রী সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিপরিষদে রাখেন। এর আগে ১৯৯৬ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষযয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সংসদে সব সময় সরব এ সংসদ সদস্য একজন অভিজ্ঞ সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। এই প্রবীণ নেতা নবম সংসদে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ছিলেন।
২০১৭ সালের ৩ ফেব্রয়ারি শুক্রবার ফুসফুসের সমস্যার জন্য রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে। এরপর ৪ ফেব্রুয়ারি শনিবার রাতে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় তাকে প্রথমে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেয়া হয়। পরে রাতেই তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। ৫ ফেব্রয়াারি রোববার রাত ৪টার দিকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
রাজনীতিতে শেষ বলে কোন কথা নেই। তাই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত না থাকলেও রাজনীতি চলছে নিজ গতিতে। ধারাবাহিকভাবেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে তার আসনে নির্বাচন। সদ্য সম্পন্ন হওয়া নির্বাচনে তার পত্নী জয়া সেনগুপ্ত বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে জয়ী হয়েছেন। তার জয়ে যেমন খুশী হয়েছি এই ভেবে যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রাজনৈতিক ত্যাগ ব্যর্থ হয়নি সেই সাথে প্রশ্নও জেগেছে কি এমন দলীয় কারণ ছিল যে কারণে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত’র স্ত্রীকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হলো না? রাজনীতিতে যারা দলের জন্য নিবেদিত কর্মীর মত কাজ করবে প্রার্থী থাকা সাপেক্ষে তাদের দলীয় মনোনয়নের বিষয়ে আলাদা দৃষ্টি আওয়ামীলীগে আছে এবং থাকা উচিত বলে মনে করি।
একজন খাঁটি রাজনীতিবিদ ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ছিলেন গণমানুষের নেতা। হাওরের জলকাদায় বেড়ে ওঠা এই মানুষটি জীবনভর দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। তার মতো জনকল্যাণে নিবেদিত রাজনীতিকের এখন বড় অভাব। বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে স্পষ্টবাদী, সাহসী এই নেতার অগ্রণী ভূমিকা ছিল। তিনি তার কর্মের মাধ্যমেই জনতার মধ্যে বেঁচে আছেন এবং থাকবেন।’ তার জীবনী পড়ে একটি নিভৃত পল্লী অঞ্চল থেকেও সঠিক রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে বড় মাপের নেতা হওয়া যায় এই আত্মবিশ্বাস জন্ম নিবে। সঠিক রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে একটি দলের একজন নিবেদিত প্রাণ হওয়া যায় সেটাও জন্ম নিবে বলে আশা করি। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ে দলের নিবেদিত প্রাণ হয়ে রাজনীতি করার মানসিকতাটা যেন হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে দলীয় আনুগত্য প্রদর্শন। চলছে এক প্রকার অসুস্থ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত’র সকল ভাল কর্ম নিয়ে আরও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত’র জন্ম হোক। রাজনীতির ব্যাপ্তি হোক সুস্থ ধারায়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আত্মাকে স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধায়।
লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক